আর মার খেয়ে প্রত্যাঘাত নয়। হামলার আশঙ্কা থাকলে আগেই ভেঙে দিতে হবে শত্রুর দাঁত-নখ! ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্যের পর ‘সামরিক নীতি’তে (পড়ুন মিলিটারি ডকট্রিন) এই ধরনের বড় রদবদলের পরিকল্পনা করেছে ভারত। সীমান্তপার সন্ত্রাস এবং চিন-পাকিস্তানের মতো জোড়া শত্রুর মোকাবিলায় নয়াদিল্লির ‘শরীরী ভাষা’র পরিবর্তন যে তাদের মনে কাঁপুনি ধরাবে তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে জাতীয় সুরক্ষা সংক্রান্ত একটি বৈঠকে ‘সামরিক নীতি’ বদলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। নতুন মতবাদে ফৌজকে রক্ষণাত্মক খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে আক্রমণাত্মক হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’ স্থগিত করার সময় একটি বিষয় স্পষ্ট করে নয়াদিল্লি। ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী হামলাকে যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
সূত্রের খবর, সেই কারণে ফৌজকে আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্য নিয়ে নতুন ‘সামরিক নীতি’ তৈরি করছে কেন্দ্র। সেখানে ‘কৌশলগত সংযম’-এর বিষয়টি আর থাকবে না বলেই জানা গিয়েছে। উল্টে প্রয়োজনে আগাম বড় আঘাত হেনে শত্রুর মনে মারাত্মক ভয় ধরাবে সেনা। নিরাপত্তা সংক্রান্ত হুমকি পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই বিপক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হবে এর একমাত্র লক্ষ্য।
আক্রমণাত্মক এই ‘মিলিটারি ডকট্রিন’-এর নীলনকশা তৈরি করছেন সেনার তিনটি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) জেনারেল অনিল চৌহান। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। পাশাপাশি, বাহিনীর আধুনিকীকরণে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। একটি বিশেষ ‘ভবিষ্যৎ যুদ্ধকৌশল বিশ্লেষক গোষ্ঠী’ তৈরি করেছেন তিনি। এর মূল কাজ আধুনিক লড়াইয়ের পদ্ধতি রপ্ত করা।
এই ‘ভবিষ্যৎ যুদ্ধকৌশল গোষ্ঠী’র অনুসন্ধান এবং পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে সৈনিকদের আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য তৈরি করবে ফৌজ। সেইমতো দেওয়া হবে প্রশিক্ষণ এবং কেনা হবে হাতিয়ার। আক্রমণাত্মক অভিযানে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে, সেটাও আগাম বোঝার চেষ্টা করবে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর অফিসারেরা। শত্রু মোকাবিলায় নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যাতে একরকম শূন্যে নামিয়ে আনা যায় তাই এই ব্যবস্থা।
‘অপারেশন সিঁদুর’ শেষ হওয়ার পর চলতি বছরের ৩০ মে থেকে ১ জুনের মধ্যে সিঙ্গাপুরের ‘শাংরি-লা ডায়লগ’-এ যোগ দেন সিডিএস জেনারেল চৌহান। সেখানে ভারতের নতুন ‘সামরিক নীতি’র ইঙ্গিত দেন তিনি। বলেন, ‘‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন পদ্ধতির রণকৌশল নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আগামী দিনে আমাদের মিলিটারি ডকট্রিন তিনটি বিষয়ের উপর দাঁড়িয়ে পরিচালিত হবে। সেগুলি হল অত্যাধুনিক হাতিয়ার, আধুনিক রণকৌশল এবং সম্পূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রের দখল নেওয়া।’’
নতুন ‘সামরিক নীতি’তে হাতিয়ারের ক্ষেত্রে দু’টি বড় পরিবর্তন আনছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। ফৌজের হাতে থাকা সমস্ত অস্ত্রই সুপারসনিক (শব্দের চেয়ে গতিশীল) এবং হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে গতিশীল) করতে চলেছে তারা। এ ছাড়া স্টেল্থ প্রযুক্তিতে হাতিয়ারগুলিকে আরও শক্তিশালী ও বিধ্বংসী করে তোলা হচ্ছে। ঘরের মাটিতে অস্ত্র উৎপাদনেও জোর দিয়েছে কেন্দ্র। এ ব্যাপারে বিদেশি নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে সরকার।
আধুনিক রণকৌশলের ক্ষেত্রে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন সিডিএস জেনারেল চৌহান। তাঁর দাবি, মেশিন লার্নিং যুদ্ধের সময়ে আরও দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে। বেশ কিছু হাতিয়ারেও ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি। আর তাই আক্রমণাত্মক নতুন ‘সামরিক নীতি’তে এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া নতুন ‘মিলিটারি ডকট্রিন’-এ রিয়্যাল টাইম তথ্যের উপরে জোর দেবে ফৌজ। আক্রমণাত্মক অভিযানে জল-স্থল-আকাশ সব দিক থেকে আঘাত হেনে শত্রুকে হতচকিত করে দেওয়াই লক্ষ্য হতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে। সেইমতো বাহিনীকে তৈরি করা হচ্ছে বলে ‘শাংরি-লা ডায়লগ’-এ স্পষ্ট করেন সিডিএস চৌহান।
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটিশ ‘সামরিক নীতি’র উপরে ভিত্তি করেই পরিচালিত হয় সেনা। সেটা ছিল পুরোপুরি ভাবে রক্ষণাত্মক। মূলত দেশের সীমান্ত সুরক্ষার জন্য মোতায়েন থাকত ফৌজ। ফলে হামলার আশঙ্কা থাকলেও আগ বাড়িয়ে কোনও পদক্ষেপ করত না বাহিনী। ফলে মাত্র ১৫ বছরের মধ্যেই বড় ধাক্কা খেতে হয় সেনা ও সরকারকে।
১৯৬২ সালে আচমকাই ভারত আক্রমণ করে চিন। এ দেশের ফৌজের রক্ষণাত্মক নীতির জেরে লাদাখের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করতে সক্ষম হয় বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে প্রয়োজন ছিল বিমানবাহিনীর জোরালো প্রত্যাঘাত। কিন্তু, তৎকালীন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সরকার সেই অনুমতি দেয়নি। ফলে চূড়ান্ত ভাবে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয় ভারতীয় সেনাকে।
’৬২-র চিন যুদ্ধের পর এ দেশের ‘মিলিটারি ডকট্রিন’ বা সামরিক নীতিতে আসে বড় পরিবর্তন। পরবর্তী ১০ বছরের কম সময়ে বাহিনীর সৈনিক সংখ্যা দ্বিগুণ করে সরকার। সেনার তিন শাখার মধ্যে বাড়ানো হয় সংযোগ। ফলে ১৯৬৫ সালে পাক ফৌজের ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ এবং ‘অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম’কে সামাল দিতে সে ভাবে অসুবিধা হয়নি। এই যুদ্ধে আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়েছিল এ দেশের স্থল এবং বায়ুসেনা।
এই নীতিগত পরিবর্তনের ফলে ’৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধে বেশ কিছু কৌশলগত এলাকা দখল করতে সক্ষম হয় এ দেশের বাহিনী। এর মধ্যে অন্যতম হল জম্মু-কাশ্মীরের পীরপাঞ্জাল রেঞ্জের হাজি পীর পাস। পরবর্তী বছরগুলিতে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে ফৌজকে আধুনিক করার ব্যাপারে আরও আক্রমণাত্মক হয় কেন্দ্র, যার সুফল পাওয়া গিয়েছিল বাংলাদেশ যুদ্ধে।
১৯৭১ সালের লড়াইয়ে ভারতীয় সেনার হাতে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয় পাক ফৌজ। দেশের পূর্বাঞ্চল হাতছাড়া হয় ইসলামাবাদের। সেখানে জন্ম হয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। এ ছাড়া ৯৩ হাজারের বেশি পাক সৈনিককে যুদ্ধবন্দি করে এ দেশের বাহিনী। ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লা খান নিয়াজ়ি। পাশাপাশি, পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের বিস্তীর্ণ জমিও দখল করে ভারতীয় ফৌজ।
বাংলাদেশ যুদ্ধে প্রশ্নাতীত সাফল্যের পর ফের কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে চলে যায় এ দেশের বাহিনী। ভারতের সামরিক ইতিহাসে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে ‘মিলিটারি ডকট্রিন’কে গোঁড়া আক্রমণাত্মক বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকেরা। সেখানে শত্রুভূমির অনেকটা ভিতরে ঢুকে হামলা চালানোর অস্ত্রে মূলত কামান এবং ট্যাঙ্কে ফৌজকে শক্তিশালী করে সরকার। এ ছাড়া দ্রুত প্রতিপক্ষের জমি দখলও ছিল এই নীতির মূল কথা।
১৯৮০-র দশকে নতুন ‘সামরিক নীতি’র প্রবর্তন করেন তৎকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল কৃষ্ণস্বামী সুন্দরজি। সেই মিলিটারি ডকট্রিন অনুযায়ী তৈরি হয় বাহিনীর সাতটি রক্ষণাত্মক ‘হোল্ডিং কোর’ এবং তিনটি ‘স্ট্রাইক কোর’। শেষেরটিকে যে কোনও সময়ে শত্রুভূমিতে ঢুকে হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে গঠন করেন তৎকালীন সেনাকর্তারা। এক কথায় বিশ্বাসযোগ্য আক্রমণাত্মক ভঙ্গি বজায় রেখে পাক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সীমান্তে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলাই ছিল জেনারেল সুন্দরজির লক্ষ্য।
এই ‘সামরিক নীতি’র পোশাকি নাম ‘সুন্দরজি ডকট্রিন’। ২০০১ সালে সংসদে জঙ্গি হামলার পর পাক সীমান্তে ফৌজ পাঠায় কেন্দ্র, যা ছিল ভারতীয় সেনার ‘অপারেশন পরাক্রম’। ওই সময়ে ‘সুন্দরজি ডকট্রিন’-এর ফাঁকফোকরগুলি সকলের নজরে আসে। দেখা যায় স্ট্রাইক কোরের নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছোতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে নতুন সামরিক নীতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
২০০৪ সালে ‘কোল্ড স্টার্ট মিলিটারি ডকট্রিন’ নিয়ে আসে এ দেশের ফৌজ। এই নীতি মেনে তৈরি হয় সেনার দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ড। এ ছাড়া বাহিনীর তিনটি শাখাকেই এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে ‘ইন্টিগ্রেটেড ব্যাটেল গ্রুপ’ এবং ‘মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর’কে সক্রিয় করে কেন্দ্র। সেইমতো প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ এবং রসদ তুলে দেওয়া হয় সেনার হাতে।
‘কোল্ড স্টার্ট’ সামরিক নীতির মূল কথা ছিল রিঅ্যাক্টিভ। অর্থাৎ, প্রত্যাঘাতের উপরে জোর দেবে ভারতীয় সেনা। কিন্তু নতুন মিলিটারি ডকট্রিনে সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, বর্তমান নীতিতে আঘাত আসার আগেই গোয়েন্দা তথ্যের উপরে ভিত্তি করে আক্রমণ শানানোর কথা বলা হচ্ছে। এর জন্য বহুল পরিমাণে ড্রোন বা স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মতো হাতিয়ারের বহুল ব্যবহার করতে পারবে ফৌজ।
বিশ্লেষকদের অনুমান, নতুন সামরিক নীতির জেরে আগামী দিনে পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরে বিভিন্ন জঙ্গিশিবিরে আগাম ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটবে অহরহ। পাশাপাশি, পাক সেনার প্রত্যাঘাত সামলাতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও মজুবত করবে সেনা। বর্তমান মিলিটারি ডকট্রিনের সঙ্গে ইজ়রায়েলি ফৌজ়ের আগ্রাসী মনোভাবের মিল খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা।