প্রতীকী চিত্র। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
স্কুলজীবনে অঙ্ক বা ইতিহাসে ভয় রয়েছে, এ রকম ছাত্রের সংখ্যা কম নয়। ঔরঙ্গজ়েবের দাক্ষিণাত্য নীতি মুখস্থ করে রচনাধর্মী উত্তর লেখার জন্য সময় দিতে হয়। জীবন বিজ্ঞানের কঠিন ছবিটি আঁকতেও অভ্যাসের প্রয়োজন। ইংরেজিতে ‘আনসিন’ প্রবন্ধ লিখতে হলেও ছাত্রকে নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয়। কিন্তু এখন সব করা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-এর সাহায্যে। বিভিন্ন সমীক্ষা সে দিকেই ইঙ্গিত করছে।
ভারতের মতো দেশে শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে শেখানো হয়, পড়াশোনা না করলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন। সেই মতো সে ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতাপূর্ণ শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করে। রাত জেগে পড়া তৈরি করা, চারটে বই ঘেঁটে নানা রঙের কালি দিয়ে যত্নে তৈরি নোট্স— মাথার ঘাম পায়ে না ফেললে আসে না পরীক্ষার কাঙ্ক্ষিত ফল।
এখন তাদের এই অভ্যাসে হানা দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা! শোনা যাচ্ছে, স্কুল এবং কলেজের একটা বড় অংশের ছাত্রছাত্রী এখন পড়াশোনা, বিশেষ করে বাড়ি থেকে করে আনতে বলা কাজের ক্ষেত্রে চ্যাট জিপিটি, গুগ্ল জেমিনাই বা মাইক্রোসফ্ট কো পাইলট-এর মতো বিভিন্ন এআই ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ব্রিটেনের প্রতি ১ হাজার পড়য়ার মধ্যে ৫.১ জন পড়াশোনার ক্ষেত্রে এআই ব্যবহার করে ধরা পড়েছে। সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে সমাজের বিভিন্ন মহলে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অদূর ভবিষ্যতে ‘সহায়ক বই’ বা ‘টেস্ট পেপার’ কি গুরুত্ব হারাবে? এআই-এর সাহায্যে লেখা উত্তর কি শিক্ষকেরা চিহ্নিত করতে পারছেন? বাংলার পরিস্থিতিই বা কী রকম? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, যারা এআই-এর উপর নির্ভর করে পরীক্ষায় পাশ করবে, তারা কি ভবিষ্যতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে কোনও কাজে? না কি প্রকৃত শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত হবে?
স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ বাড়ির কাজ লেখার জন্য এআই ব্যবহার করছে। ছবি: এআই।
একটা সময় ছিল, যখন হোমওয়ার্কের জন্য ছাত্রছাত্রীদের রীতিমতো পড়াশোনা করতে হত। রাত জাগতে হত। কিন্তু এখন তার জন্য তাদের একটা বড় অংশ এআই-এর সাহায্য নিচ্ছে। চ্যাট বক্সে প্রশ্ন আপলোড করলেই মূহূর্তে উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। সেটিই কপি-পেস্ট করা হচ্ছে। ফলে তারা আদতে কী শিখছে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। ছাত্রছাত্রীরা যে হোম অ্যাসাইনমেন্টের জন্য এআই-এর সাহায্য নিচ্ছে, সে কথা স্বীকার করে নিলেন ‘যোধপুর পার্ক গার্লস হাইস্কুল’-এর জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষিকা অজন্তা চৌধুরী। কিন্তু তিনি কি তা বুঝতে পারছেন? অজন্তা বললেন, ‘‘একজন পড়ুয়ার মেধা সম্পর্কে ধারণা রয়েছে। তার ভিত্তিতে খুব সুন্দর গোছানো উত্তর দেখলে তখন বুঝতে পারি যে, এআই ব্যবহার করা হয়েছে।’’
ছাত্রছাত্রীদের ‘টুকলি’ ধরার জন্য পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের কড়া পাহাড়া। বিভিন্ন সময়ে তা থেকে মজার আখ্যানও কানে আসে। কিন্তু শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জ এখন আরও বেড়েছে বলা যেতে পারে। কারণ, প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকেও তাঁদের আপডেট করতে হচ্ছে। বয়স্ক শিক্ষকদের একটা বড় অংশ এখনও মোবাইল ফোন বা এআই নিয়ে সড়গড় নন। তাঁদের ক্ষেত্রে অনেকেই তাই ছাত্রদের কারসাজি চিহ্নিত করতে পারছেন না। পাশাপাশি এটাও সত্য, এআই প্রতি দিন উন্নত হচ্ছে। সেই মতো উন্নত হচ্ছে এআই-এর বিভিন্ন ‘এলএলএম’ (লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল)। তাই এআই দিয়ে তৈরি উত্তর সামান্য অদলবদল করে নিলে তা মৌলিক কি না, বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে! অঙ্কের শিক্ষক সুপ্রিয় পাঁজা বললেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের হাতে সব সময় মোবাইল। জটিল অঙ্কও এখন এআই করে দিচ্ছে। বিপদটা আমরাও বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা নিরুপায়।’’
ইংরিজিতে এআই দক্ষ। তা হলে কি বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা তুলনায় বেশি সুরক্ষিত? সাম্প্রতিক অতীতেও গুগ্ল-এর মতো ভাল বাংলা অনুবাদ করতে পারত না বিভিন্ন এআই মডেল। কিন্তু এখন সেই পার্থক্য ক্রমশ কমে আসছে। এক শিক্ষিকার কথায়, ‘‘এআই এখন খুব ভাল বাংলা অনুবাদও করে দিচ্ছে। ফলে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে।’’ কোনও লেখা এআই-এর মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে কি না, তা জানার জন্য বেশ কিছু সফ্টঅয়্যার রয়েছে। যেমন ‘টার্নিটিন’ বা ‘জিপিটিজ়িরো।’ কিন্তু তাদের ব্যবহার সীমিত। প্রথমত, এখনও শিক্ষকদের একটা বড় অংশ তা জানেন না। আর জানলেও প্রতিটি ছাত্রের উত্তর এই ভাবে যাচাই করাও সময়সাপেক্ষ বিষয় হয়ে উঠছে।
কলেজে গুরুত্বপূর্ণ ডিসার্টেশন এআই বিরোধী সফ্টঅয়্যারের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। ছবি: এআই।
স্কুলের মতো রাজ্যের কলেজগুলির পরিস্থিতি কী রকম? খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, কলেজেও ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ এআই ব্যবহার করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এআই-এর প্রতিরোধে ‘টার্নিটিন’ ব্যবহার করা হয়। ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন (ইউজিসি)-এর নিজস্ব সফ্টঅয়্যার ‘ড্রিল বিট’ রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ‘ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকাডেমিক ইন্টিগ্রিটি প্যানেল’ (ডিএআইপি)। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতি কোনার বললেন, ‘‘স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি স্তরে যাবতীয় ডিসার্টেশন আমরা এআই ডিটেকশন সফ্টঅয়্যারের মাধ্যমে যাচাই করে নিই।’’ পাশাপাশি, দেবজ্যোতি জোর দিতে চাইলেন শিক্ষকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার উপর। তাঁর মতে, সারা বছর যে ছাত্রকে শিক্ষক কাছ থেকে দেখেন, সে অসদুপায় অবলম্বন করলে শিক্ষক নিজেই তা শনাক্ত করতে পারবেন। এ রকম মতও উঠে আসছে, যে ছাত্র ভাল লেখে, সে যদি তার লেখাকে আরও একটু উন্নত করার জন্য এআই ব্যবহার করে, তা হলে তা শিক্ষকের পক্ষে বোঝা যথেষ্ট কষ্টকর।
সম্প্রতি, দেশের একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, দিল্লির উচ্চ শিক্ষার প্রায় অর্ধেক ছাত্রছাত্রী নিয়মিত পড়াশোনার ক্ষেত্রে এআই-এর সাহায্য নিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে ২১ শতাংশ জানিয়েছে, তারা মাসে কয়েক বার এআই ব্যবহার করে এবং ২৩ শতাংশ জানিয়েছে, তারা সপ্তাহে তিন থেকে চার বার এআই ব্যবহার করে। শিক্ষাক্ষেত্রে এআইকে আগামী দিনে রোখা কঠিন হতে চলেছে বলেই মনে করছেন উত্তর কলকাতার ‘দ্য পার্ক ইনসটিটিউশন’-এর ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ডেটা সায়েন্স’-এর শিক্ষক সঞ্জয় ঘোষ। গত বছর থেকে রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিষয়টি পড়ানো শুরু হয়েছে। সঞ্জয় জানালেন, হোমওয়ার্কের ক্ষেত্রে তিনি এআই-এর ব্যবহারকে না চাইলেও মেনে নিয়েছেন। বরং তিনি অন্য যুক্তি দিলেন। সঞ্জয় বললেন, ‘‘আমি হোম অ্যাসাইনমেন্ট প্রিন্ট আউটের পরিবর্তে ছাত্রদের লিখে জমা দিতে বলি। জানি ওরা এআই ব্যবহার করলেও কাগজে লেখার মাধ্যমে ২০ শতাংশ উত্তর মনে থেকে যাবে।’’ এই ভাবে একই বিষয় বার বার ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে লেখানো হলে কিছুটা হলেও সমস্যা মিটতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। আবার এআই-এর ব্যবহারে শিক্ষকেরাও যে ছাত্রছাত্রীদের আরও ভাল ‘কনটেন্ট’ প্রদান করতে পারছেন, সে বিষয়টিও অনেকের নজরে এসেছে।
এআই-এর ব্যবহারের ফলে অদূর ভবিষ্যতে পরীক্ষা বিষয়টিই যে প্রহসনে পরিণত হতে পারে, সে কথাও অনেকে মনে করিয়ে দিতে চাইছেন। একাধিক পরীক্ষা এখন অনলাইনে হয়। ছাত্রেরা এআই ব্যবহার করলে ‘যোগ্য’ এবং ‘অযোগ্য’দের মধ্যে পার্থক্য বোঝাও মুশকিল হতে পারে। তবে শিক্ষকদের একটা বড় অংশ এখনও আশাবাদী। কারণ, পরীক্ষা হল ছাত্রের প্রকৃত মেধা চিনিয়ে দেয়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘এআই-এর ভাল গুণও রয়েছে। কিন্তু খারাপটাই বেশি হচ্ছে বলে ইউরোপের একাধিক দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে এআইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’’
শিক্ষাক্ষেত্রে এআই-এর মোকাবিলায় এখনও কোনও আইন তৈরি হয়নি। ছবি: এআই।
শিক্ষাক্ষেত্রে এআইকে রোখার বিরুদ্ধে সংসদের তরফে এখনও কোনও নিয়ম তৈরি হয়নি। চিরঞ্জীব বললেন, ‘‘২০২৪ সালে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ৪২টি মোবাইল বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এ বারে সংখ্যাটা কমে ৮ হয়েছে। আগামী দিনে আমরা নিরাপত্তা আরও জোরদার করার চেষ্টা করছি।’’ এই প্রসঙ্গেই উঠে আসে রামকৃষ্ণ মিশনের অধীনস্থ বিভিন্ন স্কুলের পরিচালন পদ্ধতির প্রসঙ্গ। এখনও সেখানকার মহারাজেরা মোবাইল এবং এআই-এর কবল থেকে ছাত্রদের দূরে রাখতে পেরেছেন। চিরঞ্জীব বিষয়টিকে সাধুবাদ জানাতে চাইলেও ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন।
তবে এআই যে পড়ুয়াদের শুধুই ক্ষতি করছে, তা মানতে নারাজ অনেকে। কারণ এমন অনেকেই রয়েছে, যারা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার জন্যই মূলত এআইকে ব্যবহার করে। তার ফলে তাদের জ্ঞানের পরিধিও বাড়ে। অবশ্য, এই ধরনের ছাত্র যে সংখ্যায় কম, তা মেনে নিচ্ছেন শিক্ষাকর্মীদের অনেকেই। এর থেকে মুক্তির জন্য ছাত্রদের মধ্যে ‘অনুশোচনা’ বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। অজন্তা বললেন, ‘‘আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি। কয়েক মিনিট মুখ নিচু করে হয়তো সে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু খুব একটা গ্লানিবোধ যে দেখি, তা নয়।’’
ইতিহাস সাক্ষী, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গেই তার একচেটিয়া অপব্যবহারও হয়েছে। এআই তার ব্যতিক্রম নয়। কঠিন সময়ের মধ্যে স্রোতে যিনি গা ভাসাবেন না, তিনিই হয়তো নতুন পথের সূচনা করবেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এআই-এর ব্যবহারও অনেকটা সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। ভবিষ্যতে শিক্ষাঙ্গনে এআই-এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কোনও আইন আসবে কি না, তা এখনই স্পষ্ট নয়। শিক্ষকদের বড় অংশ বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। তেমনই ছাত্রছাত্রীদেরও যত্রতত্র এআই ব্যবহারের ক্ষতিকারক দিকটি বোঝাতে হবে, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করছেন শিক্ষকদের একাংশ।