কখনও গ্রিস-রোম। কখনও আবার ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি। কিংবা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)। সময়ে সময়ে বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তুলে গোটা পৃথিবীকে পায়ের তলায় রেখেছে ইউরোপ। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থেকে শিল্পবিপ্লব— দুনিয়ার অগ্রগতিতে সব সময় পথ দেখিয়েছে এই মহাদেশ। এ-হেন উন্নতির শিখরে থাকা উত্তর গোলার্ধের রাষ্ট্রগুলির উপর পড়েছে ‘রাহুর বক্রদৃষ্টি’! এরই জেরে কি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে তারা? ধুলোয় মিশে যাচ্ছে তাদের অতীত গৌরব?
ইউরোপীয় দেশগুলির বিশ্ব শাসনের মূল চাবিকাঠি হল তাদের উন্নত আর্থিক অবস্থা। কিন্তু, গত কয়েক দশকে তাতে ভাঙন লক্ষ করা গিয়েছে। সেখানকার একাধিক দেশের মাথার উপর রয়েছে পাহাড়প্রমাণ বৈদেশিক ঋণ। এ ছাড়া দীর্ঘ দিন ধরে শরণার্থী এবং অভিবাসী সমস্যায় ভুগছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম এবং ইটালির মতো রাষ্ট্র। অন্য দিকে ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া এবং চেকোস্লোভিয়া। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ইউরোপের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায়।
বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপের প্রাসঙ্গিকতা হারানোর নেপথ্যে একাধিক কারণের উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের যুক্তি, সময়ের দাবি মেনে জাতীয় নীতিতে কোনও বদল আনেনি উত্তর গোলার্ধের এই মহাদেশ। ২১ শতকের প্রথম ২৫ বছরে তারই প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ১৭ শতাব্দী থেকে সেখানকার দেশগুলি বিশ্ব জুড়ে গড়ে তোলে বিরাট বিরাট উপনিবেশ। ফলে হঠাৎ করে বিপুল সম্পদ হাতে চলে আসে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল এবং স্পেনের, যা জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য গবেষণা খাতে খরচ করেছিল তারা।
উদাহরণ হিসাবে ব্রিটেনের কথা বলা যেতে পারে। একসময় ইংরেজদের শাসনাধীনে ছিল বিশ্বের ২৫ শতাংশ এলাকা। প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে সেখানকার সম্পদ ইংলিশ চ্যানেলের পারে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় তারা। একই ছবি দেখা যাবে ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, নেদারল্যান্ডস এবং জার্মানির ক্ষেত্রেও। এই সম্পদ ব্যবহার করেই জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দুনিয়ায় সাড়াজাগানো ছাপ ফেলতে সক্ষম হয় ইউরোপ। উত্তর গোলার্ধের মহাদেশটি থেকে উঠে আসেন একের পর এক কালজয়ী গবেষক ও মনীষী।
গত শতাব্দীর প্রথম দশক আসতে আসতে দীর্ঘ হয় সেই তালিকা। কে নেই তাতে! আইজ়্যাক নিউটন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, নীলস বোর, ম্যাক্স প্লাঙ্ক, চার্লস ডারউইন থেকে শুরু করে মাদাম কুরি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির প্রভাব ইউরোপীয় দেশগুলির তৈরি করা বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। যেমন জার্মানির গাড়িশিল্প। ২০ শতকের শেষ দশকগুলিতে দুনিয়ার সবচেয়ে বিলাসবহুল গাড়ি বললে প্রথমেই আসত অডি, মার্সেডিজ়, পোর্সে এবং বিএমডব্লিউয়ের নাম। এদের সদর দফতর রয়েছে মধ্য ইউরোপের ওই দেশে।
১৯৫০-এর দশকে কৃত্রিম মেধা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে দেন ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক অ্যালান টুরিন। ৮০ এবং ৯০-এর দশকে সারা বিশ্বের টেলিকম দুনিয়ায় ‘রাজত্ব’ করেছিল ফিনল্যান্ডের সংস্থা নোকিয়া। কিন্তু, ২১ শতক আসতেই ধীরে ধীরে বাজার থেকে প্রায় গায়েব হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। বর্তমানে টেক জায়ান্ট সংস্থা বললে শুধুই আসবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুগ্ল, মাইক্রোসফ্ট, ওপেনএআই বা চ্যাটজিপিটির নাম। সেখানে ধারেকাছে নেই কোনও ইউরোপীয় দেশ।
বিশ্লেষকদের দাবি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-’৪৫ সাল) শেষ হওয়ার পর শুরু হয় ইউরোপের পতন। কারণ, পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে একে একে স্বাধীন হয়ে যায় ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানির মতো দেশগুলির হাতে থাকা প্রায় সমস্ত উপনিবেশ। ফলে সেখান থেকে যে সম্পদের আহরণ হচ্ছিল, সেটা রাতারাতি হারিয়ে ফেলে তারা। শুধু তা-ই নয়, পণ্য বিক্রির বিরাট বাজারও হাতছাড়া হয় তাদের। এর প্রভাবে দুর্বল হয় সেখানকার শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্র। বাধ্য হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস করতে বাধ্য হয় সরকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপীয় দেশগুলির অর্থনীতিকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছিল। ফলে বাধ্য হয়ে মার্কিন মুদ্রা ডলারে আন্তর্জাতিক লেনদেন শুরু করে তারা। পরবর্তী দশকগুলিতে ঋণের পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়াতে থাকে সেখানকার সমস্ত রাষ্ট্র। বর্তমানে এই ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসার মরিয়া চেষ্টা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এই সংগঠনের সদস্য দেশের সংখ্যা ২৭। ঋণের বোঝা কমাতে গণহারে ব্যাঙ্কের শাখা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই গোষ্ঠী। কিন্তু, তাতে ফল হয়েছে হিতে বিপরীত।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ব্যাঙ্কের শাখা বন্ধ করে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২০০৯ সালের নিরিখে এতে ৩৩ শতাংশের পতন দেখতে পাওয়া গিয়েছে। ব্যাঙ্ক বন্ধ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে জার্মানি। ওই সময়সীমার মধ্যে সেখানকার ২৮ শতাংশ ব্যাঙ্কের শাখায় পড়েছে তালা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা পোল্যান্ডের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১১ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের দাবি, ২০২০ সালের কোভিড অতিমারি এবং ২০২২ সাল থেকে চলা রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ পুরোপুরি ইউরোপীয় অর্থনীতিকে খাদের ধারে নিয়ে গিয়ে ফেলে। দ্বিতীয়টির জেরে মারাত্মক জ্বালানি সঙ্কটের মুখে পড়েছে পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ। মস্কোর খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভর করে এত দিন শক্তির চাহিদা পূরণ করছিল তারা। কিন্তু, সংঘাত শুরু হতেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে ক্রেমলিনের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় তারা। ফলে গত তিন বছর ধরে বেশি টাকা দিয়ে ঘুরপথে তেল এবং গ্যাস কিনতে হচ্ছে তাদের।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, রুশ তেলের আমদানি বন্ধ হতেই বিপুল মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়ে ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইটালির মতো দেশ। সেখানে চড়চড়িয়ে বাড়তে শুরু করে বিদ্যুতের দাম। গত তিন বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ২০০-২৫০ শতাংশ। ফলে দামি হয়েছে শিল্পোৎপাদনও। এই পরিস্থিতিতে পণ্য উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকে ভারত, চিন বা আমেরিকার মতো দেশে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে তারা। এর জেরে আবার কর্মসংস্থানের সমস্যা তৈরি হচ্ছে সেখানে।
নিষেধাজ্ঞার জন্য রুশ তেলের আমদানি বন্ধ হওয়ায় ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো দেশগুলি নরওয়ে থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস কেনা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশটিতে ওই জ্বালানির দাম চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রফতানি বাণিজ্যে লাগাম পড়ায় অসলো। ফলে আরও বিপদের মুখে পড়ে পশ্চিম ইউরোপের এই সমস্ত দেশ। কারণ, তত দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলে কয়লা এবং পরমাণু বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে এনেছে তারা।
বিশ্লেষকদের কথায়, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপে যে মন্দা ডেকে এনেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেখান থেকে বাঁচতে আমজনতাকে বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং গ্রিসের মতো দেশকে। এতে আবার তৈরি হয়েছে অন্য সমস্যা। ভর্তুকির জন্য ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে সরকারের বাজেট ঘাটতি। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছে শরণার্থী সমস্যা। ২০২৩ সালে শুধুমাত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নে আশ্রয় নেওয়া বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল ৪৩ লক্ষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কর্মীসঙ্কটের কারণে বিদেশি নাগরিকদের শিল্পক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আহ্বান জানায় ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং বেলজিয়ামের মতো দেশ। ফলে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলির থেকে অনেকেই ভাগ্যের খোঁজে পাড়ি জমান সেখানে। পরবর্তী কালে তাঁদের একাংশ পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিতে স্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করে। ফলে তৈরি হয় সামাজিক সমস্যা। শরণার্থী এবং সেখানকার আদি বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায়ই ছোটখাটো দাঙ্গার ঘটনা ঘটছিল।
কিন্তু ৯০-র দশকে বলকান এলাকা, উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ায় গৃহযুদ্ধ ও সংঘর্ষ শুরু হলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। সেখান থেকে দলে দলে লোক ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। মানবিকতার কথা বলে তাদের জন্য দরজা খুলে দিতে দেরি করেনি এই সমস্ত দেশ। পাশাপাশি, শরণার্থীদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের জন্য একাধিক প্রকল্প চালু করে তারা। এর মধ্যে গৃহনির্মাণ, সুচিকিৎসা এবং শিক্ষার অধিকার ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির একটা বড় সমস্যা হল, সেখানকার সীমান্ত একেবারেই সুরক্ষিত নয়। ফলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি বা বেলজিয়ামে আশ্রয় নিতে শরণার্থীদের কোনও সমস্যা হয়নি। তাঁদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরগুলিতে ভিড় বাড়তে থাকে। চাকরি হারান স্থানীয় বাসিন্দারা। সেই জায়গায় কম মজুরি দিয়ে শরণার্থীদের কাজে লাগানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি দু’তরফে শুরু হয় ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক সংঘাত। একে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে মারাত্মক হিংসার মুখোমুখি হয়েছে পশ্চিম ইউরোপের একাধিক দেশ।
গবেষণা খাতে খরচ কাটছাঁট করে শরণার্থীদের ভর্তুকি দেওয়া এবং কাজের পরিসর কমে যাওয়ার জেরে ইউরোপীয় দেশগুলির মেধাবী পড়ুয়া এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্তেরা ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি জমাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চিনে। ফলে নতুন কিছু আবিষ্কারের জায়গায় পিছিয়ে পড়ছে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো দেশ। পূর্ব ইউরোপের রাশিয়ার ক্ষেত্রে আবার রয়েছে অন্য সমস্যা। একসময় মহাকাশ গবেষণায় বিশ্বে প্রথম স্থান দখল করেছিল মস্কো। কিন্তু, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেই জায়গা হারিয়ে ফেলে তারা।
সোভিয়েতের পতনের পর কেবলমাত্র হাতিয়ার তৈরির দিকে নজর রাখতে দেখা গিয়েছে রুশ প্রশাসনকে। মহাকাশ গবেষণার ব্যয়বরাদ্দ বিপুল হারে কমিয়ে দেয় মস্কো। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতির কোনও গরজ দেখায়নি ক্রেমলিন। বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের অর্থনীতি অনেকটাই চিন এবং ভারত নির্ভর হয়ে পড়েছে। এই ঘেরাটোপ থেকে ইউরোপের বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন, মানছেন বিশ্লেষকেরা।