সম্প্রতি রেলের আর্থিক অবস্থা সংক্রান্ত কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (ক্যাগ) সংসদে একটি রিপোর্ট পেশ করেছে। চলতি অগস্টের গত সপ্তাহে সংসদে ক্যাগের যে রিপোর্টটি জমা পড়েছে তার সহজ হিসাবে রেল লাভের মুখ দেখেছে।
২০২২-২৩ সালের সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে বলা হয়েছে গত বছরের তুলনায় রেল ২৫.৫১ শতাংশ নিট মুনাফা অর্জন করেছে। মোট ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার লাভ হয়েছে রেলে। সরল হিসাবে লাভের কথা বলা হলেও ক্যাগের রিপোর্টে রেলের দাবির প্রতিফলন ঘটেনি। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে রেলের আয়ের ভান্ডারকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখা হচ্ছে।
রেলের আয়ের হাল ঠিক কেমন? ট্র্যাকে নতুন নতুন ট্রেন দৌড় করানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও রেলের কোষাগারে সেই ভাঁড়ে মা ভবানী। সামগ্রিক ভাবে আর্থিক দৈন্যে ভুগছে রেল মন্ত্রক। হরেক কিসিমের কৌশল দেখিয়েও লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না।
২০২১-২২ সালে রেলের ‘অপারেটিং রেশিয়ো’ পৌঁছেছিল ১০৭.৩৯ শতাংশে। অর্থাৎ, ভারতীয় রেলকে একশো টাকা আয় করতে প্রায় ১০৭ টাকার বেশি খরচ করতে হয়েছিল। তার আগের বছর ‘অপারেটিং রেশিয়ো’ ছিল ৯৭.৪৫ শতাংশ।
২০২২-২৩ সালে রেলের আয় সংক্রান্ত ক্যাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিট মুনাফার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখিয়েছে রেল। ২০১৮-১৯ সালে ৬,১৪৬.২৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ সালে ১২ হাজার ৫৬ কোটি টাকায় পৌঁছোয় বলে রেল দাবি করেছে। ২০২১-২২ সালের অর্থবর্ষে রেলের নিট ঘাটতি ছিল ১৫ হাজার ২৫ কোটি টাকা। সেই ঘাটতির খরা ২২-২৩ এর অর্থবর্ষে কেটেছে বলে রেলের দাবি।
ক্যাগের রিপোর্টের সঙ্গে রেলের মুনাফার লাভের দাবির বিস্তর ফারাক রয়েছে। রেল জানিয়েছিল ২০২২-২৩ এর অর্থবর্ষে রেলের নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। রেলের এই হিসাবটি আদতে জল মেশানো। ক্যাগের রিপোর্ট অনুযায়ী রেলওয়ের মোট আয় এবং ব্যয়, যখন তার ‘ক্রস-সাবসিডি’(এক জায়গায় ভর্তুকি বাড়িয়ে অন্যত্র কমানো) রেকর্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন দেখা যায় যে রেল ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় কম দেখিয়েছে।
ক্যাগের অডিটে দেখা গিয়েছে, রেল তার আয় এবং ব্যয় হিসাব করার পর ২,৫১৭.৩৮ কোটি টাকার যে নিট মুনাফা দেখিয়েছে সেটি আদতে পণ্য বহন করে এসেছে। তবে সেই পরিষেবার লাভের টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে যাত্রী পরিষেবায়। তাতেও যাত্রী পরিষেবার দিক দিয়ে ৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়েছে রেল।
গত অর্থবর্ষে রেল পণ্য পরিবহণ থেকে ৫৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা লাভ করেছে। বিপরীত দিকে যাত্রী পরিষেবার দিক দিয়ে দেখতে গেলে রেল তো লাভের মুখ দেখেইনি, উল্টে ৬০ হাজার কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে রেলকে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে স্লিপার ক্লাস, অর্ডিনারি ক্লাস এবং সেকেন্ড ক্লাসের ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে রেলকে। যথাক্রমে ১৭ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা, ১৭ হাজার ৭৭ কোটি টাকা এবং ১৬,৩৫৭ কোটি টাকা গুনাগার দিয়ে হয়েছে পরিষেবা চালু রাখার জন্য। যাত্রীভাড়ায় বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হয় রেলকে। সেই ভর্তুকি এসেছে পণ্য পরিবহণ থেকে।
রেলের সোজাসাপটা আয় ও ব্যয়ের হিসাবে দেখানো হয়েছে যাত্রী, পণ্য পরিবহণ এবং অন্যান্য পরিষেবা থেকে রেলের মোট আয় হয়েছিল ২ লক্ষ ৪০ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। রেলের বেতন ও পরিচালন খাতের ব্যয়ের যে হিসাব দেখানো হয়েছে তাতে বলা হয়েছে ওই অর্থবর্ষে রেলের ২ লক্ষ ৩৭ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে রেলকে। আয় থেকে ব্যয়ের হিসাব বাদ দিয়ে ২,৫১৭.৩৮ কোটি টাকা লাভের হিসাব দেখিয়েছে রেল।
রেল বলেছে, ১ লক্ষ ৬৫ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা আয় হয়েছে পণ্য পরিষেবা থেকে। সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে রেল এই বিভাগ থেকে ৫৪ হাজার ৭৮৪ কোটির লভ্যাংশ ঘরে তুলতে পেরেছিল। অন্য দিকে যাত্রী পরিষেবার খরচ সামলাতে মুখ থুবড়ে পড়েছে ভারতীয় রেল। ৬০ হাজার ৪১ কোটি টাকার লোকসানের বোঝা চেপেছে যাত্রী পরিষেবা বজায় রাখতে গিয়ে।
এই লোকসানের ধাক্কা সামলাতে পণ্য পরিবহণ খাতের লাভের অংশ যাত্রী পরিষেবা খাতে ভর্তুকি দিতে বাধ্য হয়েছে রেল। পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে যে মুনাফা হয়েছে তার সিংহভাগই এসেছে কয়লা পরিবহণ থেকে। ৫২ শতাংশের বেশি আয় হয়েছে একটি মাত্র পণ্য পরিবহণ করেই। যদিও একক পণ্য পরিবহণের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকার বিষয়টি ভবিষ্যতে আর কতটা ফলদায়ক হবে সে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
কারণ দেশে ক্রমশ প্রচলিত শক্তি ব্যবহার করে জ্বালানির বদলে পরিবেশবান্ধব শক্তির ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। ফলে ভবিষ্যতে কয়লার চাহিদা কমলে তার পরিবহণের পরিমাণ হঠাৎ করেই হ্রাস পাবে। এমনিতেই গত ২০ বছরে রেলে পণ্য পরিষেবা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় রেলের পরিষেবার দর চড়া। রেলের মাধ্যমে পণ্য পাঠাতে গেলে বাজারদরের চেয়ে তিন গুণ বেশি ট্যাঁকের কড়ি খসাতে হয় গ্রাহককে। পণ্যবাহী ট্রেনের সময়সীমা নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছে না দেওয়ার ক্ষেত্রে রেলের ‘সুনাম’ যথেষ্ট।
তবে পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহণের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রেল পিছিয়ে পড়েছে। কয়েক বছর ধরে পণ্য পরিবহণ কমছে রেলের। ফলে টান পড়েছে রোজগারে। তাই পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রেও অদূর ভবিষ্যতে রেলকে আরও সময়োপযোগী কাঠামো ও বেসরকারি বিনিয়োগের পথ বেছে নিতে হতে পারে বলে মনে করছেন রেলের কর্মীরাই।
নতুন ট্রেন চালানোর স্বপ্ন দেখালেও চলতি বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে ব্যর্থ হয়েছে রেল। বাজেট নথি বলছে, লক্ষ্য থেকে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার কম আয় হয়েছে। বেড়েছে অপারেটিং রেশিয়ো। নতুন লাইন নির্মাণ, ডাবলিং, ট্রাকের মেরামতি ও বন্দে ভারতের মতো ট্রেনসেট নির্মাণে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করে পরিকাঠামো উন্নয়ন খাতে খরচ বাড়ানো হয়েছে।
রেলের খবর, চৌম্বক ট্রেনের জন্য বিদেশি সংস্থাগুলিকে আগ্রহপত্র পেশ করতে বলা হয়েছে। কয়েকটি সংস্থা ইতিমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে। নতুন ধরনের এই উচ্চগতির ট্রেন এখন বাণিজ্যিক ভাবে চালানো হচ্ছে চিনে। রেলের জন্য এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা একটি নতুন বাণিজ্য পরিকল্পনা।
রেলের ভাঁড়ারের দুর্দশায় যে সব উচ্চপদস্থ কর্তা চিন্তিত, তাঁদের প্রশ্ন, আয় বুঝেই তো ব্যয় করা উচিত। আয় লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোচ্ছে না জেনেও যাত্রী পরিষেবায় ক্রমাগত ভর্তুকি দিয়ে চলেছে মন্ত্রক। পণ্য পরিবহণে রেল ভাল করলেও, যাত্রীভাড়ায় ভর্তুকি, অন্যান্য খাত থেকে আশানুরূপ আয় না হওয়ায় বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে রেলকে।