Supreme Court

ভারতে সব কন্যাই পেলেন গর্ভপাতের অধিকার, আমেরিকার মেয়েদের লড়াই আর কত দিন?

গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ কি আমেরিকা? কিন্তু সে দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতা কতটা? মেয়েরা এখনও লড়ছেন গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ভারতীয় মেয়েদের অন্তত সেই লড়াইটা শেষ হল!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৪৪
Share:

গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বিবাহিত এবং অবিবাহিত মহিলাদের মধ্যে ফারাক করা ‘অসাংবিধানিক’ বলেও উল্লেখ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। —প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্রের কি মেয়েদের শরীরের উপর নিয়ম চাপিয়ে দেওয়ার কোনও অধিকার রয়েছে? এই প্রশ্ন নিয়ে নারী আন্দোলনকারীরা বহু যুগ ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁরা কখনও জিতছেন, কখনও হারছেন। বৃহস্পতিবার তেমনই এক লড়াই জিতলেন ভারতের মেয়েরা। দেশের শীর্ষ আদালত বলেছে, দেশের সব নারীই নিরাপদে গর্ভপাত করাতে পারবেন। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বিবাহিত এবং অবিবাহিত মহিলাদের মধ্যে ফারাক করা ‘অসাংবিধানিক’ বলেও উল্লেখ করেছে সুপ্রিম কোর্ট।

Advertisement

তবে আমেরিকা এখনও এ বিষয়ে বিভক্ত। গর্ভপাতের অধিকার সে দেশের সব ‘স্টেট’-এ এক রকম নয়। কোথাও গর্ভপাত নিষিদ্ধ, কোথাও নিয়ম খানিকটা শিথিল, কোথাও আবার সম্পূর্ণ ভাবে আইনসিদ্ধ। তা নিয়ে আমেরিকার মাটিতে এবং বিশ্বজুড়েই চলছে দীর্ঘ লড়াই। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও বদল আসেনি সেখানকার আইনে। যে যে ‘স্টেট’-এ গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল, তা এখনও রয়ে গিয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় যদি কোনও মেয়ের প্রাণহানির আশঙ্কাও তৈরি হয়, তা হলেও আমেরিকার কিছু জায়গায় গর্ভপাত করানোর কোনও উপায় নেই। সেখানে দ্বন্দ্বটা মূলত ‘প্রো লাইফ’ আর ‘প্রো চয়েস’-এর মধ্যে। কিন্তু গর্ভপাতের মতো জটিল সিদ্ধান্ত কি শুধু মাত্র এই দুই মেরুর মধ্যে আবদ্ধ?

গর্ভপাত করানোর পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে তৈরি হতে পারে। ধর্ষণ (নাবালিকা এবং প্রাপ্তবয়স্ক দুই ক্ষেত্রেই), বৈবাহিক ধর্ষণ (প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট এই নিয়েও বিবেচনা করেছে), শারীরিক জটিলতা, মা এবং ভ্রূণ দু’জনের প্রাণহানির আশঙ্কা— অনেক ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

Advertisement

দেশের শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছে, ভারতে এখন ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে অবিবাহিত মহিলারাও গর্ভপাত করাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে ২০২১ সালের ‘মেডিক্যাল টার্মিনেশন অব প্রেগন্যান্সি অ্যাক্ট’ সংশোধনের প্রসঙ্গ তুলেছে আদালত। অবিবাহিত মহিলারা অন্তঃসত্ত্বা হলে গর্ভপাত করাতে পারবেন কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। রায় দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা জানিয়েছেন, সময় বদলাচ্ছে। তাই বিবাহিতদেরই শুধু আইনি অধিকার থাকবে, এমন মানসিকতার বদল আনার প্রয়োজন।

পৃথিবীর ‘বৃহত্তম গণতন্ত্র’ হিসাবে ভারতের পরিচিতি থাকলেও অনেকেই আমেরিকাকে ‘উন্নত গণতন্ত্র’ বলে অভিহিত করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে কি আমেরিকাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল ভারত?

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, কোনও দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রথম বিশ্বের দেশ হলেই যে তাদের মানসিকতাও উন্নত হবে, তেমন নয়। আমেরিকাই তার স্পষ্ট উদাহরণ। তাঁর কথায়, ‘‘আমেরিকায় ওই রায় হওয়ার পর খুব হতাশা তৈরি হয়েছিল আমাদের অনেকের মধ্যে। এই আশঙ্কাও তৈরি হয়েছিল যে, কোথাও কি এই আইনের প্রভাব আমাদের দেশের উপরেও পড়বে? একটি দেশ আর্থিক ভাবে প্রথম বিশ্ব হলেই সে যে মানসিকতায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, আইনি ভাবনায় খুব অগ্রগণ্য হবে, পিতৃতান্ত্রিকতার শিকড় তাকে আচ্ছন্ন করবে না— এমনটা যে হলফ করে বলা যায় না, আমেরিকা তারই প্রমাণ দিয়েছে। সেখানে ভারতে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিল, তার অনুবর্তী হওয়ার সময় এসেছে।’’ অনুত্তমার কথায়, ‘‘আমি বলব, আমরা এগোলাম। সেটা উল্লেখযোগ্য। এক, বৈবাহিক ধর্ষণকে মান্যতা দেওয়া হিসাবে। দুই, গর্ভপাত বিষয়ক আইন— দু’টি আইনই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দু’টি আইনের উপরেই পিতৃতান্ত্রিকতার একটা ছায়া ছিল। ভারতে না থাকলেও যে ছায়া অব্যাহত রইল আমেরিকার আকাশে।’’

সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েও একটি প্রশ্ন তুলেছেন সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার। তাঁর প্রশ্ন, এই আধুনিক সমাজে কোনও নারী স্বেচ্ছায় সহবাস করলে কেন তাঁকে লজ্জার মুখে পড়ে গর্ভপাত করাতে হবে? তিলোত্তমার কথায়, ‘‘স্বেচ্ছায় গর্ভবতী হলে সে বিবাহিত না কি অবিবাহিত, সেই বিচার মুছে ফেলার সময় এসেছে। স্বেচ্ছায় সহবাস করলে, নিজের গর্ভস্থ সন্তান রাখতে চাইলে, সেটাকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করা উচিত। আমরা এতটাই এগিয়ে এসেছি, পরিবর্তিত হয়েছে সমাজ, কোনও নারী একক মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে সন্তান মানুষ করতেই পারেন। তা হলে গর্ভস্থ ভ্রূণ নিয়ে এত চিন্তা কেন করতে হবে? তখনই গর্ভপাতের প্রশ্ন আসে, যখন সামাজিক লজ্জা কাজ করে। তাছাড়া অন্য কারণ কাজ করতে পারে। কেউ ধর্ষিত হলে সেটা অপমান। কিন্তু সম্মত হয়ে সহবাস করে কেউ গর্ভবতী হলে তো অপমান নয়। সমাজ এটা কবে গ্রহণ করবে, আমার প্রশ্ন সেটাই।’’

অনুত্তমাও মনে করেন, খাতায়কলমে নয়, এই আইনের প্রভাব পড়তে হবে নাগরিকদের মানসিকতায়। তিনি বলেন, ‘‘ঘনিষ্ঠতা, মাতৃত্ব, যৌনতা— নারীজীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে যেন বিবাহই একমাত্র নির্ধারক। এই প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যকেও কোথাও যেন এই আইন চ্যালেঞ্জ করল। যে মানসিকতার বদল আমরা দেখতে পেলাম অন্তত আইনের প্রেক্ষিতে, আশা রাখব, সে মানসিকতার প্রভাব যেন সমাজের অন্য স্তরেও পড়ে। চিকিৎসকের চেম্বারে যিনি আসবেন গর্ভপাত করাতে, তাঁকেও যেন কলঙ্কের চোখ দিয়ে দেখা না হয়।’’ অনুত্তমার আশা, ‘‘আইনে বদল এলে মানসিকতায় বদলের সম্ভাবনা তৈরি হয়। বৈবাহিক ধর্ষণ আগেও গণ্য হত হেনস্থার অধীনে। কিন্তু ধর্ষণ হিসাবে গণ্য হত না। গার্হস্থ্য হিংসার অংশ হিসাবে সেটি মান্যতা পেয়েছিল। এই রায়ের ফলে বহু নারী তাঁর নিজের শরীরের উপর অধিকার স্থাপনের লড়াইয়ে স্বস্তি পাবেন। দু’টি আইনের ক্ষেত্রেই নারীর মর্যদা সুরক্ষিত হয়েছে। আমি স্বস্তি বোধ করছি।’’

সাহিত্যিক তিলোত্তমা ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কে ‘ধর্ষণ’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি সন্দিগ্ধ, কত জন এই আইনের সুবিধা পাবেন! তাঁর কথায়, ‘‘বিবাহিত জীবনে ধর্ষণ ছিল। আইনসম্মত ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা গেলে অনেক মহিলারই সুবিচার পাওয়ার পথ থাকতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যিনি ধর্ষিত হচ্ছেন, তাঁকে নিপীড়নমূলক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পাশাপাশি, মনে রাখতে হবে যে, শুধু কথা দিয়ে বিচার হয় না। দাম্পত্যে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে নির্যাতন করেন যে স্বামী, তিনি তো সাক্ষী রেখে সেটা করবেন না! আইনের দিক থেকে নিশ্চয়ই এ সবের নিষ্পত্তি হবে।’’ একই প্রশ্ন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অনন্যা চট্টোপাধ্যায়েরও। তাঁর কথায়, ‘‘আইনি স্বীকৃতি থাকলেই যে সমাজ মেনে নিচ্ছে, তা তো নয়। তবে অন্তত আইনের সাহায্য পাওয়া যাবে, এটুকু আশা রাখা যেতে পারে। লড়াই কিন্তু এখনই থামবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন