মুঠোতেই ধরে যেত মিহি মসলিন শাড়ি আর বালুচরিতে নারীদেহপটে শত সহস্র বছরের কাহিনি লুটোপুটি খেত। এই দুটিই বাংলা তাঁতশিল্পের জাদুময় সৃষ্টি। আজ যেখানে জনবহুল জিয়াগঞ্জ (মুর্শিদাবাদ), সেখানেই ছিল শান্ত গ্রাম বালুচর। বাংলার নবাব তখন মুর্শিদকুলি খান। তাঁর রাজধানীর কাছেই গঙ্গাতীরের এই গ্রামে শিল্পসাধনা করতেন গুণী মানুষরা। তাঁরা কর্ণসুবর্ণের রেশমশিল্পীদের উত্তরাধিকারী। প্রায় দুশো বছর আগে এঁরাই বয়নকৌশলে সিল্কের শাড়িতে ফুটিয়ে তোলেন চিত্রের সারি। হাটবারে বালুচরে জমা হতেন রণসাগর, আমডহর, মীরপুর, বাহাদুরপুরের দরজি-কারিগররা। তাঁদের শাড়িতে বোনা থাকত নল-দময়ন্তী, কালীয়দমন, মৈনাক পর্বত, স্যমন্তক মণির পৌরাণিক উপকথা। প্রাপ্তিস্থলের নামে এই ঘরানার শাড়িকে বলা হয় বালুচরি বা বুটিদার বালুচরি।
সৌভাগ্যের প্রতীক
রংবাহারি মখমলি শাড়ির আঁচলে নিপুণ ফোঁড়। তাতে পুরনো দিনের চৈনিক বস্ত্রের আদলে চৌখুপি ফ্রেমে আঁটা সব ছবি। সেই আয়তক্ষেত্রে বসে আছেন স্বয়ং সুবেদার সুজা, রাজনন্দিনী, সাহেব, মেম, হুঁকোবরদার, জাহাজ কাপ্তেন, ঐরাবত, বন্দুকবাজ এমনকী রম্ভা-মেনকা-উর্বশীও। জমকালো বুটিদার এই সব বালুচরি তাঁতি বৌরা পৌঁছে দিতেন অভিজাত অন্দরমহলে। শিল্পীর নাম ছড়ালে তাঁর ডাক পড়ত নবাব হারেমে। বেগমেরও অঙ্গে উঠত শৌখিন বালুচরি। শতক পেরিয়ে ঠাকুরবাড়ির দেরাজেও কদর পেয়েছিল এই শাড়ি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহর্ষিজায়ার অপূর্ব ছবি এঁকেছেন তাঁর লেখনীতে— ‘‘পঙ্খের কাজ করা মেঝে, মেঝেতে কার্পেট পাতা, এক পাশে একটি পিদিম জ্বলছে— বালুচরী শাড়ি পরে সাদা চুলে লাল সিঁদুর টক্টক্ করছে— কর্তাদিদিমা বসে আছেন তক্তপোশে।’’ সেকালের মতো একালেও টকটকে রঙের বালুচরি দেখলে ভেসে আসবেই সম্ভ্রম।
মিশল মুঘল, সময়ের আখ্যান
নবাব মুর্শিদকুলি খান বালুচরি তাঁতিদের অর্থচিন্তা দূর করেন। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে নতুন নতুন নকশা উদ্ভাবন করেছিলেন শিল্পীরা। শাড়িতে এঁকেছেন টেরাকোটা মন্দিরের কারুকৃতি, মিশিয়েছেন নকশিকাঁথার সৌন্দর্য। কাছাকাছি সময়ে দিল্লির দরবারে অরাজকতা চলছিল। তখন একদল মুসলমান চিত্রকর ভাগ্যান্বেষণে রাঢ়বঙ্গে আসেন। আসেন আকবরের সভাশিল্পীদের কয়েক জন বংশজও। এঁদের সকলের প্রভাবে বালুচরিতে এল মুঘল জৌলুস, রাজপুত শৈলী। জটিল মূর্তিগুলি অদ্ভুত কুশলতায় শাড়িতে গাঁথলেন শিল্পী। সে দিনের বালুচরির সূক্ষ্ম কারুকাজ আর জাঁক দেখে চোখ ফেরাতে পারল না বিদেশি বণিকের দল। ওলন্দাজ, দিনেমার, ফরাসি, ইংরেজদের বাণিজ্যপোতে ঠাসাঠাসি করে উঠল রাজকীয় শাড়ির গাঁঠরি। ঔপনিবেশিক যুগের প্রথম লগ্নেই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল বালুচরির গৌরবগাথা।
পুরনো বালুচরির নয়া ব্যবহার
• সজ্জিত পাড় কেটে ব্লাউজ়ের হাতায় বসান।
• পরদা বা সোফা-কুশনের কভার হিসেবে পুরনো বালুচরি। বিয়ের তত্ত্বের ঢাকাতেও বালুচরি লাজবাব।
• ভিন্নধর্মী কলকার অংশগুলি ‘টাই’ বা ‘স্কার্ফ’ করে নিতে পারেন। রাজা চতুর্দশ লুই পর্যন্ত বালুচরির খণ্ড কেটে রুমাল বানানোর অর্ডার দিয়েছিলেন।
• পুরনো বালুচরি মাঝেমাঝে রোদে দিন উল্টেপাল্টে। শাড়ির ভাঁজও পাল্টে দিতে হবে। বছরে এক বার পালিশ করতে দিন।
বদলাতে থাকা সময়ের প্রভাব পড়ল বালুচরির নিজ অঙ্গেও। নীল, লাল, বেগুনি, খয়েরি উজ্জ্বল পটভূমিতে যেখানে সিরাজের বেগম, জমিদারের জলসাঘর বা কৃষ্ণরাধিকা চিত্রিত হত, সেখানে এল স্টিমার, রেলগাড়ির কেঠো ছবি। বাগানে ধূমপায়ী সাহেব, বারান্দার টব, ব্যস্ত জীবনযাত্রা, পানীয়ের সরঞ্জাম, শিকারের ছবি, দেশি পরিচারিকার মোটিফ। এমন সময়েই বালুচরির চারটি ভাগ স্পষ্ট হয়। বুটি, কলকা, পাড় ও চিত্র। চিত্র আঁকা ও কুঞ্জ নকশায় ভরাট বালুচরি নববধূর ভূষণ হিসেবে বেনারসিকেও পাল্লা দিতে শুরু করেছিল। পলাশির যুদ্ধ বা সিপাহি বিদ্রোহ জমানায় শাড়ির জমিতে কামান, পাগলা ঘোড়া। জীবনের সঙ্গে জড়িত হলেও বালুচরির কল্পনা বড়ই রঙিন ও রোম্যান্টিক। অর্থাৎ লার্জার দ্যান লাইফ। তাই বুঝি রমরম করে বিকিয়েছিল শ্যামাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের বাঘে-মানুষের যুদ্ধের নকশা কাটা বালুচরিও।
পুনরুত্থানের দিনগুলি
বালুচরির বুননকৌশল বংশধর ভিন্ন কাউকে শেখাতেন না শিল্পী। তা বুনতে কমপক্ষে ছ’মাস সময় লাগত। সন্তান অন্য পেশায় গেলে উনিশ শতকের শেষে হঠাৎ হারিয়ে যায় বালুচরি শিল্প। ব্রিটিশ রাজদণ্ডের দাপটে অন্য দেশি শিল্পের মতো বালুচরিরও নাভিশ্বাস ওঠে। তখনই শিল্পী দুবরাজ দাসের শাড়ি লন্ডনের বিশ্বমেলায় প্রথম হয়। ফিরে আসে বালুচরি। দুবরাজের স্বাক্ষরিত শাড়ি কিনতে লাইন পড়ে সাগরপারে।
পঞ্চাশের দশকে সুভো (সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর) ঠাকুরের উৎসাহেই বালুচরির আধুনিকীকরণ। মুর্শিদাবাদি জালা তাঁতে এ কাপড় বুনতে যা খরচ, তাতে সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে ছিল। ধুঁকছিলেন শিল্পীরাও। সুভো ঠাকুর বিখ্যাত কারিগর অক্ষয়কুমারকে জ্যাকার্ড লুম-এর ব্যবহার শেখান। তাঁর হাত ধরে মল্লভূম বিষ্ণুপুরে পুনর্জন্ম হয় বালুচরির। বিখ্যাত হয় জ্যামিতিক প্যাটার্ন, কাশী বালুচরি, মধুমালতী, রূপশালি, মীনাকারি, দোআঁচলা ও রামধনু বালুচরি। র্যাম্প থেকে বিয়েবাড়ি— নন্দিনীরা আজও মায়াবিনী এই শাড়িতে।
মডেল: দর্শনা, রিয়া, নয়নিকা; মেকআপ: মৈনাক দাস ; ছবি: সুপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়; শাড়ি: উইভার্স স্টুডিয়ো; শার্ট ও ব্লাউজ়: প্রণয় বৈদ্য; জুয়েলারি: আভামা জুয়েলারি, বরদান মার্কেট; লোকেশন ও ফুড পার্টনার: বংনেজ়, সল্টলেক