আর আন্তর্জাতিক মঞ্চে কথার লড়াই নয়। এ বার সরাসরি পাকিস্তানের মালবাহী জাহাজকে নিশানা করল ইজ়রায়েল। তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি) ভর্তি ওই ট্যাঙ্কারে আছড়ে পড়ে ইহুদিদের ড্রোন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট বিস্ফোরণের পাশাপাশি দাউ দাউ করে জলে ওঠে জাহাজ। সেই ছবি প্রকাশ্যে আসতেই ইসলামাবাদে ছড়িয়েছে আতঙ্ক। তেল আভিভের এ-হেন পদক্ষেপকে নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন কূটনীতিকদের একাংশ।
চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর পাক ট্যাঙ্কারে ইজ়রায়েলি ড্রোন হামলা নিয়ে মুখ খোলেন ইসলামাবাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নকভি। সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এক্সে (আগে নাম ছিল টুইটার) করা একটি পোস্টে তিনি জানিয়েছেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর ইয়েমেনের রাস আল-ইসা বন্দরে নোঙর করে তাঁদের মালবাহী জাহাজ। তখনই হঠাৎ এতে ড্রোন হামলা চালায় ইজ়রায়েল। ফলে জাহাজটির ভিতরে থাকা একটি এলপিজি ট্যাঙ্কে আগুন ধরে যায়।
ইসলামাবাদের দাবি, সংশ্লিষ্ট ট্যাঙ্কারটিতে নাবিক-সহ মোট ২৭ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ২৪ জনই পাক নাগরিক। বাকিদের মধ্যে দু’জন শ্রীলঙ্কা এবং একজন নেপালের বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। ড্রোন হামলার পর জাহাজটিকে আগুন ধরে যায়। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন তাঁরা। এতে কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
নকভির কথায়, ‘‘ড্রোন হামলার কিছু ক্ষণের মধ্যেই সেখানে চলে আসে হুথি বিদ্রোহীদের একটি দল। ছোট নৌকা নিয়ে জাহাজটিকে ঘিরে ফেলে তাঁরা। তাঁদের হাতে পণবন্দি হন ট্যাঙ্কারের সমস্ত কর্মী। পরে অবশ্য তাঁদের ছেড়েও দেওয়া হয়।’’ পাক ট্যাঙ্কারটি বর্তমানে ইয়েমেনের জলসীমার বাইরে রয়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
পাক গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হুথিদের হাতে আটকে থাকা এলপিজি বোঝাই জাহাজটিকে ছাড়িয়ে আনতে যথেষ্টই কসরত করতে হয়েছে ইসলামাবাদকে। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র সচিব খুররম আগা এবং ওমানে নিযুক্ত পাক রাষ্ট্রদূত নাভেদ বুখারি। এ ছাড়া সৌদি আরবে নিযুক্ত ইসলামাবাদের বিদেশ মন্ত্রকের আধিকারিক ও কর্মীদেরও এ ব্যাপারে কাজে লাগিয়েছিল ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ অবশ্য পাকিস্তানের এই বিবৃতি দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের দাবি, এলপিজি বোঝাই জাহাজে ইজ়রায়েলি ড্রোন হামলা নিয়ে ‘অর্ধ সত্য’ তথ্য প্রকাশ করছে ইসলামাবাদ। হুথিদের জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মনগড়া তত্ত্ব। ১৭ সেপ্টেম্বর ইহুদিদের বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোন ট্যাঙ্কারে আছড়ে পড়ার ১০ দিন পর সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন নকভি। মাঝের সময়টা কেন চুপ ছিলেন তিনি? উঠছে প্রশ্ন।
দ্বিতীয়ত, ইজ়রায়েলের কট্টর শত্রু হিসাবে পরিচিত ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা পুরোপুরি ভাবে প্যালেস্টাইনপন্থী। পশ্চিম এশিয়ায় ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেছে তারা। এর জেরে হুথিদের প্রতি বরাবর সহানুভূতি দেখিয়ে এসেছে পাকিস্তান। তা হলে বিপদের সময়ে ইসলামাবাদের এলপিজি বোঝাই জাহাজ কেন আটক করল ওই সশস্ত্র গোষ্ঠীর যোদ্ধারা?
তৃতীয়ত, ট্যাঙ্কার এবং সেখানে থাকা নাবিক ও কর্মীদের কত দিন হুথিরা পণবন্দি রেখেছিল, তা জানাননি নকভি। কোন শর্তে তাঁদের ছেড়ে দিল পশ্চিম এশিয়ার ওই প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী? অতীতে এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিপুল টাকার লেনদেন হতে দেখা গিয়েছে। আর্থিক সঙ্কটের সঙ্গে লড়তে থাকা ইসলামাবাদের পক্ষে তা দেওয়া কষ্টকর।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এর আগে কখনও কোনও পাক জাহাজকে এ ভাবে নিশানা করেনি ইজ়রায়েল। ফলে বিশ্লেষকদের অনেকেই এই ঘটনাকে ইসলামাবাদের উপরে প্রথম ইহুদি হামলা হিসাবে দেখছেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে পাকিস্তান। ওই দিনই ইসলামাবাদের মালবাহী জাহাজে ইহুদি ড্রোন হামলার আলাদা তাৎপর্য রয়েছে, বলছেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ।
পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে সদ্য সই হওয়া প্রতিরক্ষা চুক্তিতে বলা হয়েছে, যে কোনও একটি দেশ অপর কোনও রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে দু’পক্ষই তাকে যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করবে। ঠিক তার পরেই সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটি নিয়ে একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজ়া আসিফ। ‘জিয়ো নিউজ’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রিয়াধকে ‘আণবিক নিরাপত্তা’র আশ্বাস দেন তিনি।
পাক গণমাধ্যমটির প্রশ্ন ছিল, সঙ্কটের সময়ে সৌদি আরবকে পরমাণু অস্ত্রের সহায়তা দেবে ইসলামাবাদ? জবাবে খোয়াজ়া আসিফ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই। আমাদের কাছে যা আছে, আমাদের যতটা ক্ষমতা, এই চুক্তির অধীনে সবটাই ব্যবহার করা যাবে।’’ এর পাশাপাশি পরমাণু অস্ত্রের ব্যাপারে পাকিস্তান খুবই দায়িত্বশীল রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এই চুক্তিটির পরেই ইহুদিদের সরাসরি নিশানায় চলে এসেছে পাকিস্তান। প্রতিবেশী আরব দেশে ইসলামাবাদের সেনা বা আণবিক হাতিয়ার মোতায়েন হোক, তা মেনে নেওয়া ইজ়রায়েলের পক্ষে কোনও অবস্থাতেই সম্ভব নয়। ফলে আগামী দিনে এই ধরনের আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে পারে তেল আভিভ।
সাবেক সেনাকর্তাদের অনুমান, ইয়েমেনের বন্দরে থাকা জাহাজে হামলার মাধ্যমে পাকিস্তানকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে ইজ়রায়েল। ইসলামাবাদের জ্বালানি সম্ভার যে তাঁদের নাগালের মধ্যেই রয়েছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে ইহুদিরা। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট ঘটনার পর চুক্তি অনুযায়ী, সৌদি আরব কতটা ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির পাশে দাঁড়ায় সেটাও দেখতে চাইছে তেল আভিভ।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এর পরও পাক পরমাণু হাতিয়ার সৌদি আরবে মোতায়েন আরও আগ্রাসী হবে ইজ়রায়েল। সে ক্ষেত্রে বেছে বেছে ইসলামাবাদ ও রিয়াধের সেনাকর্তাদের নিকেশ করতে পারে ইহুদিদের গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ। প্রয়োজনে ওই দুই দেশে সামরিক অভিযান চালাতেও পিছপা হবে না তারা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, দু’টি জায়গাতেই মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সংঘাত পরিস্থিতিতে তাদের সমর্থন যে পুরোপুরি ভাবে থাকবে ইহুদি রাষ্ট্রটিক দিকে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গত ৯ সেপ্টেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় বোমাবর্ষণ করে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী। ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে রাষ্ট্রপুঞ্জে বিবৃতি দেয় পাকিস্তান। ইসলামাবাদের প্রতিনিধি বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে কাতারে বেপরোয়া বোমাবর্ষণ করেছে ইহুদি বায়ুসেনা। তাদের এই বেআইনি কার্যকলাপ দোহার সার্বভৌমত্বে আঘাতের সামিল।’’ এর পরই ইজ়রায়েলি আইনজীবী হিলাল নিউয়ারকে জবাব দেওয়ার জন্য মাত্র চার সেকেন্ড সময় দেন আন্তর্জাতিক সংগঠনটির সভাপতি।
সঙ্গে সঙ্গে বলতে উঠে ইসলামাবাদকে নিয়ে মাত্র সাতটি শব্দ খরচ করেন ইহুদি কৌঁসলী। তাঁর কথায়, ‘‘রাষ্ট্রীয় মদতে সন্ত্রাসবাদ চালানো দেশ হল পাকিস্তান।’’ ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। আর তাই অতীতে কখনওই কোনও অন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের সরাসরি নিশানা করেনি ইজ়রায়েল। সেই বাঁধা ছক ভেঙে হিলেল বেরিয়ে আসায় তাঁর বক্তব্যকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।
রাষ্ট্রপুঞ্জে পাকিস্তান এবং ইজ়রায়েলের মুখোমুখি সংঘাত এর পরও থামেনি। পরে নিরাপত্তা পরিষদে এই নিয়ে আলোচনার ফের একবার তেল আভিভকে নিশানা করেন ইসলামাবাদের রাষ্ট্রদূত আসিম ইফতিকার আহমেদ। ইহুদিদের স্থায়ী প্রতিনিধি তথা রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যাননের বক্তব্যকে মাঝপথে থামিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদের নাম করে বিদেশের মাটিকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এটা কখনওই বরদাস্ত করা উচিত নয়।’’ এর পাশাপাশি দোহায় হামলাকে ইজ়রায়েলের ‘বৃহত্তর আগ্রাসন’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আসিম ইফতিকারের এই মন্তব্যের পর কুখ্যাত জঙ্গি গোষ্ঠী অল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনের প্রসঙ্গ টেনে ইসলামাবাদকে আয়না দেখান ইহুদি রাষ্ট্রদূত ড্যানি। পাল্টা যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তানে ঢুকে বিন লাদেনকে নির্মূল করা হয়েছিল। তখন বিদেশের মাটিতে কেন জঙ্গি নেতাকে নিকেশ করা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন কেউ তোলেননি। আসল প্রশ্নটা হল, কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের কেন আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে? লাদেনের ক্ষেত্রে যদি কোনও দায় না থাকে, তা হলে হামাসের ক্ষেত্রেও থাকবে না।’’
গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের পরমাণু কেন্দ্রগুলিকে নিশানা করতে চেয়েছিল ইজ়রায়েল। যদিও নানা কারণে শেষ পর্যন্ত বাতিল হয় সেই অভিযান। তবে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয় তেল আভিভ। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসলামাবাদকে নিশানা করার পর যে ভাবে পাকিস্তানের মালবাহী জাহাজে তারা হামলা চালাল, তাতে পশ্চিমের প্রতিবেশীর কপাল পুড়তে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।