Hotel Management

একের মধ্যে অনেক কিছু

জনসংযোগের দক্ষতা থেকে যে কোনও পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা, হোটেল ম্যানেজমেন্ট শেখায় অনেক কিছুই। সৌরজিৎ দাসজনসংযোগের দক্ষতা থেকে যে কোনও পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা, হোটেল ম্যানেজমেন্ট শেখায় অনেক কিছুই। সৌরজিৎ দাস

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০৩
Share:

প্রতীকী ছবি।

কী  ভাবে ভ্রমণের মাঝে অতিথিকে আরাম দেওয়া যায়, আপ্যায়ন করা যায়, বাড়ির বাইরে আন্তরিকতার পরিবেশ দেওয়া যায়— মূলত এটাই হোটেল শিল্পের লক্ষ্য। তোমাদের মধ্যে যারা হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে চাও, তারা হয়তো এই সব ভাবনা থেকেই এই কোর্সের কথা ভাবো। তবে জেনে রাখা ভাল, এখনকার দুনিয়ায় এই কোর্সের চাকরিক্ষেত্র কিন্তু আরও অনেক বড়, আরও অনেক বৈচিত্রময়। নানা ধরনের অন্য পেশাতে যাওয়া সম্ভব এই বিষয়ে পড়াশোনার পর।

Advertisement

পরীক্ষা এবং কোর্স

প্রথমে বলি গোড়ার কথা। পর্যটন মন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর হোটেল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কেটারিং টেকনোলজি (এনসিএইচএমসিটি) অনুমোদিত কলেজে হোটেল ম্যানেজমেন্ট-এ তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স (ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন হসপিটালিটি অ্যান্ড হোটেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) পড়ানো হয়। এনসিএইচএমসিটি ইন্দিরা গাঁধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইগনু) সঙ্গে যুগ্ম ভাবে কোর্সটি পরিচালনা করে। কলকাতায় তারাতলার ইনস্টিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্ট, কেটারিং টেকনোলজি অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড নিউট্রিশন (আইএইচএম) এনসিএইচএমসিটি-র অন্তর্গত একটি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট। আইএইচএম-এর পাশাপাশি এনসিএইচএমসিটি-র এই স্নাতক কোর্সটি এ রাজ্যে বেসরকারি ভাবে পড়ানো হয় গুরু নানক ইনস্টিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্ট (জিএনআইএইচএম), সোদপুরে।

Advertisement

এনসিএইচএমসিটি-র স্নাতকোত্তর, স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট কোর্স রয়েছে স্নাতক ছাড়াও।

সর্বভারতীয় ও রাজ্য স্তরে হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তির বেশ কিছু পরীক্ষা হয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের নিজস্ব পরীক্ষা নেয়। সমস্ত রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দু’ধরনের প্রযুক্তিগত ডিগ্রি কোর্স করা যায়— অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই) আর নন-এআইসিটিই। এআইসিটিই ডিগ্রি কোর্সের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এআইসিটিই-র অনুমোদন থাকতে হয়। নন-এআইসিটিই কোর্সের ক্ষেত্রে অনুমোদনটি বাধ্যতামূলক নয়, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন থাকলেই হয়। এ রাজ্যে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি-র (মাকাউট) অন্তর্গত কিছু কলেজে হোটেল ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত কোর্স পড়ানো হয়।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে আলাদা পরীক্ষা হয় ভর্তির জন্য। এআইসিটিই অনুমোদিত কলেজগুলিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট এন্ট্রান্স এগজ়ামিনেশনস বোর্ড একটি পরীক্ষা নেয়। পাশ করলে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ভর্তি করা হয়। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান সরাসরিই ভর্তি নেয়।

কী পড়তে হয়

সাধারণত পড়তে হয় ফুড প্রোডাকশন (কিচেন এবং বেকারি-সহ), ফুড অ্যান্ড বেভারেজ সার্ভিসেস, হাউসকিপিং এবং ফ্রন্ট অফিস ইত্যাদি সম্পর্কে। থাকে নিউট্রিশন, হোটেল অ্যাকাউন্ট্যান্সি, অ্যাপ্লিকেশন অব কম্পিউটার, ফিনানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট, স্ট্র্যাটিজিক ম্যানেজমেন্ট, ট্যুরিজ়ম মার্কেটিং ইত্যাদি আরও নানা বিষয়। আর, এই তিন বছরের কোর্সের দ্বিতীয় সিমেস্টারের যে কোনও একটা সময়ে কিছু দিনের জন্য ইন্টার্নশিপ করতে হয়।

পেশাদার হতে চাইলে

সফল হসপিটালিটি পেশাদার হতে গেলে কয়েকটি দক্ষতা থাকা বা গড়ে তোলা জরুরি। এক, ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে বাংলা এবং হিন্দিতেও সাবলীল ভাবে কথা বলতে জানতে হবে। দু’-একটা বিদেশি ভাষা জানা থাকলে ভাল হয়। দুই, কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে মাথা ঠান্ডা রেখে হাসি মুখে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই পেশায় একটা বড় গুণ হল ধৈর্য। তিন, কাজের ক্ষেত্রে ছোট-বড় বিচার করলে চলবে না। প্রয়োজনে তোমাকে হয়তো এমন কাজ করতে হতে পারে, যেটা তোমার কোনও অধস্তন বা অন্য বিভাগের কর্মীর করার কথা। প্রয়োজনে সে কাজও হাসিমুখে করার মানসিকতা না থাকলে হসপিটালিটি শিল্পে কাজ করা মুশকিল। চার, সময়ের কোনও ঠিক থাকে না। বিভিন্ন শিফটে অনেক ক্ষণ কাজ করার জন্য নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত রাখতে হয়। পাঁচ, নিয়মানুবর্তিতা, সময়জ্ঞান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সপ্রতিভতার মতো বৈশিষ্ট্যও এই পেশার ক্ষেত্রে জরুরি।

খেয়াল রেখো

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার সময় কয়েকটি জিনিস দেখে নিতে হয়। যেমন, প্রতিষ্ঠানটি যে কোর্স করাচ্ছে, তা এআইসিটিই দ্বারা অনুমোদিত কি না। বেশ কিছু ইনস্টিটিউট নিজেরা হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ায়, পরীক্ষা নেয় এবং নিজেরাই ডিগ্রি দেয়। এটা চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করবে কি না, সেটা ভাল করে জেনে নিতে হবে। তা ছাড়া, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান দূরশিক্ষার মাধ্যমেও এই কোর্স পড়ায়, যা কোথাওই গ্রাহ্য হয় না। জিএনআইএইচএম-এর অধ্যক্ষ জ়েভিয়ার গোমস-এর মতে, প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হয় যে প্র্যাকটিক্যাল করার ল্যাবগুলিতে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধে ও সরঞ্জাম রয়েছে। যেমন, বেকারিতে শুধু আভেন থাকলে চলবে না, প্ল্যানেটারি মিক্সার, ডো মিক্সার, প্রুভিং চেম্বার-এর মতো সরঞ্জামও থাকতে হবে। এ ছাড়া জানা দরকার, প্রতিষ্ঠানটি কত দিনের পুরনো, বাড়ি থেকে সেখানে যাতায়াতে সুবিধে কতখানি, ক্যাম্পাসটি র‌্যাগিং মুক্ত কি না, হোস্টেল এবং ওয়াইফাই-এর সুযোগসুবিধে কী রকম, কারা পড়াচ্ছেন, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কেমন, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত কী, প্লেসমেন্টের সময় কোন কোন সংস্থা আসছে, প্রাক্তনীরা কোথায় , কী পদে চাকরি করছেন, ইন্টার্নশিপ-এর সময় শিক্ষার্থীরা কোথায় কোথায় কাজ করতে যাচ্ছে, ফি স্ট্রাকচারই বা কী রকম ইত্যাদি।

বর্তমান পরিস্থিতি

করোনো অতিমারির কারণে অন্যান্য সেক্টরের মতো প্রভাব পড়েছে হোটেল শিল্পেও। বিশ্ব জুড়েই এখন অর্থনৈতিক মন্দার কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। তা হলে? এই কেরিয়ার-পথের ভবিষ্যৎ কী? আইএইচএম কলকাতার অধ্যক্ষ নিশীথ শ্রীবাস্তব বললেন, অনুমান করা মুশকিল, ঠিক কবে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হবে, কিন্তু তা হবেই। তাই যারা হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে আসছ, তাদের জন্য পরামর্শ, ভেঙে না পড়ে নিজেকে তৈরি করো কোভিড পরবর্তী সময়ের জন্য। প্রায় একই অভিমত মাকাউটের স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স-এর অধিকর্তা ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ভাবনী শক্তি এবং অর্জিত দক্ষতার মাধ্যমে অতিমারির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সমর্থ হবে। কোভিডের কারণে যে যে পরিবর্তন ঘটবে, তাতে প্রযুক্তির একটি বিশিষ্ট ভূমিকা থাকবে। সেই প্রযুক্তি-নির্ভর ‘নিউ নর্মাল’-কে যারা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে ও মানিয়ে নিতে পারবে, তারা তত উন্নতি করবে এই শিল্পে।

অন্য ক্ষেত্রেও সুযোগ থাকে

• কোনও ছাত্র বা ছাত্রী যখন কলেজ পাশ করে কর্পোরেট অফিসে ঢোকে, তখন তার নিজের কাজটা ঠিকমতো বুঝতে কিছুটা সময় লাগেই। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থার গোটা ব্যবসাটা বা কী ভাবে চলে, সেটা বুঝতে আরও অনেকটা সময় লাগে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট এমনই একটা কোর্স, যেখানে হিউম্যান রিসোর্স, বিজ়নেস ইকনমিক্স, ফিনানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট-এর মতো এমন অনেক কিছুই পড়ানো হয়, যাতে ছাত্রছাত্রীরা এই ক্ষেত্রের ব্যবসা সম্পর্কে একটা সার্বিক ধারণা পায়। কাজ করতে করতে এই সব বিষয়গুলির মূল ধারণা হোটেল ম্যানেজমেন্ট-এর ছাত্রছাত্রীদের আয়ত্তে এসে যায়। পরে কেউ হোটেল ইন্ডাস্ট্রির বাইরে অন্য কোনও চাকরিও করতে পারে।

• আমি যেমন হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ে কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে শেফ-এর পদে যোগ দিই। পরে চাকরি বদলে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের কাস্টমার সার্ভিস পরিষেবায় চলে যাই। হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সূত্রে গ্রাহক পরিষেবার বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে এমন অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল যে এই ইন্ডাস্ট্রির বাইরে অন্য কোনও ক্ষেত্রে গিয়ে কাস্টমার সার্ভিস সংক্রান্ত কাজ করতে অসুবিধে হয়নি।

• এমন অনেক সহকর্মী বা বন্ধুর কথা জানি, যাদের শুরুটা হয়েছিল হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে কিন্তু পরে তারা সেলস, কোর ব্যাঙ্কিং, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কিংবা আমাজন, ফ্লিপকার্টের মতো ই-কমার্স ব্যবসার এই পরিষেবার কাজে যোগ দিয়েছে। গ্রাহকের সমস্যা ঠিকমতো বুঝে সেটা তাড়াতাড়ি সমাধান করার দক্ষতা তৈরি করে দিয়েছে হোটেল ইন্ডাস্ট্রি-ই।

রাজ অর্ঘজ্যোতি মুখোপাধ্যায় ডিরেক্টর, কাস্টমার এক্সপিরিয়েন্স স্ট্র্যাটেজি, ফোনপে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন