Origin of Coca Cola

তরবারির খোঁচা থেকে জন্ম, মিশে আছে গৃহযুদ্ধের ক্ষত! কী ভাবে ‘কোলা ওয়াইন’ হয়ে উঠল কোকা কোলা?

দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় ঠান্ডা পানীয় কোকা কোলা। মার্কিন গৃহযুদ্ধে গুরুতর আহত এক সাবেক মার্কিন সৈনিকের হাত ধরে জন্ম তার। কিন্তু কী ভাবে?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৩২
Share:
০১ ১৯

বসন্তের শেষে দুয়ারে কড়া নাড়ছে বৈশাখ। গ্রীষ্মের দাবদাহ অবশ্য এখনও শুরু হয়নি। তবে চড়তে শুরু করেছে তাপমাত্রার পারদ। ফলে হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে কাজে যাওয়া আমজনতার গলদঘর্ম দশা। গরম বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেদার বিক্রি হচ্ছে ঠান্ডা পানীয়। সেগুলির এক একটির জন্মের ইতিহাস চমকে দেওয়ার মতো। প্রতিযোগিতার বাজারে ঠান্ডা পানীয়গুলির নিজেদের মধ্যে যুদ্ধও কম উত্তেজক নয়।

০২ ১৯

এই যেমন কোকা কোলা। ঠান্ডা পানীয় প্রেমীদের কাছে এর পরিচিতি কোক নামে। এর আবিষ্কর্তা ছিলেন জন স্টিথ পেম্বারটন নামের কর্নেল পদমর্যাদার এক মার্কিন সেনা অফিসার। লড়াইয়ের ময়দান থেকে জন্ম হয় কোকের। সেটা ছিল ১৮৬৫ সালের এপ্রিল মাস। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে বুকে তরবারির আঘাত পেয়ে মারাত্মক ভাবে জখম হন পেম্বারটন। ফলে বেশ কিছু দিন হাসপাতালে থাকতে হয় তাঁকে।

Advertisement
০৩ ১৯

একটা সময় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান জন। তাঁর বুকের ঘা তখনও শুকোয়নি। সেটা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় তাঁকে। ফলে ঘরে ফিরেও শান্তি ছিল না পেম্বারটনের। অসহ্য যন্ত্রণায় বিছানায় শুয়ে ছটফট করতেন তিনি। আর খুঁজতেন ব্যথা কমানোর নানা উপায়।

০৪ ১৯

জন ছিলেন পেশায় এক জন ড্রাগিস্ট এবং চিকিৎসক। ফলে রসায়নের বিভিন্ন বিষয় ছিল তাঁর নখদর্পণে। শুধু তা-ই নয়, বাড়িতে একটি ছোটখাটো গবেষণাগারও তৈরি করেন তিনি। সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিক সামগ্রী নিয়ে রাতদিন করতেন নাড়াঘাঁটা। করতেন নতুন ওষুধ তৈরির পরীক্ষা। কিন্তু যুদ্ধের ফলে শিকেয় ওঠে সে সব কাজ।

০৫ ১৯

শেষে এক দিন আর ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মরফিন নিতে শুরু করেন জন। কিছু দিন পর ব্যথার উপশম হল বটে, কিন্তু মাদকটিতে আসক্ত হয়ে পড়লেন তিনি। কিছুতেই সেই নেশা ছাড়তে পারছেন না দেখে একরকম মরিয়া হয়ে ওঠেন পেম্বারটন। নিজের গবেষণাগারে মরফিনমুক্ত অথচ তার মতো কার্যকারী একটি পানীয় তৈরিতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েন এই সাবেক মার্কিন সেনা অফিসার।

০৬ ১৯

প্রায় দু’দশকের চেষ্টার পর এই কাজে সাফল্য পান পেম্বারটন। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনই একটি পানীয় তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। সাবেক মার্কিন কর্নেল এর নাম রাখেন ‘কোলা ওয়াইন’। পানীয়টির জন্মের সালটি ছিল ১৮৮৬। প্রথম দিকে জন নিজেই এর গুণাগুণ প্রচার করতেন। শুধু তা-ই নয়, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে ডেকে এনে পানীয়টি খাওয়াতেনও তিনি।

