প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক— দিন, তারিখ, মাস, বছরের হিসাব রাখার জন্য ভরসা ক্যালেন্ডারই। বদল এসেছে শুধু প্রযুক্তিতে। কাগজের ক্যালেন্ডারকে সরিয়ে এসেছে আধুনিক ডিজিটাল ক্যালেন্ডার।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই দিন, তারিখ, মাস, বছরের হিসাব রাখতে ১৫৮২ সালে প্রবর্তিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মানুষ বর্তমানে ২০২৫ সালের শেষের দিকে বাস করছে।
তবে পৃথিবীতে এমন একটি দেশ রয়েছে, যারা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে না। অনুসরণ করে অন্য একটি ক্যালেন্ডার। যে ক্যালেন্ডারে বছর হয় ১৩ মাসে।
দেশটির নাম ইথিয়োপিয়া। পূর্ব আফ্রিকার দেশটি এই সবে ২০১৮ সালে প্রবেশ করেছে। সেখানে চলছে নববর্ষ উদ্যাপন।
বহুল ব্যবহৃত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বিপরীতে, ইথিয়োপিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয় ইথিয়োপিয়ায়। সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৩ মাসে বছর হওয়ায় দেশটি বিশ্বের বাকি অংশের থেকে সাত থেকে আট বছর পিছিয়ে।
কিন্তু কেন এমন রীতি? সাত বছরের ব্যবধানের মূল কারণ হল ইথিয়োপিয়ায় যিশু খ্রিস্টের জন্ম বছর ভিন্ন ভাবে গণনা করা। ৫০০ খ্রিস্টাব্দে ক্যাথলিক গির্জা যখন গণনা সংশোধন করে, তখন ইথিয়োপীয় গির্জা তা করেনি। রোমান গির্জা তার ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করে গ্রেগরিয়ান পদ্ধতিতে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
যদিও ইথিয়োপিয়া কখনওই এই পরিবর্তন গ্রহণ করেনি। প্রাচীন ক্যালেন্ডার ব্যবস্থার প্রতিই অনুগত থেকে গিয়েছিল তারা।
ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রথম ১২ মাসে ৩০ দিন করে থাকে। ১৩তম মাস, যাকে ‘প্যাগুমে’ বলা হয়, সেই মাসে থাকে ৫ দিন। লিপ ইয়ারে ৬ দিন।
এই অতিরিক্ত মাসের কারণে, ইথিয়োপিয়াকে ‘১৩ মাস সূর্যালোকের দেশ’ বলা হয়।
ইথিয়োপিয়ার বাসিন্দারা তাদের নববর্ষ পালন করে ১১ সেপ্টেম্বর। লিপ ইয়ারে উদ্যাপনের দিন হয় ১২ সেপ্টেম্বর। অন্য দিকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, নতুন বছর শুরু হয় ১ জানুয়ারি থেকে।
বিশ্বের বাকি দেশগুলি যেখানে ২০০০ সালে নতুন সহস্রাব্দ উদ্যাপন করেছিল, ইথিওপিয়া ২০০০ সালে প্রবেশ করে ২০০৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী)।
ইথিয়োপিয়ার মানুষেরা নববর্ষকে বলে ‘এনকুটাতাশ’। আদে আবাবা ফুল, আনন্দ নৃত্য, ঐতিহ্যবাহী আবেবায়েহোশ গান এবং পরিবার পরিজনদের নিয়ে ‘এনকুটাতাশ’ উদ্যাপন করেন ইথিয়োপিয়ার মানুষ।
আদে আবাবা এক ধরনের হলুদ ফুল। ইথিয়োপিয়ার মানুষের কাছে এই ফুল আশা এবং পুনর্জন্মের প্রতীক। উপহার হিসাবে এই ফুল প্রিয়জনদের দেন ইথিয়োপিয়ানরা। ঘরবাড়ি এবং গির্জা সাজাতেও ব্যবহৃত হয় ফুলটি।
আবেবায়েহোশ গান হল ইথিয়োপিয়ার ঐতিহ্যবাহী গান। সাদা পোশাক পরে ইথিয়োপিয়ান তরুণীরা দল বেধে নববর্ষের দিন ঘরে ঘরে গিয়ে এই গান পরিবেশন করেন।
নববর্ষের ভূরিভোজে যে খানাপিনার আয়োজন করা হয়, তার মধ্যে থাকে ভেড়া, মুরগি থেকে শুরু করে ডোরো ওয়াট এবং ইনজেরার মতো ইথিয়োপিয়ার জনপ্রিয় খাবারগুলি। নববর্ষের সন্ধ্যাবেলা ইথিয়োপিয়ার মানুষেরা উদ্যাপন করেন নেচে নেচে।
উল্লেখ্য, ভিন্ন ক্যালেন্ডার ব্যবহারের কারণে ইথিয়োপিয়ায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিন এবং উৎসব এমন তারিখে পালিত হয় যা বাকি দেশগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ক্যালেন্ডারের পার্থক্য সত্ত্বেও ইথিয়োপিয়ার মানুষদের বহির্বিশ্বে বেরোতে কোনও অসুবিধা হয় না। কারণ, তাঁরা দুই রকম ক্যালেন্ডারের সঙ্গেই মানিয়ে নিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ভ্রমণের ক্ষেত্রে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারেরই হিসাব রাখেন ইথিয়োপিয়ার নাগরিকেরা। তবে স্থানীয় ইথিয়োপিয়ান ক্যালেন্ডার সে দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জাতীয় পরিচয়ের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে থেকে গিয়েছে।