প্রকৃতির আজব খেয়াল। তপ্ত মরুদেশ ঢেকে গেল শুভ্র বরফে! সৌদি আরবের ঊষর মরুপ্রান্তরে তুষারপাত। বালির রাজ্যের বেশ কিছু অংশে দেখা গেল অভূতপূর্ব দৃশ্য। উপসাগরীয় দেশটির বেশ কিছু শহরের বাদামি শরীরে পড়েছে সাদার ছোপ।
চারদিক রুক্ষ, শুষ্ক। জ্বলন্ত মরুভূমি এবং প্রচণ্ড তাপ। চরম রিক্ত দেশে তুষারপাতের ফলে রাস্তাঘাট, ভূভাগ যে দিকে চোখ যায় সবটাই সাদা। মরুভূমি বরফের চাদরে ঢেকে যাওয়ার একাধিক ভিডিয়ো সমাজমাধ্যম ছড়িয়ে পড়তেই তা বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটিয়েছে। সেই দৃশ্য দেখে অনেকে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না।
এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকা এ ভাবে বরফে সাদা হয়ে থাকার ছবি সচরাচর দেখা যায় না। স্বাভাবিক ভাবেই মরুভূমির বুকে তুষারপাতে তাই বাড়তি কৌতূহল তৈরি হয়েছে। মরুভূমিতে তুষারপাতের ভিডিয়োগুলি দেখে প্রথমে অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন, এগুলি সত্য নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি। ভিডিয়োগুলি আসল না নকল সেই নিয়ে তরজা শুরু হয়েছে সমাজমাধ্যম জুড়ে।
মরুভূমি, বালির পাহাড়, প্রখর রোদ, অনাবৃষ্টি, সৌদি আরব কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরশাহি মনে পড়লে এ সবই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আরব মরুভূমিতে সারা বছর রাজত্ব করে চরম আবহাওয়াই। গ্রীষ্মকালে তীব্র দহন এবং বৃষ্টিপাতের অভাব স্বাভাবিক। সেই ঊষর মরুতে বিরল তুষারপাত। এই বিরল অবস্থাই মরুভূমিতে তুষারপাতকে এত মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে।
সৌদি কিংবা তার পড়শি দেশ সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে বছরে বৃষ্টিপাত হয় নামমাত্র। শুষ্ক আবহাওয়ার এই দেশে ভারী বর্ষণ দূরস্থান, বৃষ্টিই প্রায় ডুমুরের ফুল। তবে শীতকালে এই দেশে বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টি হয়। সেই ছিটেফোঁটা বৃষ্টি প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য।
উত্তর-পশ্চিম সৌদি আরবের ট্রোজেনা পার্বত্য অঞ্চল এবং তাবুক অঞ্চলের কিছু অংশে এই সপ্তাহে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক ভোলবদলের ঘটনা সামনে এসেছে। সংবাদমাধ্যম ‘সৌদি গেজেটের’ প্রতিবেদন অনুসারে, বুধবার তাবুকের জাবাল আল-লাউজে ভারী তুষারপাত হয়েছে। দোসর ঘন কুয়াশা এবং তীব্র বাতাস।
রাস্তাঘাট ঢেকেছে পুরু বরফে। তপ্ত মরুর বালির বদলে শ্বেতশুভ্র মরুপথে হেঁটে বেড়াচ্ছে ‘মরুভূমির জাহাজ’। ঝোড়ো হাওয়ায় তুষারের কণা ছড়িয়ে পড়েছে বাড়িঘরে। রাস্তায় থাকা গাড়িগুলিতে পড়েছে বরফের পুরু আস্তরণ। এলাকার তাপমাত্রা তীব্র ভাবে হ্রাস পেয়েছে। হিমাঙ্কের ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে নেমে গিয়েছে গিয়েছে পারদ।
স্বাভাবিক ভাবেই মরুভূমির বুকে তুষারপাতে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। হইচই পড়ে গিয়েছে বিশ্ব জুড়ে। মরুভূমিতে তুষারপাত বিরল হলেও নজিরবিহীন নয়। সৌদি আরবের বেশির ভাগ অংশে তীব্র তাপমাত্রা বহাল থাকলেও উত্তর তাবুক অঞ্চলে মাঝেমধ্যে তুষারপাত হয়। এই অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৬০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায় অবস্থান করছে।
সৌদি আরবে তুষারপাতের ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক পরিস্থিতির সংমিশ্রণ। উপরের বাতাস ঠান্ডা, আর্দ্রতার প্রবাহ বৃদ্ধি, বায়ুমণ্ডলীয় চাপের অস্বাভাবিক পরিবর্তন এবং ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রায় পর্যাপ্ত হ্রাস, এই চারটি পরিস্থিতির নিখুঁত সংমিশ্রণ ঘটলে তুষারপাত হয়। এই পরিস্থিতি বিরল। কিন্তু যখন এটি ঘটে, তখন মরুভূমির রূপ সম্পূর্ণ বদলে যায়।
সৌদি আরবে তুষারপাত কেবল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তাবুক অঞ্চলের কিছু অংশে তুষারপাত হয়েছিল। কিছু এলাকায় ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত তুষারপাত হয়েছিল। সেই অপ্রত্যাশিত তুষারপাতের ফলে জনজীবন বেশ কিছু দিন পর্যন্ত ব্যাহত হয়েছিল।
২০২৪ সালের নভেম্বরে আল-নাফুদ মরুভূমিতেও প্রথমবার তুষারপাত প্রত্যক্ষ করেন সৌদিবাসী। এই অঞ্চলটিতে এর আগে কখনও তুষারপাতের ঘটনা ঘটেনি। তুষারপাতের অভিজ্ঞতার আগে ভারী বৃষ্টিপাত এবং শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। ধীরে ধীরে শুষ্ক ভূদৃশ্যকে পাল্টে দেয় বরফের আস্তরণ।
সৌদির উত্তরে রয়েছে আল জফ প্রদেশ। সেখানেও গত বছরের নভেম্বরে মরুপ্রান্তর ঢেকে গিয়েছিল বরফে। শীতের দিনে এখানে তাপমাত্রা হ্রাস পেলেও হিমাঙ্কের নীচে নামেনি ইতিপূর্বে। সেখানেও প্রবল শিলাবৃষ্টির পর পুরু বরফে ছেয়ে গিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা।
সৌদি আরবেও ২০১৬ সালে এক বার তুষারপাত হয়েছিল। সেই সময় প্রবল বৃষ্টির হাত ধরে সৌদির শাকরা এবং তবুলকে বরফের আস্তরণ দেখা গিয়েছিল। আল জফের তাপমাত্রাও পৌঁছেছিল হিমাঙ্কের নীচে। বিশাল বাদামি টিলাগুলিতে সাদা আবরণ। রুক্ষ, শুষ্ক মরুভূমি যেন রাতারাতি সুইৎজ়ারল্যান্ডের চেহারা নিয়েছে।
দেশটির জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্র (এনসিএম) কাসিম এবং রিয়াধের উত্তরাঞ্চলে প্রবল তুষারপাতের সম্ভাবনার পূর্বাভাস দিয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বজ্রঝড়, ভারী বৃষ্টিপাত এবং প্রবল বাতাসের আশঙ্কা করা হচ্ছে ওই সব এলাকায়। তীব্র আবহাওয়ার সময় জনসাধারণকে সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছে প্রশাসন।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে মরু অঞ্চলে তুষারপাত স্বাভাবিক ঘটনা নয়। মরুর দেশে তুষারপাত কোনও ভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। সেখানকার আবহাওয়া দফতর এই বদল নিয়ে চিন্তিত। পরিবেশে এর কী প্রভাব পড়তে পারে বা আগামী দিনে কী হতে চলেছে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন আবহাওয়াবিদেরা।
সাম্প্রতিক কালে আবহাওয়া পুরোপুরি ভোল বদলে ফেলেছে। একই ধরনের ঘটনার স্বাক্ষী থেকেছে সাহারাও। রুক্ষ, শুষ্ক সাহারায় হঠাৎ বরফ পড়া নিয়ে জেগেছে বিস্ময়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ উষ্ণ মরুভূমিতে বিরল ঘটনাটি এক বার নয়, ঘটেছে কয়েক বার। গত ৪০ বছরে তিন বার তুষারপাতের সাক্ষী থেকেছে সাহারা।