—প্রতীকী ছবি।
ঘ্যানঘেনে বৃষ্টির রবিবার। আগের দিন থেকে অন্বেষা-তন্ময় প্ল্যান করেছিলেন মিত্র ক্যাফেতে মোগলাই খেতে যাবেন। কিন্তু আবহাওয়া দেখে দু’জনেরই মুখ ভার। এই বৃষ্টিতে যাদবপুর থেকে শ্যামবাজার! অসম্ভব!
সমস্যার সমাধান কিন্তু হাতের মুঠোয়! মুশকিল আসান খাবার অর্ডার করার হরেক মোবাইল অ্যাপ। পছন্দের রেস্তোরাঁ বেছে খাবার অর্ডার করে দিলেই হল। বাড়িতে হাজির বিরিয়ানি থেকে চাউমিন, মোমো থেকে লেবানিজ। সুইগি, জোম্যাটো, ফুডপান্ডার মতো অ্যাপের হাত ধরেই বদলে যাচ্ছে কলকাতার খাদ্যপ্রেম।
বদলাচ্ছে— তার কারণ গ্রাহকেরাই যে এই স্বাধীনতা পাচ্ছেন, তা নয়। সুবিধা হচ্ছে খাবার দোকানের মালিকদেরও। অলি-গলির ছোট ফুড জয়েন্টের খাবারও এখন এ সব অ্যাপের দৌলতে পৌঁছে যাচ্ছে এমন এলাকার ঠিকানায়, যেখানকার লোকেরা হয়তো অ্যাপ না থাকলে সেই দোকানের হদিসই জানতেন না! তাদের খোঁজ মেলে কী ভাবে? জোম্যাটোর বিজনেস হেড কৌস্তুভ গুপ্ত জানালেন, ‘‘খাদ্যরসিকদের ব্লগ আমরা নিয়মিত ফলো করি। কোথাও কোনও ভাল খাবার খেলে তাঁরা ব্লগে জানান। তার পর আমাদের টিম সেই দোকানে গিয়ে কথা বলে আমাদের সাইটে সেই দোকানের নাম ঢুকিয়ে দেয়। এর জন্য কোনও টাকাও লাগে না।’’ তবে সুইগি অবশ্য টাকা নেয়।
কালিম্পংয়ের সৌরভ ছেত্রীর দোকান যেমন। ২০০৯ সালে থাক-থাক ডেকচি আর একটা স্টোভ সম্বল করে পেডং থেকে যাদবপুরে এসে বিক্রমগড়ের সরু গলির ভিতরে খুলেছিলেন মোমো-থুকপার দোকান। আশপাশের বাসিন্দা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের মধ্যে খুব অল্প দিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও বাড়ছিল না পরিধি। মুশকিল আসান করে প্রযুক্তিই। জোম্যাটোর ব্লগে অনেক খাদ্যরসিক লিখলেন, ‘‘এ যেন কলকাতায় বসে পাহাড়ের মোমোর স্বাদ!’’ তার পরেই জোম্যাটোর তরফে যোগাযোগ করা হয় সৌরভের সঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘‘সস্তায় ভাল তিব্বতি খাবারের দোকানের তালিকায় আমাদের নাম দেখতে চেয়েছিলেন ক্রেতারা।’’ যোগাযোগ করে সুইগি-ও। তার জেরেই এখন বিক্রমগড়ের গলি ছাড়িয়ে ডানা মেলছেন সৌরভ।
নাকতলায় পিৎজা-র একটি ছোট্ট দোকানও এ ভাবেই অ্যাপের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছেছে বহু বাড়িতে। দোকানের মালিক সুজিত মজুমদার জানালেন, ‘‘সুইগিতে রেজিস্টার করার পরে অর্ডারের ৭০ শতাংশই আসছে অ্যাপ থেকে। বৃষ্টি-বাদলার দিনে দোকান ফাঁকা যেত, এখন তেমন দিনে বরং বেশি অর্ডার আসে।’’ লাভের ৩০ শতাংশ দিতে হয় সুইগিকে। তাতেও তিনি খুশি।
কেবল ক্রেতা বা বিক্রেতার স্বাধীনতাই নয়, শহরের বদলাতে থাকা জীবনযাত্রার ছবিও ধরা পড়ছে এই অ্যাপ-সংস্কৃতিতে। কৌস্তুভ জানাচ্ছেন, শহরের কোন প্রান্তের কোন রেস্তোরাঁয় কত দামের খাবার পাওয়া যাচ্ছে, অ্যাপে তার বিস্তারিত বর্ণনা পেয়ে যান খাদ্যরসিকেরা। তা দেখেই কেউ পছন্দের রেস্তোরাঁয় যান, কেউ বা এই অ্যাপেই সরাসরি অর্ডার দেন বাড়িতে। রেস্তোরাঁর মালিকদের অভিজ্ঞতাও বলছে, এখন তরুণ প্রজন্মের অনেকেই রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়ার চেয়ে বাড়িতে খাবার আনানো বেশি পছন্দ করছেন। যাদবপুরের একটি বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁ ম্যানেজার বিশাল সাহা যেমন বললেন, ‘‘উইক-এন্ডে অনেক রেস্তোরাঁতেই প্রচুর ভিড় থাকে। খিদে পেটে লাইন দিতে অনেকেই বিরক্ত বোধ করেন। তার চেয়ে বাড়িতে বসে খাবার পেয়ে গেলে তাঁরা খুশি হন!’’ তাঁদের রেস্তোরাঁ থেকে হোম ডেলিভারি আগেও হতো। কিন্তু অ্যাপের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পর থেকে অর্ডার, প্যাকিং, ডেলিভারি— পুরো পদ্ধতিটা সহজ ও ঝামেলামুক্ত হয়েছে।
কিন্তু এতে কি প্রভাব পড়বে না রেস্তোরাঁর মূল ব্যবসায়? মানতে চাইলেন না শহরের অন্যতম পুরনো রেস্তোরাঁ মার্কোপোলো-র এগজিকিউটিভ শেফ অমিতাভ চক্রবর্তী। ২৮ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বললেন, ‘‘রেস্তোরাঁ মানে তো শুধু খাওয়াটুকু নয়। সেজেগুজে আসা, পছন্দের টেবিলে বসা, খাবারের ডেকোরেশন, রেস্তোরাঁ কর্মীদের সার্ভিস— সব কিছুই। যাঁরা সেটা চান না বা অসুবিধার কারণে চাইলেও বেরোতে পারেন না, অ্যাপ তাঁদের সাহায্য করছে।’’