০৭ ১৯

মূলত দু’টি উপাদানের সাহায্যে ‘কোলা ওয়াইন’ তৈরি করেন জন। সেগুলি হল, কোকা পাতা এবং কোলা বাদাম। দ্বিতীয়টিতে মেলে ক্যাফিনের নির্যাস। নতুন পানীয় তৈরির পর আমেরিকার জর্জিয়ায় নিজের ওষুধের দোকান ‘পেম্বারটন ইগল ড্রাগ অ্যান্ড কেমিক্যাল হাউস’-এ সেটিকে নথিভুক্ত করেন ওই প্রাক্তন সেনা অফিসার। পাশাপাশি, পানীয়টির সেবনে স্নায়ুর উত্তেজনা কমবে বলে প্রচার চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।

০৮ ১৯

জর্জিয়ার ওষুধের দোকানে সদ্য আবিষ্কৃত পানীয়টির অবশ্য নাম ছিল ‘পেম্বারটন ফ্রেঞ্চ ওয়াইন কোকা’। উল্লেখ্য, ১৮৬০ কর্সিকাবাসী ফরাসি রসায়নবিদ অ্যাঞ্জেলো মারিয়ানি কোকা ওয়াইন নামে একটি ওষুধ তৈরি করেন। পেম্বারটন তাঁর দ্বারা প্রবল ভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন বলে ইতিহাসবিদদের অনেকেই যুক্তি দিয়েছেন।

০৯ ১৯

১৯ শতকের ওই সময় আমেরিকার জর্জিয়ার আটলান্টা শহরে আইন করে নিষিদ্ধ হয় মদ। ফলে ব্যবসার সুযোগ পেয়ে যান পেম্বারটন। কারণ, ‘কোলা ওয়াইন’-এর স্বত্ব করিয়েছিলেন তিনি। ফলে ওষুধ হিসাবে ঠান্ডা পানীয়টি বিক্রি করতে থাকেন তিনি। ওই সময় এর দাম ছিল গ্লাস প্রতি পাঁচ সেন্ট।

১০ ১৯

১৮৮৬ সালের ৮ মে প্রথম বার বিক্রি হয় ‘কোলা ওয়াইন’। অল্প দিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় এই ঠান্ডা পানীয়। আমেরিকাবাসী ‘কোলা ওয়াইন’কে স্বাস্থ্যের জন্য ভাল বলে বিশ্বাস করতেন। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে এর বিক্রি। আর রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠেন সাবেক সৈনিক পেম্বারটন।

১১ ১৯

‘কোলা ওয়াইন’-এর জন্মদাতার দাবি ছিল, এটি অনেক রোগের প্রতিকার করে। তিনি দাবি করেন, পানীয়টির নিয়মিত সেবনে দূর হবে মরফিনের আসক্তি, বদহজম, স্নায়বিক দুর্বলতা, মাথাব্যথার মতো শারীরিক সমস্যা। ১৮৮৬ সালের ২৯ মে আটলান্টা জার্নালে ‘কোলা ওয়াইন’-এর প্রথম বিজ্ঞাপন দেন তিনি।

১২ ১৯

তবে এ-হেন ঠান্ডা পানীয়ের ‘বেস্ট সেলার’ হয়ে ওঠার পিছনে হাত ছিল আর এক রসায়নবিদ আসা গ্রিগস ক্যান্ডলার সিনিয়রের। ১৮৮৮ সালে জন পেম্বারটনের থেকে মাত্র ২৩৮.৯৮ ডলারে ‘কোলা ওয়াইন’-এর ফর্মুলা কিনে নেন তিনি। দেশ জুড়ে পানীয়টিকে বিক্রি করতে ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি সংস্থা। নাম দেন ‘দ্য কোকা কোলা কোম্পানি’। এর সদর দফতরটি সেই সময় থেকেই রয়েছে আমেরিকার জর্জিয়ায়।

১৩ ১৯

পেম্বারটন যার নাম দিয়েছিলেন ‘কোলা ওয়াইন’, এ বার সেটাই হয়ে ওঠে কোকা কোলা। তবে নিজে রসায়নবিদ হওয়ায় কোমল পানীয়টির স্বাদ সামান্য অদলবদল করেন আসা গ্রিগস। পরবর্তী কালে রাজনীতির ময়দানে পা রাখেন তিনি। নির্বাচিত হন আটলান্টার মেয়র হিসাবে। কোকা কোলার জনপ্রিয়তা তাঁকে ভোটে জিততে সাহায্য করেছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রচলিত তত্ত্ব চালু রয়েছে।

১৪ ১৯

১৯২৯ সালে গ্রিগস ক্যান্ডলার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর সময় যুক্তরাষ্ট্রের নথিভুক্ত সংস্থাগুলির মধ্যে ছিল না কোকা কোলা। ১৯৪৪ সালের ২৭ মার্চ থেকে সেই তকমা পড়ে নরম পানীয়টির গায়ে। তত দিনে অবশ্যে জাপানি হামলায় হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মার্কিন নৌঘাঁটি গুঁড়িয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরোদমে জড়িয়ে পড়েছে ওয়াশিংটন।

১৫ ১৯

১৮৯৩ সালে কোকা কোলার বিকল্প হিসাবে আর একটি ঠান্ডা পানীয় তৈরি করেন ক্যালেব ব্র্যাডহ্যাম নামে মেডিসিনের এক ছাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনার নিউ বার্নে একটি ওষুধের দোকান চালাতেন তিনি। সেখানেই বিক্রি হত ‘ব্র্যাডস ড্রিঙ্ক’, যা খেলে হজমের গোলমাল আর হবে না বলে প্রচার করা হয়েছিল।

১৬ ১৯

১৮৯৮ সালে নরম পানীয়টির নাম বদলে পেপসি কোলা রাখা হয়। ‘ব্র্যাডস ড্রিঙ্ক’-এ প্রথম থেকেই চিনি এবং ভ্যানিলা মেশানো হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) পরবর্তী সময়ে চিনির দাম নিত্য ওঠানামা করতে থাকে। ফলে মারাত্মক আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ে নরম পানীয়টির নির্মাণকারী সংস্থা।

১৭ ১৯

১৯২৩ সালে একরকম দেউলিয়া হয়ে যায় পেপসি কোলা। ঠান্ডা পানীয়টির দফতরে যখন লালবাতি প্রায় জ্বলে গিয়েছে, ঠিক তখনই দেবদূতের মতো আবির্ভাব ঘটে চার্লস গুথের। এক রকম জলের দরে কিনে নেন ওই সংস্থা। ১৯৬১ সালে নরম পানীয়টির নাম বদলে রাখা হয় পেপসি।

১৮ ১৯

বর্তমানে কোকা কোলা এবং পেপসির মধ্যে রয়েছে তীব্র বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা। নরম পানীয় দু’টির ভক্তদের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। পেপসির দাবি, তারা তারুণ্যের প্রতীক। আর তাই এর বিজ্ঞাপনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে কোলা অনেক বেশি শান্ত-সিগ্ধ। এই প্রতিযোগিতার নামেও মিশে আছে যুদ্ধ। আর সেটা হল ‘কোলা-ওয়ার’।

১৯ ১৯

রাজস্বের নিরিখে কোকা কোলার থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছে পেপসি। কিন্তু নিট মুনাফায় আবার জর্জিয়ার নরম পানীয় সংস্থাটির জয়জয়কার। গত শতাব্দীতে দুই বহুজাতিকের যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সুযোগ এসেছিল। ১৯২২ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে অন্তত তিন বার পেপসি সংস্থাটিকে কেনার প্রস্তাব পায় কোকা কোলা। কিন্তু কোনও বারই তাতে সিলমোহর দেয়নি আটলান্টার সাবেক মেয়রের নরম পানীয় সংস্থা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement