মুম্বই মনতাজ

বর্ষা ও কবি কালীদাস

মিলন মুখোপাধ্যায়ইস্কুলের পাঠ্যবইতে দুলে দুলে মুখস্থ করতুম, “দিনে চব্বিশ ঘণ্টা। তিরিশ দিনে এক মাস। বারো মাসে এক বছর। বছরে ছয়টি ঋতু।” হায়! ছয়টি ঋতু দূরস্থান। টেনে-টুনে, এই মুম্বই শহরে চারটিই পাওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ বর্তমান। গ্রীষ্ম-বরষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত। সারা বচ্ছরই রাত-বিরেতে, দিনে-দুপুরে, পাড়ায় গাছ থাকলেই কোকিলের ডাক শোনা যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

ইস্কুলের পাঠ্যবইতে দুলে দুলে মুখস্থ করতুম, “দিনে চব্বিশ ঘণ্টা। তিরিশ দিনে এক মাস। বারো মাসে এক বছর। বছরে ছয়টি ঋতু।”

Advertisement

হায়!

ছয়টি ঋতু দূরস্থান। টেনে-টুনে, এই মুম্বই শহরে চারটিই পাওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ বর্তমান। গ্রীষ্ম-বরষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত। সারা বচ্ছরই রাত-বিরেতে, দিনে-দুপুরে, পাড়ায় গাছ থাকলেই কোকিলের ডাক শোনা যায়। সেখানে কখন বসন্ত আসে, কখনই বা চলে যায়, সে বোঝার অবকাশই থাকে না নগরবাসীর। আর, এই দুরন্ত, ছুটন্ত শহরে সময়ই বা কোথায়। ‘বসন্তের দূত’ যেমন বলা হত কোকিলকে, তেমনই শরতের দূত (কিংবা ভূত) হল কাছেপিঠে পাড়ার ছেলেছোকরারা। হয় দুগ্গা পুজো বা ‘নবরাত্রি’র চাঁদার ‘কড়া-নাড়া’। গেল শরৎকাল।

Advertisement

হারাধনের দু’টি গেল, রইল বাকি চার।

হেমন্তরও তেমন নামডাক নেই। একমাত্র ‘কুমার’ বা ‘মুখুজ্জে’ লেজুড় জুড়লে, তবুও, অবরে-সবরে শোনা যায়। গেল তিন।

হারাধনের তিনটি ছেলে, ধরতে গেল রুই একটি খেল বোয়াল মাছে, রইল বাকি দুই।

কারণ,শীতকাল এ শহরে টেরই পাওয়া যায় না। বোয়াল মাছে খেয়ে নেয়। কলকাতা বা শহরতলিতে যেমন লেপ-কম্বল কোট-সোয়েটার তথা পশমের কমফর্টার নিয়ে, কপি-কড়াইশুঁটি-শিম-পালং সমেত শীত নেমে আসে, মুম্বই অধিবাসীদের অমন ভাগ্য নেই। ডিসেম্বরের নাভিশ্বাস বা জানুয়ারির দীর্ঘশ্বাসে তিন কি চারটি দিন শীত নামার আশা থাকে। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’এর পার্টির ক’দিন। সেই আশায় আশায় ন্যাপথালিন জড়ানো সারা বছরের কোট-পান্টুলুন, থ্রি-পিস-স্যুট-টাই মহা আড়ম্বরে হাঁড়ি-কুড়ি-সিন্দুক থেকে বেরিয়ে আসে।

পার্টিতে উপস্থিত। তারপর?

