থমথমে ইউরোপের আকাশে ফের ঘনাচ্ছে যুদ্ধের কালো মেঘ! এ বার মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়াতে পারে নেটো ও রাশিয়া। ইতিমধ্যেই মস্কোকে সেই হুঙ্কার দিয়েছেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের এক পদস্থ সেনাকর্তা। পাল্টা হুঁশিয়ারি দিতে দেরি করেনি ক্রেমলিন। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি বাড়ছে পরমাণু সংঘর্ষের আতঙ্ক। এই লড়াইয়ের আঁচ যে ভারতের গায়েও লাগবে, তা বলা বাহুল্য।
নেটো অর্থাৎ ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন’ (উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা)। ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে জন্ম হওয়া মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই ইউরোপীয় সামরিক জোটের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ৩২। বর্তমানে এর মিলিটারি কমিটির চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন ইটালীয় নৌসেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল জ়িউসেপ্পে কাভো ড্রাগনে। সম্প্রতি, ‘আগ্রাসী’ রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগাম ‘আক্রমণাত্মক’ পদক্ষেপের পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনি। তাঁর ওই মন্তব্য ছাই চাপা আগুনকে উস্কে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
রাশিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযান নিয়ে ঠিক কী বলেছেন অ্যাডমিরাল ড্রাগনে? তাঁর কথায়, ‘‘মস্কোর হামলা কিন্তু আর ইউক্রেন সীমানার মধ্যে আটকে নেই। নেটো-ভুক্ত একাধিক দেশে ক্রমাগত সাইবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন। অনেক সময়েই আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে ওদের ড্রোন ও গুপ্তচর বিমান। এই পরিস্থিতিতে চুপ করে বসে থাকা বোকামির শামিল। আত্মরক্ষার্থে আমাদের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ করা উচিত।’’ তবে এ ব্যাপারে আইনগত জটিলতা যে রয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন ইটালীয় অ্যাডমিরাল।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট নেটোর একটি নিজস্ব সংবিধান রয়েছে। তার পাঁচ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ৩২টি সদস্য রাষ্ট্রের যে কেউ অন্য কোনও শক্তি দ্বারা আক্রান্ত বা আগ্রাসনের শিকার হলে, বাকি দেশগুলি তাকে যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করবে। ড্রাগনে মনে করেন, এই আইনের জন্য নেটোর পক্ষে আগাম মস্কোকে আক্রমণ করা বেশ কঠিন। তিনি বলেছেন, ‘‘প্রতিরক্ষার জন্য আগাম হামলা আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা এবং আচরণের আওতাভুক্ত নয়। আর তাই বেয়াদপি করার সুযোগ পাচ্ছে ক্রেমলিন।’’
গত ৯-১০ সেপ্টেম্বর রাতে নেটোর অন্যতম সদস্য দেশ পোল্যান্ডের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বেশ কয়েকটি রুশ সামরিক ড্রোন। বিষয়টি নজরে আসতেই তৎপর হয় ওয়ারশ। মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলির মধ্যে অন্তত আটটিকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয় তারা। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ড্রোনগুলির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে পোলিশ বাহিনী। এই ঘটনার পরই পূর্ব ইউরোপের দেশটি অচিরেই মস্কোর আক্রমণের শিকার হতে চলেছে বলে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা।
নেটো-ভুক্ত দেশগুলির এই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়। কারণ, পোল্যান্ড দখলের মাধ্যমে বাল্টিক সাগরের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে পারে রাশিয়া। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশটির গায়ে কালিনিনগ্রাদ নামে মস্কোর একটি শহর রয়েছে। ক্রেমলিনের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে এটি সম্পূর্ণ ভাবে নেটো দ্বারা পরিবেষ্টিত। ফলে কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকায় ঝটিতি আক্রমণ শানাতে পারে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিম ইউরোপীয় সামরিক জোট। ওয়ারশ কব্জা করে সেই আশঙ্কা দূর করতে চাইছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আবার মনে করেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ফেরাতে চাইছে মস্কো। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তার সূচনা করেছেন পুতিন। পোল্যান্ড তাঁর হাতে এলে পূর্ব ইউরোপের তিনটি দেশ— এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া নেটোর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আলাদা করে কোনও অস্তিত্ব ছিল না। এগুলি ছিল ওই ইউনিয়নের অংশ।
এই পরিস্থিতিতে রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে তৎপর হয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট। সংবিধানের চার নম্বর ধারাকে বলবৎ করে তারা। ওয়ারশর পাশে দাঁড়িয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম), লড়াকু জেট ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র পাঠিয়ে দেয় নেটোর অন্যান্য দেশ। এই সামরিক প্রস্তুতির নাম রাখা হয় ‘অপারেশন ইস্টার্ন সেন্ট্রি’। বছর শেষের মুখে এর সুফলের কথা অ্যাডমিরাল ড্রাগনেকে বলতে শোনা গিয়েছে।
নেটোর মিলিটারি কমিটির চেয়ারম্যানের দাবি, ‘‘অপারেশন ইস্টার্ন সেন্ট্রি চালু করায় বাল্টিক সাগরের দিকে কড়া নজরদারি রাখা গিয়েছে। ফলে রুশ টহলদারি লড়াকু জেট, গুপ্তচর বিমান, রণতরী এবং ড্রোনের আনাগোনা যথেষ্টই কমেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে মস্কোর সাইবার হামলা যে আমরা ঠেকাতে পারছি, এমনটা নয়। সেটা আগামী দিনে বিপজ্জনক হতে পারে। তাই আরও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।’’
অন্য দিকে জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ ফাঁস হয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানির যুদ্ধপ্রস্তুতির যাবতীয় পরিকল্পনা। মধ্য ইউরোপের এই দেশটিরও নেটোর সদস্যপদ রয়েছে। এ-হেন বার্লিনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রায় ১,২০০ পাতার গোপন নথি প্রকাশ্যে আসায় ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়েছে হইচই। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমটির দাবি, মস্কোর সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের কথা মাথায় রেখে আট লক্ষ সেনার একটা শক্তিশালী ফৌজ গড়ে তুলছে চ্যান্সেলার ফ্রিডরিখ মের্ৎজ়ের সরকার।
‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, নেটোর পতাকার নীচেই লড়াই করার পরিকল্পনা রয়েছে জার্মানির। সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের আতঙ্কে গত আড়াই বছর ধরে একটি শক্তিশালী ফৌজ তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছে বার্লিন। তাদের পরিকল্পনার সাঙ্কেতিক নাম ‘ওপেরাতসিওন প্লান ডয়েচলান্ড’। মার্কিন গণমাধ্যমটির দাবি, ২০২৫ সালের শেষে পৌঁছে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গতি এনেছেন চ্যান্সেলার ফ্রিডরিখ মের্ৎজ়। কয়েক দিন আগে এই নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট দিয়েছে বার্লিনের বিদেশ মন্ত্রক।
জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ফাঁস হওয়া নথিতে ‘ওপেরাতসিওন প্লান ডয়েচলান্ড’-এর একাধিক উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, এর মাধ্যমে দেশের সীমান্তেই রুশ ফৌজকে আটকে দিতে চাইছে বার্লিন। দ্বিতীয়ত, সংঘাত পরিস্থিতিতে সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যেও একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এককথায় কোনও রকম আগ্রাসনমূলক মনোভাব না দেখিয়ে লড়াইয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাইছেন জার্মানির নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে সেনা কমান্ডারেরা।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে হামবুর্গের স্টেট কমান্ডে বড়সড় একটি সামরিক মহড়ার আয়োজন করে জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। এর পোশাকি নাম ছিল ‘রেড স্টর্ম ব্রাভো’। পরে বার্লিনের ফৌজি সদর দফতরের এক সেনা কমান্ডার বলেন, ‘‘ওই মহড়ায় ছিলেন নেটোবাহিনীর সৈনিকেরাও। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ব দিকে কী ভাবে অগ্রসর হওয়া যায়, আমরা সেই অনুশীলন চালিয়েছি।’’ মাত্র দু’ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের বেশি পথ এগোনো গিয়েছে বলে স্পষ্ট করেন তিনি।
জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, ‘রেড স্টর্ম ব্রাভো’তে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে ড্রোন এবং আকাশ প্রতিরক্ষা (এয়ার ডিফেন্স) ব্যবস্থা। এ ছা়ড়া ছিল সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক এবং সৈনিক ট্রাকের কনভয়। তবে কামান, লড়াকু জেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র এতে ব্যবহার করা হয়নি। এই ধরনের মহড়া আগামী দিনে আরও বেশি পরিমাণে করা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বার্লিন।
নভেম্বরের মাঝামাঝি ফ্রাঙ্কফুর্টের একটি গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের গুপ্তচরেরা ক্রেমলিনের হাঁড়ির খবর জোগাড় করে এনেছেন। পুতিনের পরবর্তী লক্ষ্য নেটো-ভুক্ত কোনও দেশ। ২০২৮ বা ২০২৯ সালে পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবেন তিনি। সেই লক্ষ্যে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং লড়াকু জেটের বহর বৃদ্ধি করছেন তিনি।’’
গত শতাব্দীতে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’র (পড়ুন কোল্ড ওয়ার) সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণ ঠেকাতে নেটো গড়ে তোলে আমেরিকা। ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতন হলে এই সামরিক জোটের পূর্ব দিকে বিস্তার ঘটে। পশ্চিমি দুনিয়া ইউক্রেনকে নেটোর সদস্যপদ দিতে চেয়েছিল। তাতেই বাদ সাধে মস্কো। কারণ, সে ক্ষেত্রে ক্রেমলিনের একেবারে দরজার সামনে ঘাঁটি গেড়ে বসার সুযোগ পেত যুক্তরাষ্ট্র। ক্রেমলিনের বারণ সত্ত্বেও কিভ নাছোড়বান্দা হয়ে উঠলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান শুরু করেন পুতিন।
গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে সব সময় কিভকে সাহায্য করে এসেছে পশ্চিমি দুনিয়া। কিন্তু, এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে সরাসরি মস্কো আক্রমণের কথা বলতে শোনা গেল নেটোকে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পুতিন বলেছেন, ‘‘যদি ইউরোপ হঠাৎ করে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করতে চায়, আমরা তার জন্য এখনই প্রস্তুত।’’ ফলে দু’পক্ষের পারদ যে চড়ছে, তা বলাই বাহুল্য।
ইউরোপের এই সংঘাত বন্ধ করার চেষ্টা অবশ্য চালিয়ে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইতিমধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে ক্রেমলিনে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন তাঁর বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার। তবে সমাধানসূত্র এখনও মেলেনি। ফলে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় সেটাই এখন দেখার।