চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর হু-হু করে বাড়ছিল ক্রিপ্টো মুদ্রার দাম। একটা সময়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে যায় বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, রিপল, টিথার বা ডজকয়েনের দর। কিন্তু, নভেম্বর আসতে না আসতেই সেই সূচকে দেখা গিয়েছে মহাপতন। বর্ষশেষের মুখে একেবারে খাদের কিনারায় চলে গিয়েছে ক্রিপ্টোর বাজার। বুদবুদ ফেটে যাওয়ায় সেখান থেকে পালাচ্ছেন লগ্নিকারীরা? না কি নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও রহস্য? জবাব খুঁজছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
ক্রিপ্টো মুদ্রাগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় হল বিটকয়েন। এ বছরের নভেম্বরে এর দর হ্রাস পেয়েছে ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া ইথেরিয়ামের দাম কমেছে ৮.৮ শতাংশ। সংবাদসংস্থা ‘রয়টার্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্রিপ্টোর সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে নীচের দিকে নামতে থাকায় ২০২৫ সালের মুনাফার পূর্বাভাস কমিয়ে দেয় বিটকয়েনের বৃহত্তম কর্পোরেট হোল্ডার স্ট্র্যাটেজি। ফলে সংস্থাটির স্টকে ৩.৩ শতাংশের পতন লক্ষ করা গিয়েছে। এতে বিটকয়েনের লগ্নিকারীদের আতঙ্ক যে তীব্র হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন মার্কিন ব্রোকারেজ ফার্ম ‘মোনেক্স ইউএসএ’র ট্রেডিং ডিরেক্টর জ়ুয়ান পেরেজ়। তাঁর কথায়, ‘‘বিটকয়েন-সহ যাবতীয় ক্রিপ্টো মুদ্রার ব্যাপারে বিনিয়োগকারীরা অনেকটাই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রথাগত লগ্নিতে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ক্রিপ্টোর বাজারকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখছেন তাঁরা, যা ব্লক চেন পদ্ধতির মুদ্রাটির নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলির জন্য উদ্বেগের।’’
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪ সাল) নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভোটে ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হতেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে ক্রিপ্টোর বাজার। জানুয়ারিতে তাঁর শপথের পর দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করে বিটকয়েন, ইথেরিয়ামের দামের সূচক। এর জন্য অবশ্য ট্রাম্পের নীতিকেই দায়ী করেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। নির্বাচনে জেতার পর ক্রিপ্টো মুদ্রার বিশাল ভান্ডার তৈরির কথা বলতে শোনা গিয়েছিল তাঁকে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই ঘোষণা লগ্নিকারীদের বাড়তি ভরসা জুগিয়েছিল।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জানুয়ারিতে শপথ নেওয়ার মুখে নিজের নামে ক্রিপ্টো মুদ্রা আনেন ট্রাম্প। শুধু তা-ই নয়, ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ‘ফেডারেল রিজ়ার্ভ’-এর হাতে মজুত থাকা সোনার পরিমাণ কমাবেন বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি। বলেন, অচিরেই সেই জায়গা নেবে বিটকয়েন ও ইথেরিয়ামের মতো ব্লক চেইন মুদ্রা। এর জেরে রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে ক্রিপ্টো বাজারের সূচক। যেটা দেখে একটা সময়ে একটি বিটকয়েনের দাম পাঁচ লক্ষ ডলারে পৌঁছে যাবে বলে মনে করা হয়েছিল।
ক্রিপ্টো মুদ্রার মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে আরও একটি কারণের কথা বলেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। গত এপ্রিলে পারস্পরিক শুল্কনীতি চালু করেন ট্রাম্প। ফলে ভারত, চিন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-ভুক্ত দেশগুলির পণ্যের উপর বিপুল শুল্ক চাপিয়ে দেয় তাঁর প্রশাসন। এর তাৎক্ষণিক প্রভাব দেখা গিয়েছিল মার্কিন শেয়ার বাজারে। শুল্কযুদ্ধের জেরে বিপাকে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সংস্থা। দেখা দেয় কাঁচামালের সঙ্কট। এতে পরবর্তী মাসগুলিতে রক্তাক্ত হয়েছে আমেরিকার শেয়ার বাজার।
ব্রোকারেজ ফার্মগুলির দাবি, স্টকের সূচক নিম্নমুখী হতেই লগ্নিকারীদের একাংশ সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে ক্রিপ্টো মুদ্রায় বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। ফলে এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মধ্যে এর সূচককে ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা গিয়েছে। তবে নভেম্বর আসতে না আসতেই বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। শুল্কসংঘাত মিটিয়ে ফেলতে একের পর এক দেশের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলেন ট্রাম্প। ফলে সেখান থেকে বিপুল লগ্নি আসতে শুরু করে আমেরিকার বাজারে।
উদাহরণ হিসাবে কাতার, সৌদি আরব এবং জাপানের কথা বলা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে এক লক্ষ কোটি ডলার করে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই তিনটি দেশ। অর্থাৎ কৃষি, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা ও অন্যান্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে মোট তিন লক্ষ কোটি ডলারের লগ্নি পাচ্ছে আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থা। এর জেরে নভেম্বরে ফের চাঙ্গা হয়েছে মার্কিন শেয়ার বাজার। ফলে ক্রিপ্টো মুদ্রায় চলে যাওয়া বিনিয়োগকারীদের একাংশ সেখান ফিরতে শুরু করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারের একাধিক সূচক রয়েছে। মার্কিন ব্রোকারেজ় ফার্মগুলির দাবি, গত এক বছরে এর মধ্যে ডাও জোন্স ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে ৫.৬ শতাংশ। এ ছাড়া এসঅ্যান্ডপি-৫০০ বেড়েছে ১২.৮৬ শতাংশ এবং ন্যাসড্যাক বেড়েছে ২০ শতাংশ। সেখানকার চিপ নির্মাণকারী সংস্থা এনভিডিয়ারের বাজারমূল্য পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা ছাপিয়ে গিয়েছে।
ক্রিপ্টো মুদ্রার দাম অবশ্য শুধুমাত্র মার্কিন বাজারের উপর নির্ভরশীল নয়। ভারতের লগ্নিকারীদেরও এতে ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। নভেম্বরের একেবারে শেষে পৌঁছে ৮৬ হাজারে উঠে যায় বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার সূচক। ১৪ মাস পর রেকর্ড উচ্চতায় উঠতে দেখা গিয়েছে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার সূচক নিফটিকেও। ফলে এ দেশেও ক্রিপ্টো মুদ্রার লগ্নিকারীদের একাংশ বিটকয়েন-ইথেরিয়াম বিক্রি করে স্টক কেনা শুরু করেছেন।
ক্রিপ্টো মুদ্রার বড় বাজার রয়েছে জাপান এবং ‘রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা আরওকে-তে (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া)। এ বছরের ডিসেম্বরে টোকিয়োর সরকারি বন্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। ঠিক তার আগে সংশ্লিষ্ট বন্ডগুলির সুদের হার বৃদ্ধি করেছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওই দ্বীপরাষ্ট্র। ফলে বেশি লাভের আশায় সে দিকে ঝুঁকেছেন লগ্নিকারীদের একাংশ। এর জেরে চাহিদা কমায় দাম পড়েছে ক্রিপ্টো মুদ্রার।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৪২৬টি বিটকয়েন চুরির অভিযোগ আনে চিন। বেজিঙের সরকারি গণমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইম্স’-এ সেই খবর প্রকাশিত হতেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে যায় শোরগোল। ড্রাগনের দাবি, বছর পাঁচেক আগে (পড়ুন ২০২০ সালে) হ্যাকিংয়ের শিকার হয় তাদের ক্রিপ্টো মুদ্রা খনন সংস্থা ‘লুবিয়ান’। ওই সময় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সার্ভারে ঢুকে বিটকয়েন সরায় এক সাইবার অপরাধী। যদিও তখন বিষয়টিকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল ‘লুবিয়ান’।
বিটকয়েন-সহ যে কোনও ক্রিপ্টো মুদ্রা পুরোপুরি ভাবে ব্লক চেন প্রযুক্তিনির্ভর। লগ্নিকারীদের কাছে এটিকে পৌঁছে দিতে নিরন্তর চালাতে হয় খননকার্য, যা মূলত দু’ভাবে করা যেতে পারে। একটি হল সোলো মাইনিং বা একক খনন। দ্বিতীয়টিকে বলা হয় পুল মাইনিং বা সমষ্টিগত খনন। প্রথমটিতে ব্লক চেন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডিজিটাল দুনিয়ায় ক্রিপ্টো মুদ্রাকে হাজির করার সুযোগ রয়েছে। যদিও এতে পুল মাইনিংয়ের প্রচলন বেশি।
সোলো মাইনিংয়ে বিটকয়েন বা যে কোনও ক্রিপ্টো মুদ্রা তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ। আর তাই পুল মাইনিংয়ে একাধিক ব্যক্তিকে কাজে লাগিয়ে থাকে ‘লুবিয়ান’-এর মতো চিনা সংস্থা। সমষ্টিগত ভাবে ব্লক চেনের ডিজিটাল দুনিয়ায় খননকাজ চালিয়ে বিটকয়েন তুলে আনে তারা। বেজিঙের অভিযোগ, এ-হেন পুল মাইনিংয়ের সময় তা হ্যাক করে ক্রিপ্টো মুদ্রা চুরি করেছে আমেরিকা। সংশ্লিষ্ট ঘটনাকে ‘রাষ্ট্রীয় সাইবার অপরাধ’ আখ্যা দেয় ড্রাগন সরকার।
বিশ্লেষকদের দাবি, এই খবর প্রকাশ্যে আসার পর ক্রিপ্টো মুদ্রার উপর আস্থা হারান লগ্নিকারীদের একাংশ। বিটকয়েন বা ইথেরিয়ামের উপর কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে হ্যাকিং হলে এতে বিনিয়োগ করা যাবতীয় মুদ্রার লোকসান হওয়ার আশঙ্কা ষোলো আনা। সেই কারণেও ক্রিপ্টো বাজার থেকে তাঁরা মুখ ঘুরিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্য দিকে শেয়ার বাজার ঝুঁকিসাপেক্ষ হলেও এর উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে স্টকের সূচক নিম্নমুখী হলে তা ঠিক করতে সব সময়েই উদ্যোগী হয় সংশ্লিষ্ট দেশটির প্রশাসন। ক্রিপ্টো মুদ্রার উপর সেই নিয়ন্ত্রণ নেই। চিনের মতো দেশে এর কোনও আইনি স্বীকৃতিই নেই। জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিটকয়েন বা ইথেরিয়ামে লগ্নির ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলিও ভাবাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের।
ক্রিপ্টোর বাজারের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে। ১৩ বছরে মাত্র দু’বার বাদে প্রতি অক্টোবরেই এর সূচক ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা গিয়েছে। আর নভেম্বরে কমেছে বিটকয়েন ও ইথেরিয়ামের দাম। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, বাজার ও সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী হলে ক্রিপ্টো বাজারের থেকে স্বাভাবিক ভাবেই মুখ ফেরাবেন বিনিয়োগকারীরা। তখনই দাম পড়বে সংশ্লিষ্ট মুদ্রার।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি যে সব সময় বজায় থাকবে, এমনটা নয়। ভূ-রাজনৈতিক নানা কারণে ফের নিম্নমুখী হতে পারে আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজার। স্টকের সূচক নামলে ফের ক্রিপ্টো মুদ্রার দিকে ঝুঁকতে পারেন লগ্নিকারীরা। ৩ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার ডলারে ঘোরাফেরা করছে বিটকয়েনের দাম। এতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রয়েছে।