তারপরে আর কি? গলদঘর্ম! জুলপি বেয়ে, কপাল বেয়ে, গণ্ডদেশ বেয়ে ঘামের ফোঁটা নেমে আসতে থাকে। স্যুট-বুট-পরা ভদ্রলোকদের প্রাণ যায়, মান যায় রুমাল ঘষতে ঘষতে। আর, বিলিতি পোশাক-আশাকের ভেতরে গোটা শরীরে গান গায়—‘‘মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়—”! শিরদাঁড়া বেয়ে কুল কুল স্রোত নেমে আসে। কোটের ওপর থেকে তো আর পিঠ চুলকোনো যায় না। ফলে, রাত বারোটা বেজে গেলে পর এই শীতের শাস্তির মেয়াদ শেষ হয়। বলবেন, কেন, এসি, পাখা তো চলছেই, অ্যাতো গরম লাগার তো কথা নয়। হে দেব! হে দেবী! একবার হ্যাপি নিউ ইয়ার পার্টিতে থ্রি-পিস-স্যুট-বুট পরে বা পরিয়ে দেখুন না গিসগিসে লোকজনের মধ্যে পরান আইঢাই।

গেল শীত।

রইল স্রেফ দুই ঋতু। গ্রীষ্মও এখন তেমন মালুম হয় না। কলকাতা-পটনা-হায়দরাবাদ-দিল্লি-চেন্নাইয়ের তুলনায়—নস্যি!

হাতে রইল সবেধন নীলমণি, বর্ষা।

হ্যা।ঁ বর্ষাকাল মুম্বইতে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে প্রায় সারা বচ্ছর। মে মাস ফুরোতে না ফুরোতেই গুরু-গুরু শুরু হয় মেঘের। মৌসুমী বায়ুর প্রকোপ আরম্ভ হয়— ছিটেফোঁটা ফেলতে ফেলতে। তারপরে সেই ঘ্যান ঘ্যান চলতে থাকে— একেবারে প্রায় বড় পুজো-কালীপুজো অবধি টেনে নিয়ে যায়। কখনও ফিসফিস শব্দে, কখনও মুষলধারে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি ঝালমুড়ি বা তেলেভাজার সঙ্গে গপ্পো-আড্ডা জমে যায়।

আসুন, এই মওকায় আপনাদের এক খানা ‘আষাঢ়ের গল্প’ শোনাই।

অনেক, অনেক কাল আগের কথা। এক রাজ্যের রাজকন্যা বহু তা-না-না করে বিয়ের কথা এড়িয়ে গেছেন। খুব গুমোর ছিল তাঁর। তাঁর মতো বিদুষী আর দশ দিকের রাজ্যে কেউ ছিল না।

শুধু বিদুষীই কেন? এই রাজকন্যের মতো জ্ঞানী, গুণী, সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী তৎকালীন পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ছিল ভার। এই সব কথা রাজকন্যে স্বয়ং জানতেন। তার ফলে, তাঁর আচার-ব্যবহারের মধ্যে, সরব না হলেও, হাবে-ভাবে ফুটে উঠত অহংকার। তিনি সহসা জানিয়ে দিলেন রাজামশাইকে যে, এখন তিনি বিবাহযোগ্যা হয়েছেন এবং উপযুক্ত সৎপাত্র পেলে তিনি জীবনসঙ্গীকে স্বীকার করবেন।

আর পায় কে? রাজামশাই তাঁর রাজ্যের এবং আশেপাশের রাজ্যে কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে ঘোষণা করে দিলেন যে, একমাত্র রাজকন্যাকে যে কোনও রাজকুমার বা প্রজা অথবা আম-জনতার মধ্যে যে কেউ এই স্বয়ংবরে প্রার্থী হয়ে আসতে পারেন।

