২০২০ সালে কোভিড অতিমারির সময়ে কেরলে চাষিরা তাঁদের ফসলে বিজাতীয় একটি সাদা পোকার উপদ্রব লক্ষ করেন। কাসাভা বা ট্যাপিওকা গাছে তাঁরা অদ্ভুত এই পোকাটির অস্তিত্ব লক্ষ করেন। প্রথমে সাধারণ পোকার আক্রমণ ভেবে বিষয়টি নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেননি চাষিরা। পরবর্তী কালে জানা যায় ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করার ক্ষমতা রয়েছে বিদেশি পোকাটির।
অপরাধীকে ‘কাসাভা মিলিবাগ’ (বৈজ্ঞানিক নাম ফেনাকোক্কাস মানিহোটি) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ক্ষুদ্র পোকাটিকে বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত কৃষি-পতঙ্গগুলির মধ্যে একটি বলে ধরা হয়। এগুলি গাছের পাতা থেকে রস শোষণ করে গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়, পাতা কুঁকড়ে দেয় এবং গাছকে দুর্বল করে দেয়। এরা সাদা তুলোর মতো দেখতে। পাতায় সাদা মিহি গুঁড়োর মতো একটি আস্তরণ তৈরি করে।
এই পোকাটির জন্ম আফ্রিকায়। যে হেতু এটি ভারতের স্থানীয় কীটপতঙ্গের তালিকাভুক্ত নয়, তাই দেশে এই পোকাটির কোনও প্রাকৃতিক শত্রু ছিল না। ফলে এটি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে মাইলের পর মাইল ফসলে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
কয়েক মাসের মধ্যেই কেরলের সীমানা পেরিয়ে এটি তামিলনাড়ুর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় ফসল ট্যাপিওকা বা কাসাভা আলু। এই ফসলটির চাষে দক্ষিণের রাজ্যে কেরল ও তামিলনাড়ু ভারতকে বিশ্বব্যাপী পঞ্চম স্থানে রেখেছে। এ দেশের ১.৭৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে এই ফসল জন্মায়। মোট উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি ফসল পাওয়া যায় তামিলনাড়ু থেকে। কেরলের অবদান প্রায় ৪৩ শতাংশ।
বিগত কয়েক দশক ধরে, ভারতে ট্যাপিওকা চাষে প্রভূত লাভের মুখ দেখেছিলেন দক্ষিণের রাজ্যের কৃষিজীবীরা। প্রতি হেক্টরে ৩৫ টন ফলন হত, যা বিশ্ব গড়কে টপকে গিয়েছিল। অতিমারির পর্যায়ে এই হারে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বিদেশি মিলিবাগের আক্রমণে প্রতি হেক্টরে উৎপাদনশীলতা মাত্র ৩-৫ টনে নেমে আসে। ২০২২ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য মিলিবাগের ব্যাপক আক্রমণের শিকার হন ট্যাপিওকা চাষিরা।
সুদূর আফ্রিকা থেকে ভারতে এসে কী ভাবে বংশবিস্তার করল এই ক্ষুদ্র কীটেরা? বিদেশি পোকামাকড় একাধিক উপায়ে নতুন অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে। মরুভূমির পঙ্গপালের মতো কিছু পোকামাকড় যথেষ্ট হালকা হয়। ঝোড়ো বাতাসের বেগে ভর করে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে উড়ে যায় তারা। এদের কেউ কেউ আবার পণ্যবাহী জাহাজ, এমনকি যাত্রীদের ব্যাগপত্র আঁকড়ে ধরে থাকে। ফলে সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে চালান হয়ে যায় এরা।
অনেক সময় খাদ্যশস্য, ফল এবং শাকসব্জির মতো পণ্যের মধ্যে দিয়ে ভিন্দেশে প্রবেশ করে। নানা রকম গাছপালা এবং ফুলের তোড়ায় ভর করে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে কীটপতঙ্গ। এ ছাড়াও যন্ত্রপাতি, কাঠের মাধ্যমেও চলে আসে এগুলি। প্যাকেজিং উপকরণের সঙ্গে আটকে ডিম বা লার্ভাও পরিবাহিত হয়ে থাকে।
এক বার বিদেশের মাটিতে কোনও ভাবে নিজেদের টিকিয়ে ফেলতে পারলে বংশবিস্তারে বাধা থাকে না। কারণ নতুন আবাসস্থলে তাদের প্রাকৃতিক শিকারির অভাব থাকে। বিনা বাধায় চড়চড়িয়ে সংসার পেতে বসে কীটপতঙ্গ। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, এদের প্রাকৃতিক পরিবেশে থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেওয়াটা অন্যায়। এরা বাস্তুতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ গাছের সঙ্গে থাকা পোকামাকড় মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরেই পৃথিবীতে টিকে রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু আবার লক্ষ লক্ষ বছর আগেও ছিল এবং সব সময় উদ্ভিদের সঙ্গে সহাবস্থান করেছে।
পোকার বাড়বৃদ্ধি রুখতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করাই যায়। কিন্তু তাতে আখেরে ক্ষতি ফসল ও কৃষিজমির। অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করতে পারে। কীটপতঙ্গের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য তাই কৃষিজীবীদের হাতিয়ার হিসাবে তুলে দেওয়া হল প্রাকৃতিক শত্রুকে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো জৈব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে মিলিবাগকে শায়েস্তা করলেন ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের গবেষকেরা।
গবেষকেরা ২০২২ সালে জানতে পারেন যে তারা এমন একটি সঙ্কটের মুখোমুখি হতে চলেছেন যা ৭০-এর দশকে আফ্রিকায় ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিফলন। একই মিলিবাগ ’৭০ সালে খেতের পর খেতের ফসল ধ্বংস করে দিয়েছিল। প্রায় ২০ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটের পাল। সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে গবেষকেরা খুঁজে বার করলেন মিলিবাগের একটি প্রাকৃতিক শত্রুকে।
রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈবিক নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নেন তাঁরা। সে বছর ভারতের আমদানির তালিকায় একটি অস্বাভাবিক জিনিস ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার পথে হেঁটে মিলিবাগের বাড়বাড়ন্ত রোধ করতে আনা হয় পরজীবী বোলতা। আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ বেনিন থেকে আমদানি করা হয় পরজীবী বোলতাটিকে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে প্রথম ধাপে যে বোলতাগুলি আসে সেগুলি কাস্টমসে সংরক্ষণের সমস্যার কারণে টিকে থাকতে পারেনি। এক মাস পরে আমদানি করা দ্বিতীয় বারের প্যাকেজটি অবশেষে বেঙ্গালুরুতে পৌঁছোয়। সেখানে বোলতাগুলিকে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করা হয়েছিল, যাতে তারা স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত না করে।
২০২২ সালের প্রথম দিকে বোলতাগুলিকে মুক্ত করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পরে ২০২২ সালের মার্চ মাসে, কৃষি গবেষণা পরিষদ এবং তামিলনাড়ু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যাপিওকা এবং ক্যাস্টর গবেষণাকেন্দ্র প্রথম পর্যায়ে বোলতা মুক্ত করার কর্মসূচি আয়োজন করে। প্রতি একর কৃষিজমিতে প্রায় ২৫০টি বোলতাকে মুক্ত করা হয়েছিল।
পাশাপাশি, স্থানীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, যাতে তাঁরা বোলতাগুলিকে নিজেরাই লালনপালন করতে পারেন। বার বার আমদানি না করে এই পদ্ধতিতে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো যেতে পারে। এই ক্ষুদ্র বোলতাগুলি মিলিবাগের ভিতরে ডিম পাড়ে। এর পর ডিম ফুটে বোলতার লার্ভা বেরোলে তা মিলিবাগটিকে উদরস্থ করে ফেলে তাদের বংশ নির্মূল করে।
ভারত অতীতেও পোকামাকড় এবং পরজীবী আমদানির এই পদ্ধতির দিকে ঝুঁকেছিল। ১৯৫০ সালে প্রথম সাফল্য আসে। বিজ্ঞানীরা কেরলে লেবুজাতীয় ফসল ধ্বংসকারী তুলা কুশন স্কেল রোগের জন্য দায়ী পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি শিকারি পোকা আমদানি করেছিলেন। রোডোলিয়া কার্ডিনালিস নামের সেই পতঙ্গের সাহায্যে ফসল ধ্বংসকারী পোকাটি নিয়ন্ত্রিত হয়। কোনও রাসায়নিক প্রয়োগ করতে হয়নি।