টাটা মোটরসের জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে নিযুক্ত হলেন প্রয়াত শিল্পপতি রতন টাটার অসমবয়সি বন্ধু শান্তনু নায়ডু। শান্তনুর বয়স মাত্র ৩২। আর এই কম বয়সেই গুরুদায়িত্ব পেলেন তিনি। মঙ্গলবার সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে নতুন দায়িত্ব পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি নিজেই।
গত বছরের ৯ অক্টোবর ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয় ভারতীয় শিল্পপতি রতন টাটার। দেশের ধনকুবেরদের তালিকার প্রথম দশে ছিল না তাঁর নাম। ‘হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট’ তালিকায় ভারতীয় ধনকুবেরদের মধ্যে ৩৫০ নম্বরে ছিল দেশের অন্যতম সেরা এই শিল্পোদ্যোগীর নাম। সেই তালিকায় বলা হয়েছিল এই পার্সি ধনপতির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকার কাছাকাছি।
তাঁর মৃত্যুর পরে এই বিশাল সম্পত্তি কার হাতে উঠবে তা ইচ্ছাপত্র করে আগে থেকেই ঠিক করে গিয়েছিলেন রতন। সেই ইচ্ছাপত্র কার্যকর করার গুরুদায়িত্বও সঁপেছিলেন খুব ঘনিষ্ঠ কয়েক জনের হাতে।
সেই ইচ্ছাপত্র প্রকাশ্যে আসার পর দেখা যায়, সেখান থেকে বাদ পড়েননি শান্তনু। শান্তনুর স্টার্টআপ সংস্থা ‘গুডফেলোজ়’-এ অংশীদার ছিলেন রতন টাটার। সেই অংশ যেমন ছেড়ে দিয়েছিলেন, তেমনই শান্তনুর বিদেশে পড়তে যাওয়ার খরচের পুরোটাই রতন টাটা নিজের সম্পত্তি থেকে দিয়ে গিয়েছিলেন।
সেই শান্তনুকেই এ বার টাটা মোটরসের জেনারেল ম্যানেজার তথা ‘হেড অফ স্ট্র্যাটেজিক ইনিশিয়েটিভ্স’ হিসাবে নিযুক্ত করা হল। মঙ্গলবার লিঙ্কড্ইনে ন্যানো গাড়ির সঙ্গে নিজের ছবি পোস্ট করে শান্তনু লেখেন, ‘‘অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, টাটা মোটরসের জেনারেল ম্যানেজার, হেড অফ স্ট্র্যাটেজিক ইনিশিয়েটিভ্স’ হিসাবে নিযুক্ত হয়েছি আমি।’’
কিন্তু কে এই শান্তনু? টাটা গোষ্ঠীর এক সময়ের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর আলাপ কী ভাবে? এমন অসমবয়সি দু’জন হঠাৎ প্রিয় বন্ধুই বা হয়ে উঠলেন কী ভাবে? রতন টাটার সঙ্গে শান্তনুর বন্ধুত্ব শুরু হয় দু’জনের পশুপ্রেম থেকে। নিরাশ্রয়, ক্ষুধার্ত, সামাজিক দুর্ব্যবহারের শিকার কুকুর-বিড়ালদের প্রতি সহমর্মিতাই শিল্পপতি এবং শান্তনুকে কাছাকাছি এনেছিল।
পুণের বাসিন্দা শান্তনু এক জন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পুণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পড়াশোনা। টাটাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের পুরনো জানাশোনা থাকলেও শান্তনুর পরিবারের কেউ কখনও রতন টাটার সঙ্গে সরাসরি কাজ করেননি।
শান্তনু টাটা এলেক্সিতে কাজ শুরু করেন এক জন জুনিয়র ডিজ়াইনার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। সেই সময় টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান ছিলেন রতন টাটা। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব তো দূর অস্ত্, নজরে পড়াও দিবাস্বপ্ন ছিল তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে। তবে সুযোগ তৈরি হয়।
সংস্থার জুনিয়র কর্মী ছিলেন শান্তনু। রাতের ডিউটিই থাকত বেশি। সদ্য স্নাতক হয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়া ছেলেটি কাজের ফাঁকে রাস্তার কুকুরদের দেখভাল করতেন। সেই সময়েই শান্তনু খেয়াল করেন তাঁর অফিসচত্বরে প্রায়ই কিছু কুকুর গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়। ঘটনাগুলি ঘটে মূলত রাতের দিকেই।