তবে, একটাই শর্ত। তাঁকে শাস্ত্রার্থে (শাস্ত্রর ওপরে যুক্তি-তর্কে) পরাজিত করতে হবে। মোটমাট রাজকন্যেকে অগাধ পাণ্ডিত্যে হারাতে হবে। মুখ্যু মানুষরা সেই আসার চৌহদ্দিতে গেলেন না। পণ্ডিতেরাও যারপরনাই অবহিত আছেন যে রাজকুমারীর জ্ঞানগম্যির কাছে তাঁদের নাকানি-চোবানি খেতে হবে। ও-হ্যা।ঁ একটিই শর্ত বটে, তবে, তার সঙ্গে জুড়ে আছে হেনস্থার লেজুড়। রাজকন্যেকে শাস্ত্রজ্ঞানে খুশি করতে পারলে যেমন একদিকে বিবাহ ও আধা-রাজত্বর অঙ্গীকার, অপর দিকে সম্ভাব্য পাত্র যদি হেরে যায়, তাহলে মুখে আলকাতরা মাখিয়ে, অর্ধেক মাথা মুড়িয়ে, গাধার পিঠে চড়িয়ে রাজ্য (মতভেদ থাকলেও বিদর্ভ, উজ্জয়িনী অথবা গৌড়) থেকে খেদিয়ে দেওয়া হবে।

তা, সে দেশের তর্করত্ন, তর্কবাগীশ বা অতি উচ্চাঙ্গের শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা মজা দেখার জন্যে এক মতলব করলেন। ভাবলেন, রাজকুমারীর গুমোর নিয়ে হাসিঠাট্টা করা যাবে। ফলে, রাজ্যের মহা মূর্খকে ধরে এনে উপস্থিত করলেন রাজসভায়। তা, এই সাধারণ মানুষটিই গোটা রাজ্যের মধ্যে অতি মূর্খ পণ্ডিতেরা তা বুঝলেন কি করে? না না। শাস্ত্রজ্ঞান নয়। তর্ক-বিতর্ক নয়। স্বচক্ষে ওরা দেখেছেন যে, বৃক্ষের যে শাখায় বসেছিল মানুষটি, সেই শাখা বা ডালটিই কাটছিল দা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে।

সেই দৃশ্যটি দেখে প্রথমেই তো একচোট হেসে নিলেন পণ্ডিতেরা সব্বাই মিলে। যুক্তি করে, সকলে মিলে স্থির করলেন—এমন মুখ্যু আর ধরাধামে নেই। তা, সেই “মহা-জ্ঞানী-পণ্ডিত”কে রাজা রাজকন্যে এবং সভাসদদের সামনে বিতর্ক-সভায় পেশ করার সময় ঘোষণায় শুধু একটিই কথা বলে দিলেন, “ইনি অ্যাত জ্ঞানী যে, মনে করেন, তর্ক-বিতর্কে, বাক-বিতণ্ডায় অযথা সময়ের অপচয় হয়। তাই ইনি অকারণে বাক্যব্যয় করেন না। বাক্যহীন, মূক-বিতর্কের, প্রশ্নোত্তরের পক্ষপাতী।

শুরু হল মূক-বিতর্ক।

রাজকুমারী প্রথম প্রশ্নটি করলেন, স্রেফ ডান হাতের তর্জনী দেখিয়ে। কারণ, শাস্ত্রমতে শক্তির উৎস একটিই।

মুখ্যু-রাজ ভাবল, রাজসভায় টেনে এনে ওকে সর্বসমক্ষে অপদস্থ করার মতলব সবার। রাজকুমারী আবার এক আঙুলে ভয় দেখাচ্ছে— মানে, একটা চোখ গেলে দেব, খুঁচিয়ে দেব। ফলে গবেট দেখাল দুই আঙুল। মানে ‘তুই’ আমার একটি চোখ গেলে দিলে আমি দুই চোখই গেলে দেব।

রাজকন্যা সন্তুষ্ট। কারণ, শাস্ত্রমতে, এক শক্তির উৎস আসলে ‘দুই’। যুগল। শিব-শক্তি, নর-নারী। ‘অর্ধনারীশ্বর’ই তো শক্তির প্রধান উৎস।

দ্বিতীয় মূক-প্রশ্ন রাজকন্যের। তিনি মূর্খকে তাঁর ডান হাত খুলে হাতের তালু দেখালেন। পাঁচটি আঙুল ছড়িয়ে। থাপ্পড় দেখাবার মতোই অনেকটা। সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যু-মহারাজ তার মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখিয়ে দিল। ভাবলে, ‘এই কন্যে যদি আমায় থাপ্পড় মারে, আমিও ছেড়ে দেব না। আমিও ঘুষি মেরে দেব—”।

ও দিকে, রাজার কন্যে তৃপ্ত। কারণ, উনি তাঁর শাস্ত্রবিদ্যায় শিখেছেন যে, সৃষ্টির মূল উপাদান পাঁচটি। পঞ্চভূত। ক্ষিতি-অপ্-তেজ-মরুৎ-ব্যোম। কন্যের প্রশ্নের উত্তরে তিনি মনে করেছেন, লোকটি ঠিকই উত্তর দিয়েছে। কারণ, উপাদান পাঁচটি হলেও মূল শরীর তো একটি— এক।

রাজকুমারী সন্তুষ্ট হয়েছেন। ফলে, শুভ বিবাহের ধূম তারপরেই। অতি অল্পেই মেয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলেন যে, মানুষটা একটা বুদ্ধুরাম। ফলে, লাথি মেরে ওকে প্রাসাদের বাইরে বের করে দিলেন।

হাবাগোবা মানুষটি আর কি করে? সোজা চলে গেল বনে, বনের কালীমন্দিরে। লজ্জায়-ঘৃণায় নিজের ওপর ধিক্কার দিতে দিতে আপন জিহ্বাটি কেটে মাকালীর পায়ের কাছে রাখলেন। ভেট দিলেন। মাকালী খুশি হয়ে বর দিলেন। সেই ‘গোমুখ্যু’ মায়ের বরে মহা-পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ, মহা-জ্ঞানী হয়ে উঠল।

যখন সে ফিরে এল ঘরে, স্ত্রীর (শাস্ত্রজ্ঞা) কাছে, তিনি শুধোলে, “অস্তি কশ্চিৎ বাগ্-বিশেষজ্ঞ?” তুমি কি এখন বাক্-বিশেষজ্ঞ হয়েছো।

সেই মহাজ্ঞানী তারপর তিনটি বই লিখলেন— স্ত্রীর বাক্যের প্রথম শব্দ ব্যবহার করে: ‘অস্তি’ দিয়ে লিখলেন=অস্তি-উত্তরশ্যাম্ দিশি= কুমার-সম্ভব (মহাকাব্য), কশ্চিৎ ব্যবহার করলেন= কশ্চিৎ-কান্তা=মেঘদূত (কবিতা) এবং বাক্ দিয়ে =বাগার্থাবিধ=রঘুবংশম (মহাকাব্য)।

রঘুবংশম (অধমের স্কুলে পাঠ্য ছিল) এবং কুমারসম্ভব। খণ্ডকাব্য মেঘদূত ছাড়া, নাটকও লিখে গিয়েছেন তথাকথিত ‘বুদ্ধুরাম’ কালিদাস— অভিজ্ঞান শকুন্তলম, বিক্রম-উর্ব্বশীয় এবং মালবিকা-অগ্নিমিত্র। এ ছাড়াও লিখেছেন ঋতু-সংহার (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এই নাম নিয়ে অনেক শতাব্দী পরে গোয়েন্দা উপন্যাসে লিখেছেন) এবং শ্রুত-বোধ।

গল্পগাঁথার সেই মহামূর্খ আজকের দিনেও প্রণম্য। মনে হয় কোনও এক ‘আষাঢ়’ মালেই হয়তো ওঁর জন্ম হয়েছিল। আর, তাই তো বর্ষা এলে, আষাঢ় মাস পড়লেই মনে পড়ে ওঁর বিখ্যাত ছত্র—

“আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে—”।

।। অথ কালিদাস উপাখ্যানম

সমাপ্ত ।।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement