অরুণাচলের একটি ছোট গ্রাম, নাম ‘জ়িরো ভ্যালি’। সেখানে আজও নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া আপাতানি গোষ্ঠী। একসময় এই গোষ্ঠীর মেয়েদের ১০ বছর বয়স হলেই মুখে আঁকা হত উল্কি। নাকছাবির বদলে নাকে পরতে হত কাঠ।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৪৩৮ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত জ়িরো ভ্যালি। চারপাশে সবুজ পাইনগাছে ঘেরা পাহাড় আর নীচে ধানের খেত। প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই সেখানে মানুষের জীবন।
প্রায় ২৬ প্রকারের জনজাতির বসবাস অরুণাচলে। তাঁদের প্রত্যেকেরই ভাষা এবং জীবনশৈলী আলাদা আলাদা। এরই মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত উপজাতি আপাতানি গোষ্ঠী। এঁরা প্রায় দু’হাজার বছর আগে থেকে ‘জ়িরো ভ্যালি’তে বসবাস করছেন।
একটি প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, আপাতানি গোষ্ঠীর মানুষেরা দাবি করে এটিই তাঁদের আদি ভূমি। তাঁরা মূলত পুজো করেন প্রকৃতিকে। সূর্য, চাঁদ, গাছপালাকেই দেবতা হিসাবে মানেন। খ্রিস্টান, ইসলাম, বৌদ্ধ বা হিন্দুর মতো কোনও ধর্মেই বিশ্বাসী নন এই গোষ্ঠীর মানুষেরা।
আড়ম্বরহীন জীবনযাপনেই অভ্যস্ত আপাতানি গোষ্ঠীর মানুষেরা। খুবই সাধারণ খাবার খান তাঁরা, জামাকাপড়েও কোনও চাকচিক্যের ছোঁয়া নেই। তবে এই গোষ্ঠীর মূল বৈশিষ্ট্যের সন্ধান মেলে মহিলাদের মধ্যে।
এই গোষ্ঠীর মহিলাদের সকলেরই ছিদ্রযুক্ত নাক। নাকছাবির আদলে তৈরি করা কালো গোল বড় বড় কাঠের অলঙ্কার পরিয়ে দেওয়া হত নাকে। স্থানীয় ভাষায় এই নাকছাবিকে ‘ইয়াপিং’ বলা হয়।
জানা যায়, মহিলাদের সৌন্দর্য খর্ব করার জন্যই এমন প্রথা শুরু করা হয়েছিল। কারণ, এই উপজাতির মহিলাদের সৌন্দর্য আশপাশের উপত্যকাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল। তাই বেশির ভাগ সময়ই অন্য উপজাতির পুরুষেরা মহিলাদের অপহরণ করে নিত এবং তাঁদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করত।
সে জন্যই আপাতানি গোষ্ঠীর পুরুষেরা সিদ্ধান্ত নেন, মেয়েদের ১০ বছর বয়স হয়ে গেলেই তাঁদের সাৌন্দর্য নষ্ট করে দিতে হবে। তার পরই চালু হয় মুখে উল্কি আঁকা এবং নাকে বড় কাঠের অলঙ্কার পরানো।
কপাল থেকে নাক বরাবর উল্কি আঁকা হত। শূকরের চর্বি এবং আগুনের কালো ধোঁয়া মিশিয়ে তৈরি করা হত উল্কির রং। তারপর সেটি ধারালো বাঁশের কাঠি বা মাছের কাঁটা দিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে মুখে খোদাই করে দেওয়া হত। যে দাগ আজীবন থেকে যেত মহিলাদের মুখে।
কাঠ আগুনে পুড়িয়ে প্রথমে জীবাণুমুক্ত করা হত। আগুনে পোড়ানোর সময়ই কাঠের রং পরিবর্তিত হয়ে কালো হয়ে যেত। তারপর সেটিকে গোল গোল আকৃতি দেওয়া হত। শেষে মহিলার নাকের দুই পাশই ফুটো করে ওটি অলঙ্কারের মতো করে পরিয়ে দেওয়া হত।
উল্কি এবং নাকের অলঙ্কারের ফলে মহিলাদের রূপে বিপুল পরিবর্তন চলে আসত। একেবারে ভয়ঙ্কর দেখতে লাগত তাঁদের। এর ফলে অপহরণের ভয় থেকে মুক্ত হয়েছিলেন আপাতানি উপজাতির মহিলারা।
যদিও এই প্রথা বেশি দিন প্রচলিত ছিল না। ১৯৭০ সালের দিকে এই গোষ্ঠীর উপর নজর পড়ে খ্রিস্টান মিশনারিদের। দক্ষিণ ভারত ও অসমের দিকের খ্রিস্টান মিশনারিরা আপাতানি উপজাতিকে নিজেদের কবলে আনার চেষ্টা শুরু করেন।
মূল উদ্দেশ্য ছিল ওই উপজাতিদের সভ্য ও আধুনিক ধর্মে দীক্ষিত করা। তাঁরা স্কুল, হাসপাতাল তৈরি করতে শুরু করে সেখানে। ভাল পড়াশোনা, উন্নত সমাজের কথা বলে আপাতানি গোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষকে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।
সেই সময় বেশির ভাগ মানুষই মিশনারিদের কথার জালে পা দিয়ে দেন। কিন্তু তবুও অনেকেই এমন ছিলেন যাঁরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মরিয়া ছিলেন। প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিকাজ, বাঁশ, বেত এবং কাঠের তৈরি ঘরের অভ্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসেননি অনেকেই।
এখন জ়িরো ভ্যালিতে গেলে দেখা যাবে বড় বড় বাড়ি, উন্নত স্কুল, হাসপাতাল। কিন্তু এই সবের মধ্যেও বেশ কিছু বাড়ি আজও কাঠের। সেগুলি চেনার উপায়, আপাতানি গোষ্ঠীর পতাকা।
প্রতিটি বাড়ির উপরই সাদা রঙের পতাকা উড়ছে, যেখানে তাঁদের দেবতা চাঁদ ও সূর্যের নাম লেখা রয়েছে স্থানীয় ভাষায়। এখন আর মেয়েদের সৌন্দর্য খর্ব করা হয় না। সেখানে গেলে, মাত্র জনা কুড়ি প্রবীণ মহিলাকে দেখা যাবে যাঁদের মুখে উল্কি এবং নাকে কাঠের অলঙ্কার রয়েছে।