শুল্কযুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে এ বার জাত তুলে আক্রমণ! এ দেশের ব্রাহ্মণদের গায়ে ‘অর্থলোভী’ তকমা সেঁটে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো। পাশাপাশি নয়াদিল্লিকে ‘রাশিয়ান টাকা তৈরির লন্ড্রি’ বলেও খোঁচা দিয়েছেন তিনি। তাঁর অদ্ভুত যুক্তিতে হতবাক গোটা দুনিয়া। তবে নাভারোর এই বক্তব্যের পর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল যে আরও চওড়া হল, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যম ‘ফক্স নিউজ়’কে সাক্ষাৎকার দেন নাভারো। সেখানে ফের এক বার ভারতের নামে বিষোদ্গার করেন তিনি। পাশাপাশি, জাতিগত সামাজিক বিভাজনকে উস্কে দিয়ে নতুন বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছেন নাভারো। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম করেও কুৎসিত আক্রমণ করতে শোনা গিয়েছে ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টাকে।
‘ফক্স নিউজ়’কে নাভারো বলেন, ‘‘মোদী একজন মহান নেতা। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কেন তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে একই শয্যায় যাচ্ছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নেতার এটা করা উচিত নয়। আমি শুধু ভারতীয় জনগণকে বলব, দয়া করে এখানে কী ঘটছে সেটা বুঝুন। ওখানে (ভারতে) আমজনতার ক্ষতি করে ব্রাহ্মণেরা মুনাফা করছে। আমাদের এটা বন্ধ করা দরকার।’’
গত ৩১ অগস্ট চিনের তিয়েনজিন শহরে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিওর (সাংহাই কো-অপারেটিভ অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেখানে জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সেরেছেন তিনি। পরে পুতিন ও ড্রাগন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে খোশগল্প করতে দেখা যায় তাঁকে। সমাজমাধ্যমের কল্যাণে ইতিমধ্যেই সেই ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। ঠিক তার পরেই এই তিন নেতাকে নিয়ে নাভারোর বেনজির আক্রমণের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে, বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
এ বছরের জুলাইয়ের গোড়া থেকেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতি নিয়ে সুর চড়াতে শুরু করেন নাভারো। পাশাপাশি, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী ভূ-রাজনৈতিক জোট তৈরির অভিযোগ তোলেন তিনি। ‘ফক্স নিউজ়’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই অবস্থানে অবশ্য অনড় ছিলেন নাভারো। তাঁর কথায়, ‘‘ক্রেমলিনের জন্য নয়াদিল্লি এখন একটা টাকা তৈরির ওয়াশিং মেশিন ছাড়া আর কিছুই নয়। এর ফল ভুগছে ইউক্রেন। পূর্ব ইউরোপের দেশটাতে ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।’’
গত ২৭ অগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক নিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। ফলে আমেরিকার বাজারে এ দেশের সামগ্রীর উপরে করের মাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। সাক্ষাৎকারে এই ইস্যুতে ফের এক বার মুখ খোলেন ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা। তাঁর যুক্তি, ‘‘নয়াদিল্লি তো শুল্কের মহারাজা। বিদেশি পণ্যে ওরা দুনিয়ার সর্বোচ্চ শুল্ক নিয়ে থাকে। নয়াদিল্লি তাদের ঘরোয়া বাজার আমাদের সামনে খুলবে না। আমাদের পণ্য ওদের বাজারে বিক্রি করতে দেবে না।’’
নাভারোর অভিযোগ, উল্টো দিকে দিব্যি ঘরের মাটিতে তৈরি পণ্য এ দেশের বাজারে সরবরাহ করে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। এতে আর্থিক ভাবে লোকসান হচ্ছে ওয়াশিংটনের। এককথায় বাণিজ্যের নামে মার্কিন শ্রমিক ও করদাতাদের অর্থ ভারতীয় সংস্থাগুলি লুট করছে বলে সুর চড়িয়েছেন তিনি। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক গত সাড়ে তিন বছর ধরে সস্তা দরে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত খনিজ তেল ‘উরাল ক্রুড’ কিনছে নয়াদিল্লি। গত ২৯ অগস্ট এই নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি বিস্ফোরক পোস্ট করেন ট্রাম্পের বাণিজ্য সচিব।
সমাজমাধ্যমে করা পোস্টে নাভারো লেখেন, ‘‘ভারতের বৃহৎ তেল লবিকে কাজে লাগিয়ে ‘উরাল ক্রুড’ বিক্রির নামে অর্থ পাচার চালিয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন। নয়াদিল্লির পরিশোধন কেন্দ্রগুলি মস্কোর থেকে সস্তা দরে বিপুল পরিমাণে খনিজ তেল কিনছে। তার পর সেটা শোধন করে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে রফতানি করছে। নিরপেক্ষতার ভান করে এ ভাবে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে কোটি কোটি টাকার বেআইনি ব্যবসা করছে মোদী সরকার।’’
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য রাশিয়ার থেকে ভারতের খনিজ তেল কেনা বন্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির উপরে চাপ বাড়াতে ইউরোপীয় দেশগুলিকে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের অনুরোধ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। অন্য দিকে মোদী সরকারের উপরে আরও একদফা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াশিংটনের। যদিও এই নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন শুল্কের চাপে রুশ ‘উরাল ক্রুড’ কেনা বন্ধ না রেখে উল্টে তার আমদানি বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেছে নয়াদিল্লি। অন্য দিকে ভারতের সঙ্গে তেল-বাণিজ্যকে আরও মসৃণ করতে দামের ক্ষেত্রে বড় ছাড় দিচ্ছে মস্কো। ইউরোপীয় দেশগুলিতে অবশ্য ট্রাম্পের শুল্ক-হুমকির উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়া গিয়েছে। উল্টে মোদী সরকারের নীতির ভূয়সী প্রশংসা করেছে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইটালির মতো দেশ। ফলে ওয়াশিংটনের কথায় তারা শুল্ক বাড়াবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে অস্বস্তি বাড়িয়েছে ইউক্রেন। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে নয়াদিল্লির থেকেই সর্বাধিক ডিজ়েল আমদানি করছে কিভ। শুধু তা-ই নয়, মস্কোর থেকে সস্তা দরে মোদী সরকারের খনিজ তেল আমদানি নিয়ে তাদের কোনও সমস্যা নেই বলেও জানিয়ে দিয়েছে পূর্ব ইউরোপের ওই দেশ। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘‘ভারত স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ। ফলে তারা কোথা থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানি করবে সেটা অন্য কেউ বলে দিতে পারে না। এ ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়।’’
শুল্ক ইস্যুতে অবশ্য আদালতে বড় ধাক্কা খেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। গত ২৯ অগস্ট একটি মামলার রায় দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডেরাল সার্কিটের আপিল কোর্ট। সেখানে বলা হয়, ট্রাম্প যে ভাবে বিভিন্ন দেশের উপর শুল্ক চাপিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে ওলটপালট করতে চাইছেন, তা বেআইনি। যদিও তাঁর শুল্ক সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের উপরে কোনও স্থগিতাদেশ দেয়নি ওই আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্য সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে প্রেসিডেন্টের। সেখানে তাঁর সিদ্ধান্তকে বেআইনি বলা হলে, শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে আমেরিকাকে।
উল্লেখ্য, গত এপ্রিলে ‘পারস্পরিক শুল্কনীতি’ চালু করেন ট্রাম্প। এর পরই বিষয়টি নিয়ে নিম্ন আদালতে দায়ের হয় মামলা। সেখানে যে রায় দেওয়া হয়েছিল আপিল আদালত তা বহাল রেখেছে। পাশাপাশি বিচারপতিরা পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘‘ট্রাম্প তাঁর জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বহু দেশের উপর বিবিধ রকমের শুল্ক আরোপ করেছেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি নিজের কর্তৃত্বের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছেন।’’
ট্রাম্পের শুল্কনীতির মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই বিকল্প বাজারের সন্ধান শুরু করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। গত ২৯ অগস্ট টোকিয়ো সফরে গিয়ে জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তার পরেই আগামী এক দশকে এ দেশে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা লগ্নির আশ্বাস দেয় টোকিয়ো। মূলত প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, প্রতিরক্ষা, সেমিকন্ডাক্টর এবং বুলেট ট্রেনের মতো প্রকল্পগুলিতে ওই অর্থ বিনিয়োগ করবে জাপান।
অন্য দিকে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’কে সামনে এনে ভারতকে নিয়ে নাভারোর বেনজির আক্রমণকে অবশ্য আলাদা করে দেখতে নারাজ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। কারণ, ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গায়ে লেগেছে বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগ। অগস্টের একেবারে শেষে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ‘ফেডারেল রিজ়ার্ভ’-এর বোর্ড অফ গভর্নরের পদ থেকে লিজ়া কুক নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকে অপসারণ করেন তিনি। ঘটনার পরের দিনই হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়, যা নিয়ে শুরু হয়েছে হইচই।
হোয়াইট হাউসের তরফে প্রকাশিত ছবিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সকল সদস্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি (থাম্বস আপ) তুলে থাকতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সেখানে ২৪ জনের মধ্যে ছিলেন মাত্র এক জন কৃষ্ণাঙ্গ। এর পরই বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগ ওঠে। উল্লেখ্য, লিজ়া ছিলেন ‘ফেডারেল রিজ়ার্ভ’-এর গভর্নর বোর্ডের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা সদস্য। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট।
কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকে অপসারণের পর ‘ব্ল্যাক ভোটারস ম্যাটার’ সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা লাটোসা ব্রাউন বলেন, “এটি পরমাণবিক বোমার মতো মারাত্মক।” ট্রাম্পকে নিশানা করে তাঁর দাবি, “মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফেডারেল রিজ়ার্ভকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চান। তা যদি হয় তবে সংস্থা আর স্বশাসিত থাকবে না।”
কুককে বরখাস্তের কারণ অবশ্য ইতিমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছেন ট্রাম্প। তাঁর অভিযোগ, বন্ধক নিয়ে জালিয়াতি করেছেন তিনি। অন্য দিকে চাকরি হারিয়ে পাল্টা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন লিজ়া। ‘ফেডারেল রিজ়ার্ভ’-এর পদ থেকে ইস্তফা দিতে অসম্মতি জানিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, ওই পদ থেকে কাউকে অপসারণ করার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের নেই।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন প্রশাসনে মোট কর্মীর ১২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নারী। আমেরিকার জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকেরা ব্যাপক বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন। সেই ইস্যু থেকে নজর ঘোরাতেই কি ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রসঙ্গ তুললেন নাভারো? উঠছে প্রশ্ন।
১৯৬৪ সালে আমেরিকায় পাশ হয় নাগরিক অধিকার আইন। সেখানে সকলের সমান অধিকারের কথা বলা রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে থাকবে না জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গে কোনও বৈষম্য। সমান এবং ন্যায্য বেতন পাবেন এবং পদোন্নতির সুযোগ থাকবে। যদিও তার পরেও ২০২৫ সালে ট্রাম্প জমানায় সেই আইন লঙ্ঘন হচ্ছে বলে অভিযোগ একাংশের।