সন্তানদের মধ্যে তুলনা করলে কী কী প্রভাব পড়তে পারে? ছবি: এআই।
কোন পোশাক পরে কাজে যাবেন? কোন খাবারটি খাবেন? কাকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেবেন? দু’টি বা তার বেশি বিষয় চোখের সামনে এসে পড়লেই সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য খুঁজতে শুরু করে মানুষ। আরম্ভ হয় তুলনামূলক আলোচনা। নিজের সঙ্গে বা অন্যের সঙ্গে। তুলনার মাধ্যমেই একজন স্থির করেন, কে বা কোনটি ভাল বা খারাপ, কোনটি বেশি বা কম, কোনটি উপযোগী বা অপ্রয়োজনীয়, কোন বিষয়ের কী গুণ বা দোষ আছে। অতি স্বাভাবিক মনুষ্য আচরণ বলেই গণ্য করা হয় এটিকে। তাই সব সময়ে এই স্বভাবকে কাঠগড়ায় তোলা হয় না। এ দিকে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই অভ্যাসই কিন্তু বড় ক্ষতির মুখে ফেলে দিতে পারে। বিশেষ করে অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে।
অনেকেই নিজের সন্তানের সঙ্গে অন্যের সন্তানের তুলনা করতে থাকেন সর্ব ক্ষণ। কিন্তু এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যদি সেটি বাড়ির মধ্যে দুই মানুষকে নিয়ে হয়। অর্থাৎ দুই সন্তানের মধ্যে বা তার বেশি সংখ্যক সন্তানের মধ্যে যদি বাবা-মা ক্রমাগত তুলনা করতে থাকেন প্রকাশ্যে, তা হলে তা প্রভাব ফেলে সন্তানদের মনে। প্রত্যেক শিশু তার নিজের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মেছে, নিজের বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছে। কেউ খেলতে ভালবাসে, কেউ পড়তে ভালবাসে, কেউ চঞ্চল বা কেউ শান্ত। তারা যদি নিজেদের মা-বাবার কাছ থেকে শোনে, তাদের পাশের জন তাদের তুলনায় উন্নত, তাতে মানসিক চাপ তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে অন্য সন্তানের মনে হয়, সে যা করছে, সেটিই ঠিক। আত্মবিশ্বাস অতিরিক্ত বেড়ে যায়। পাশাপাশি, সে তার ভাই বা বোনকে সম্মান করতে শেখে না। তাতে আখেরে তারই ক্ষতি।
মনোবিদ এবং অধ্যাপক আত্রেয়ী ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘মানসিক তো বটেই, কিন্তু শারীরিক বৈশিষ্ট্যও একই মায়ের সন্তানদের মধ্যে ভিন্ন হতে পারে। দুই বোন, দুই ভাই বা দুই ভাই-বোনের মধ্যে পার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গায়ের রং, চেহারা, ইত্যাদি গুণাবলি নিয়ে তাঁদের সন্তানদের মধ্যে তুলনা করেন মা-বাবারা। কেবল মা-বাবারা নন, ভারতীয় উপমহাদেশের যে সামাজিক ব্যবস্থা, তাতে দেখা যায়, আত্মীয়েরাও এই তুলনাটা প্রকাশ্যে বিনা দ্বিধায় করতে থাকেন। এর ফলে দুই শিশুর মধ্যেই মানসিক পীড়া তৈরি হতে পারে। আবার দু’জনের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। এটা এক দিনের ঘটনা নয়, বহু কাল ধরে ধীরে ধীরে অপমান সহ্য করতে করতে অবসাদ তৈরি হয় শিশুদের মধ্যে। এটা কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে মারাত্মক পর্যায়েও যেতে পারে।’’
সন্তানদের মধ্যে তুলনা করলে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। ছবি: সংগৃহীত।
তুলনার শিকার হওয়ার ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে শিশুদের মধ্যে?
মানসিক গঠন ও স্বতন্ত্রতা নষ্ট হতে পারে
প্রত্যেক শিশু আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। তাদের গঠন এবং নিজস্বতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তারা আর আত্মবিশ্বাস পায় না। মা-বাবা বা আত্মীয়দের থেকে শুনতে শুনতে তারা ভাবতে শুরু করে, তারা যে বৈশিষ্ট্যে তৈরি, তা খারাপ। শিশুটি মনে করে, সে ততটাও ভাল নয়।
সম্মানহানি হতে পারে
‘‘নিজের ভাই বা বোনের মতো হতে পারোনি!’’ এই ধরনের মন্তব্য শিশুর সম্মানে আঘাত করে। নিজেকে আর মূল্য দিতে পারে না তারা।
গুণাবলির অপচয়
তুলনার কারণে শিশুর ভিতরে ঈর্ষা, হীনম্মন্যতা ও ভয় জন্ম নেয়। এতে তারা নিজের দক্ষতা প্রকাশে পিছিয়ে পড়ে এবং আত্মবিশ্বাস হারায়। ফলে তাদের নিজস্ব গুণাবলি নষ্ট হয়ে যায়।
ভাই-বোনদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট
প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব তৈরি হয় দুই বোন, দুই ভাই বা দুই ভাই-বোনের মধ্যে। একে অপরের প্রতি বিরক্ত হয়। ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠার বদলে বিরোধিতা জন্ম নেয়।
অনুপ্রেরণার অভাব
অভিভাবকের পক্ষপাতিত্ব শিশুর মনে প্রশ্ন তোলে, সে কি অবহেলিত? ফলে তারা কোনও রকম প্রচেষ্টাই বন্ধ করে দেয়। তারা ভাবে, কিছু করেই তো লাভ নেই! তার চেয়ে ভাল, কিছু করার দরকার নেই।