(বাঁ দিক থেকে) নরেন্দ্র মোদী, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভ্লাদিমির পুতিন। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে শুল্ক-সংঘাতের মূলে রয়েছে ‘রাশিয়ার তেল’! ভারত কেন রাশিয়া থেকে তেল কিনছে? আপত্তি আমেরিকার। তাদের দাবি, তেল বিক্রি করে রাশিয়া যা লাভ করছে, তা ব্যবহার করছে ইউক্রেন যুদ্ধে। এর অর্থ হল, ভারত পরোক্ষ ভাবে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সাহায্য করছে! শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত খনিজ তেল কেনা বাড়িয়েছে ভারত। সেই প্রসঙ্গ তুলেও ভারতের উপর নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পাশাপাশি, ‘শাস্তি’ হিসাবে ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশের উপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। বুধবার থেকে নতুন হারে শুল্ক চালু হয়েছে। তবে ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি, শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরেও রাশিয়া থেকে তেল কেনার ব্যাপারে পূর্বের অবস্থানেই অনড় ভারত। স্পষ্ট বার্তা, ট্রাম্পের হুমকির সামনে মাথা নত করে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করা হবে না!
প্রশ্ন, দু’দফায় ট্রাম্পের মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরও কেন ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনার ব্যাপারে পিছপা হল না? বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া থেকে তেল কেনায় ভারত অনেক বেশি লাভবান হচ্ছে। সেই বিষয় বিবেচনা করেই রাশিয়ার থেকে তেল কেনা বন্ধ করতে চায় না ভারত। দীর্ঘ দিন ধরেই রাশিয়ান খনিজ তেলের অন্যতম ক্রেতা নয়াদিল্লি। আগে রাশিয়া থেকে তারা অনেক কম তেল আমদানি করত। তবে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ছবিটা অনেকটা পাল্টেছে।
ইউক্রেনের উপর আক্রমণ করার পর থেকেই আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্বের দেশগুলির রোষের মুখে পড়ে রাশিয়া। অনেক দেশই রাশিয়ার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। তেল কেনা বন্ধ করে রাশিয়ার কাছ থেকে। তবে সেই নিষেধাজ্ঞার পথে হাঁটেনি ভারত। অন্য দেশগুলি তেল কেনা বন্ধ করায় দাম একলাফে অনেকটা কমিয়ে দেয় রাশিয়া। সেই সুযোগই নেয় ভারত। অধিক ছাড়ে রাশিয়া তেল বিক্রি শুরুর পর ভারত আমদানি বাড়িয়ে দেয়। এক ধাক্কায় এক শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছে যায় ভারতের আমদানির পরিমাণ।
এ ছাড়াও, রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনা অব্যাহত রাখার নেপথ্যে আরও কিছু কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। সেই কারণে জ্বালানি তেলের চাহিদা এ দেশে সব সময়ই তুঙ্গে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তেল উৎপাদন করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই কারণে তেলের জন্য রাশিয়ার দিকে বেশি ঝুঁকেছে ভারত। শুধু তা-ই নয়, ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কিনে, তা দেশীয় ব্যবহারের জন্য কিছু পরিশোধন করে। তবে বাকি অংশ ইউরোপ এবং অন্য জায়গায় রফতানি করেও লাভবান হয় ভারত।
গত বছর রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে প্রচুর লাভ করেছে পরিশোধন সংস্থা রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ়। কারণ, মূলত এই সব কোম্পানিই রাশিয়ার তেল পরিশোধিত করে থাকে। তার পরে তা অন্যত্র রফতানি করে। শেয়ার বাজারেও তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে।
শুধু ভারত নয়, আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে চিন। সেই আবহে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা নিঃসন্দেহে আমেরিকার বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী চিন। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে চিনকে দমিয়ে রাখার কৌশল নিয়েছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার মুখে। অনেকের মতে, সব মিলিয়ে ‘চাপে’ পড়েই ভারতের উপর শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারিতে রাশিয়ার থেকে তেল কেনা বন্ধ করলে বিপদ বৃদ্ধির আশঙ্কাও রয়েছে। সম্প্রতি ‘স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’ (এসবিআই) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের জ্বালানি খরচের বিষয়টি। সেই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয়, তবে চলতি অর্থবর্ষ অর্থাৎ ২০২৫-২৬ সালেই ভারতে তেল আমদানি করার খরচ ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার বেড়ে যাবে, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকা। পরের অর্থবর্ষে এই খরচের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ২০২৬-২৭ সালে ভারতে তেল আমদানি করার খরচ ১,২০০ কোটি মার্কিন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার বেশি) বাড়বে।