পশুপ্রেমী জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ঠিক করেন এর সমাধান করবেন। প্রথমে পথচলতি গাড়ির চালকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন শান্তনু। জানা যায়, রাতে গাড়ি চালানোর সময় কুকুরগুলিকে চট করে দেখতেই পান না চালকেরা। ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে।
সমস্যার কারণ জানা যায়। কিন্তু সমাধান? শান্তনু ঠিক করেন রাস্তার কুকুরদের আলো জ্বলতে থাকা কলার পরানো হবে। যাতে রাতের অন্ধকারেও তাদের দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কলার বানাবে কে? কেই বা পরাবে? অফিসের কাজ সামলে একার পক্ষে এত কাজ করা সম্ভব নয়। তবে এই সমস্যারও সমাধান বার করে ফেলেন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। রাস্তার কুকুরদের দেখভালের জন্য সমমনস্কদের নিয়ে তৈরি করে ফেললেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘মোটোপজ়’। এই ‘মোটোপজ়’-ই জীবন বদলে দেয় শান্তনুর।
সংস্থা তৈরি হলেও টাকা ছিল না। কলার যে বানানো হবে তার জিনিস আসবে কোথা থেকে! বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেঁড়া জিন্স জোগাড় করে আনেন শান্তনুরা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তাতে জোড়া হয় অন্ধকারে জ্বলে এমন কাপড়। তৈরি হয় কলার। শান্তনুদের এই উদ্যোগ পুণের টাটা এলেক্সি কর্তৃপক্ষের নজর কাড়ে। সংস্থার নিউজ়লেটারে জায়গা করে নেয় ঘটনাটি। নজরে পড়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান রতন টাটারও।
রতন নিজেও পশুপ্রেমী। তাঁর সংস্থার এক কর্মীর এমন উদ্যোগের কথা জেনে রতন নিজেই যোগাযোগ করেন শান্তনুর সঙ্গে। তাঁদের কাজকর্মের বিশদ জানাতে বলেন। সেই শুরু। শান্তনুর সঙ্গে দেখা হয় রতন টাটার। তাঁদের সংস্থাকে অর্থসাহায্য করেছিলেন শিল্পপতি। তবে টাটা গোষ্ঠীর তরফে নয়। শান্তনুদের তিনি সাহায্য করেছিলেন ব্যক্তিগত ভাবে। সম্পূর্ণ নিজের অর্থ থেকে।
এর পরে ইমেলে প্রায়শই কথা হতে থাকে দু’জনের। প্রথমে তাঁদের সংস্থার কাজ নিয়ে, পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিষয়ে ভাবনাচিন্তা বিনিময়, এমনকি একটা সময়ে ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্নোত্তরের পর্যায়েও পৌঁছে যায় কথাবার্তা।
তবে এর পর কিছু দিনের টাটার সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয় শান্তনুর। মনের দূরত্ব নয়, ভৌগোলিক দূরত্ব। চাকরি ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পুণে থেকে আমেরিকায় পাড়ি দেন শান্তনু। ভর্তি হন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘটনাচক্রে রতন টাটাও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
আমেরিকা যাওয়ার পরেও দুই বন্ধুর যোগাযোগে ছেদ পড়েনি। শান্তনুর গ্র্যাজুয়েশনের শেষ দিন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন রতন। সে দিনই শান্তনুকে তাঁর সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন। রতন টাটার ব্যক্তিগত বিজ়নেস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ শুরু করেন শান্তনু। গাঢ় হতে থাকে দুই অসমবয়সির বন্ধুত্ব। রতন টাটা এবং শান্তনুর বন্ধুত্ব ১০ বছরের। ২০১৪ সালে প্রথম দেখা হয়েছিল দু’জনের। শেষ কয়েক বছর রতন টাটার ছায়াসঙ্গী হিসাবেই ছিলেন শান্তনু।
রতন টাটার সঙ্গে তাঁর কাজটা ঠিক কী রকম ছিল? রতনকে অফিসের কাজে নিয়মিত সাহায্য করতেন শান্তনু। আবার ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রামের কোথায় কোন হ্যাশট্যাগ দিতে হবে, কোন ইমোজির মানে কী, এ সব ব্যাপারেও বন্ধুকে চোস্ত করে তুলতেন সময় পেলেই। মধ্য আশির শিল্পপতির ইনস্টাগ্রাম অনুরাগীর সংখ্যা যে আকাশ ছুঁয়েছিল, মনে করা হয় তা সেই প্রশিক্ষণের দৌলতেই। বন্ধুর উৎসাহে রতন নিজেও নিয়মিত ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করতেন।
রতনের যে বিষয়টি শান্তনুকে বিস্মিত করত, তা হল তাঁর লক্ষ্যে স্থির থাকা। শান্তনুর কথায়, ‘‘উনি টানা কাজ করে যেতে পারেন। নন-স্টপ। নো ব্রেক।’’
জানা যায়, রতনকে নতুন স্টার্টআপ সংস্থার ব্যাপারে নিত্যনতুন ধারণাও দিতেন শান্তনু। সেই সব ভাবনার বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগও করেন রতন। এমনকি টাটা গোষ্ঠী কোন কোন নতুন ক্ষেত্রে নিজেদের ডানা মেলতে পারে সে ব্যাপারেও রতনকে নিয়মিত তত্ত্বতালাশ দিতেন তাঁর বন্ধু তথা সহকারী শান্তনু। এর পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর নিজের ভাবনাচিন্তাগুলোকে রূপ দেওয়ার কাজও।
মোটোপজ়ের মতোই আরও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে শান্তনুর। সেই প্রচেষ্টার নামই ‘গুডফেলোজ়’। তাঁর আর রতনের মতোই বয়স্কদের সঙ্গে সমমনস্ক কমবয়সিদের জোড়ার ভাবনা। যাতে দু’পক্ষই ভাল থাকেন। একে অপরের সংস্পর্শে সমৃদ্ধ হন।
যেমন সমৃদ্ধ হতেন টাটা গোষ্ঠীর প্রাক্তন চেয়ারম্যান রতনও। শান্তনু সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের একই বিষয়ে আগ্রহ ছিল। সেই থেকেই আলাপ। তবে শান্তনুর যে বিষয়টা আমার ভাল লাগে তা হল ওর সজীবতা। সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে ওর উদ্বেগ। স্বজাতিকে টেনে নামানোর পৃথিবীতে এমন ভাবনাচিন্তা আজকাল খুব কমই দেখা যায়।’’
রতনকে নিয়ে ইতিমধ্যে একটি বইও লিখে ফেলেছেন শান্তনু। বইয়ের নাম ‘আই কেম আপন আ লাইটহাউস’। বন্ধু রতনের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন মুহূর্তের কথা, তাঁদের দু’জনের বন্ধুত্বের কথা শান্তনু লিখেছেন সেই বইয়ে। তবে বই না বলে ডায়েরি বলাই ভাল। শান্তনু জানিয়েছেন, রতনের সঙ্গে কাটানো তাঁর মুহূর্তগুলি তাঁর মা তাঁকে একটি ডায়েরিতে লিখে রাখতে বলেছিলেন। তবে বন্ধুত্ব যত বেড়েছে সংখ্যা বেড়েছে ডায়েরির। তাঁর বই সেই ডায়েরির পাতা থেকেই সটান তুলে আনা।
বয়সের ফারাক অনেকটাই। তবে শান্তনু আর রতন সেই ফারাক অনায়াসে কাটিয়ে উঠেছিলেন। কাজের সূত্রে একসঙ্গে সময় কাটাতেন তাঁরা। তবে মাঝেমধ্যেই তাঁদের আড্ডা চলত কাজের বাইরেও। একসঙ্গে সিনেমা দেখতেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের চিন্তাভাবনার সহজ বিনিময় করতেন দু’জনে। বন্ধুত্ব যে কোনও বেড়া মানে না, বয়স বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা যে সেখানে কোনও ভাবেই বিচার্য নয়, তার প্রমাণ শান্তনু আর রতন।
শান্তনু প্রথম নজরে আসেন রতন টাটার জন্মদিনে। ২০২১ সালে ভারতীয় শিল্পপতির জন্মদিন পালনের ভিডিয়ো হুড়োহুড়ি করে দেখছিলেন নেটাগরিকেরা। রতন টাটার সেই জন্মদিনে কোনও দোতলা বা চার তলা কেক কাটা হয়নি। উপস্থিত ছিলেন না কোনও তারকা অতিথি।
রতনের সেই জন্মদিন পালন করা হয়েছিল ছোট্ট একটি কাপ কেকের উপর একটি মাত্র বাতি জ্বালিয়ে। পাশে শুধু এক ছিপছিপে তরুণ। তাঁর মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল। অনায়াসে স্কুলের ছাত্র বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। জন্মদিনের আয়োজক থেকে অতিথি একমাত্র তিনিই। তিনিই শান্তনু। রতন টাটার প্রিয় বন্ধু।
সেই বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে গত ৯ অক্টোবর। বয়সজনিত সমস্যা নিয়ে মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন রতন টাটা। তাঁর মৃত্যু হয়। দেশের অন্যতম শিল্পপতিকে হারায় ভারত। আর শান্তনু হারান তাঁর ‘বাতিঘর’।
রতনের হাসপাতালে ভর্তি থেকে শেষকৃত্য, সর্বত্র দেখা গিয়েছিল শান্তনুকে। দুই অসমবয়সির বন্ধুত্ব নিয়ে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। রতন টাটার সেই বন্ধু এ বার পেলেন টাটা মোটরসের গুরুদায়িত্ব।