Maahi Rude- NEET Case

৯০% অক্ষমতা নিয়েও ডাক্তারির প্রবেশিকায় বসতে সক্ষম! বম্বে হাই কোর্টে মরাঠি তরুণী মাহির হয়ে আইনি লড়াইয়ে বঙ্গকন্যা পৃথা

মেডিক্যালের প্রবেশিকা পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়ার পরেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে শেষ পর্যন্ত প্রার্থীকে ডাক্তারি পড়তে দেওয়া হয়নি, এমন নজির অনেক। এই নিয়মের বেড়াজালে আটকে গিয়েছিলেন মাহিও।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২৫ ১৫:১৪
Share:

(বাঁ দিকে) হুইলচেয়ারে মাহি রুডে। তাঁর আইনজীবী পৃথা পাল (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

পেটের নীচ থেকে গোটা শরীর অকেজো। হাঁটতে পারেন না। চলাফেরা হুইলচেয়ারেই। তবু এই পঙ্গুত্ব তাঁকে দমাতে পারেনি। স্বপ্ন, ডাক্তার হবেন। প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু নিয়মের বেড়াজালে মুহূর্তে চুরমার হয়ে গিয়েছিল সেই স্বপ্ন।

Advertisement

ফলে বছর কুড়ির মাহি রুডেকে আদালতে গিয়ে বলতে হয়েছে, হুইলচেয়ার মানেই ‘পরনির্ভরশীলতা’ নয়। প্রতিবন্ধকতা মানেই ‘অশক্ত’ হওয়া নয়। প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার অনুমতি দিয়েছিল আদালত। কিন্তু তিনি আবার বসতে চান ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষায়। অতএব, আবার লড়াই! আবার আদালত। মহারাষ্ট্রের ঠাণের তরুণী মাহির এই স্বপ্নপূরণের লড়াইয়ে তাঁর সারথি এক বাঙালিকন্যা।

ছোট থেকে ‘স্পাইনা বিফিডা’ রোগে আক্রান্ত মাহি। ভারতে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে চার-পাঁচ জনের হয় এই রোগ। প্রসবের পরেই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় নবজাতকের শরীরে। মেরুদণ্ডের গঠনগত ত্রুটি দিয়ে সূত্রপাত। তার পর ধীরে ধীরে পঙ্গু হতে থাকে শরীর। সেই সঙ্গে ক্ষতি হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রেরও।

Advertisement

জন্মের পর প্রথম ১০ বছরেই পাঁচ বার অস্ত্রোপচার হয়ে গিয়েছিল মাহির। তার পরেও তিনি ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সেই অবস্থাতেও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় পাশ করে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা ‘নিট’-এর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবন্ধকতা। এক রকম হালই ছেড়ে দিয়েছিলেন মাহি। পরে এক চিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে তিনি বম্বে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন, যাতে তাঁকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়।

মাহির আবেদন মঞ্জুর করেছিল উচ্চ আদালত। চলতি বছর পরীক্ষায় বসেওছিলেন তরুণী। কিন্তু ফল ভাল হয়নি। সেই ভাবে সময়ই পাননি প্রস্তুতি নেওয়ার। কিন্তু ছোট থেকে বোনা স্বপ্ন কি এত সহজে ভাঙতে দেওয়া যায়! মাহি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সামনের বছরেও ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসবেন। অর্থাৎ আবার আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে! মাহির হয়ে সে‌ই কাজটাই করছেন সল্টলেকের বাসিন্দা পৃথা পাল।

বম্বে হাই কোর্টে মাহির হয়ে সওয়াল করছেন আইনজীবী পৃথা। কর্মসূত্রে তিনি ওই বঙ্গতনয়া এখন মুম্বইয়ে থাকেন। পৃথা বলছেন, ‘‘২০২৩ সালে প্রথম বার পরীক্ষায় বসতে গিয়ে মাহি দেখেন, অ্যাডমিশন ফর্মে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ প্রতিবন্ধকতার শর্ত রয়েছে। মাহি সেটাতেই টিক চিহ্ন দিয়েছিলেন। পরে যখন উনি প্রতিবন্ধকতার নথি জমা দেন, ফর্মটাই বাতিল করে দেওয়া হয়। কারণ নথিতে বলা রয়েছে, মাহি ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী।’’

পৃথা জানান, মাহি হাঁটতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁর হাত সচল। এমনও নয় যে, তাঁর মানসিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। শরীরের নীচের অংশে ৯০ শতাংশ পঙ্গুত্ব রয়েছে মানে কেউ চাইলেও ডাক্তার হতে পারবেন না, এমন নিয়ম মানতে নারাজ পৃথা। তাঁর কথায়, ‘‘মাহিরই এক চিকিৎসক সন্তোষ কর্মাকর ওঁকে আমাদের ল’ফার্মে এনেছিলেন। তার পরেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, মামলা করব। সন্তোষও এই মামলার সঙ্গে জড়িত। আদালতে আবেদন করার সময়েই আমরা দেখি, নিয়ম রয়েছে, ৮০ শতাংশের বেশি লোকোমোটিভ (গতি) প্রতিবন্ধকতা থাকলে ডাক্তারি পড়া যাবে না! শরীরের নীচের অংশ পঙ্গু হলে কেউ রোগী দেখতে পারবেন না— এটা ভাবা ঠিক নয়।’’

মেডিক্যালের প্রবেশিকা পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়ার পরেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে শেষ পর্যন্ত প্রার্থীকে ডাক্তারি পড়তে দেওয়া হয়নি, এমন নজির অনেক।

যেমন কর্নাটকের সুরেশ। আট সেন্টিমিটারের বেশি দূরত্বের কোনও জিনিস দেখতে পেতেন না। সেই প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় ৮৬ শতাংশ নম্বর পান সুরেশ। ২০১৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হন মেডিক্যালে। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিক্ষীণতাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই) ভর্তি বাতিল করে দেয়। সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ সুরেশও আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।

একই ভাবে, ২০২৪ সালে মহারাষ্ট্রের ওমকার রামচন্দ্র গোঁদের মামলার কথাও মনে করালেন পৃথা। তিনি বলেন, ‘‘ওই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, গাইডলাইন এমন ভাবে তৈরি করা হোক, যাতে আরও বেশি সংখ্যক পড়ুয়া ডাক্তারি পড়তে পারে। কেউ যদি ডাক্তারি সংক্রান্ত কাজে সক্ষম হন, তা হলে তাঁকে সুযোগ দেওয়া উচিত।’’

শীর্ষ আদালতের এই পর্যবেক্ষণকে হাতিয়ার করেই মাহির ডাক্তারির পরীক্ষায় বসার অধিকার ছিনিয়ে এনেছিলেন পৃথা। কিন্তু লড়াই এখনও শেষ হয়ে যায়নি। মাহি আবার পরীক্ষায় বসবেন। তাই আবার আদালতের অনুমতি প্রয়োজন। পৃথা বলেন, ‘‘আমাদের প্রথম আবেদন, ওঁর (মাহির) পরীক্ষায় বসার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় আবেদন, উনি যদি ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেন, তা হলে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধকতার কারণে যাতে ভর্তি না আটকায়। আর তৃতীয়ত, ৮০ শতাংশের বেশি প্রতিবন্ধকতা থাকলেই কাউকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না, এটা যেন ভবিষ্যতে না হয়, তা নিশ্চিত করা। মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ সেপ্টেম্বর।’’

পৃথার বেড়ে ওঠা কলকাতাতেই। শহরের নামী বেসরকারি স্কুল থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পাশ করে বেথুন কলেজে ভর্তি হওয়া। তার পর সেখানে ইংরেজিতে স্নাতক পাশ করে হরিয়ানার কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা। পাশ করে দিল্লিতে কিছু দিন বৃন্দা গ্রোভারের মতো আইনজীবীদের কাছে শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ করার পর মুম্বইয়ে প্রবীণ আইনজীবী মিহির দেশাইয়ের চেম্বারে চাকরি।

চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর পরেই সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদের মামলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন পৃথা। গোধরা পরবর্তী গুজরাত হিংসা মামলায় জাল সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশে অভিযুক্ত তিস্তার স্থায়ী জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। পৃথা সেই মামলার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।

পরবর্তী কালে ভীমা-কোরেগাঁও মামলা, এমনকি ২০০৬ সালে মুম্বইয়ে ট্রেনে ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা সংক্রান্ত মামলারও কাজকর্ম করেছেন পৃথা। ওই তরুণী বলেন, ‘‘আমরা মূলত মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করি। বিচারবিভাগীয় খুন, জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবৈষ্যমের বিরুদ্ধে এবং বন্দি ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য আমরা ল়ড়ি। এখন আর একটা মামলা নিয়ে কাজ করছি। মুম্বইয়ে স্ত্রীর সামনে এক মুসলিম যুবককে খুনের অভিযোগ উঠেছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। এফআইআর হয়নি। দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে দেখিয়েছিল পুলিশ। সেই মামলা লড়ছি আমরা। হাই কোর্টে মামলা চলছে।’’

পৃথা লড়ছেন মাহির স্বপ্নপূরণের জন্যেও। তিনিই মাহির সারথি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement