ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই আরও আগ্রাসী রাশিয়া। পোল্যান্ডকে এ বার নিশানা করতে পারে মস্কো। ওয়ারশর আকাশে ক্রেমলিনের ড্রোন ঢুকতেই পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়েছে সেই আতঙ্ক। তড়িঘড়ি পোল্যান্ডকে বাঁচাতে ছুটে এসেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন)। ফলে আগামী দিনে লড়াই আরও ভয়ানক হতে চলেছে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ৯-১০ সেপ্টেম্বর রাতে আকাশসীমা লঙ্ঘন করে পোল্যান্ডে ঢুকে পড়ে বেশ কয়েকটি রুশ সামরিক ড্রোন। বিষয়টি নজরে আসতেই তৎপর হয় ওয়ারশ। মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলির মধ্যে অন্তত আটটিকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয় তারা। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ড্রোনগুলির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে পোলিশ বাহিনী। এই ঘটনার পরই পূর্ব ইউরোপের আর একটি দেশে মস্কো সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে চলেছে বলে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির এ-হেন খবর প্রকাশের নেপথ্যে অবশ্য একাধিক কারণ রয়েছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) শুরু করার মুখে ঘনিষ্ঠ সহযোগী তথা প্রতিবেশী দেশ বেলারুশের সঙ্গে টানা চার দিন যুদ্ধাভ্যাস করে মস্কোর ফৌজ। চলে পরমাণু অস্ত্রের ড্রিলও। তার পরেই কিভ দখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রেমলিনের বাহিনী। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, পোল্যান্ডে সামরিক ড্রোন পাঠানোর পাশাপাশি বেলারুশের সঙ্গে ফের এক বার পুরনো মেজাজে মহড়ায় অংশ নিয়েছে রুশ সেনা।
গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ দিনের যুদ্ধাভ্যাস চালাচ্ছে মস্কো ও মিনস্কের ফৌজ। এর পোশাকি নাম ‘জ়্যাপাড’। রুশ ভাষায় শব্দটির অর্থ হল পশ্চিম। ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট মহড়াটি চলবে বলে জানা গিয়েছে। ইতিমধ্যেই মহড়ার ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। সেখানে ট্যাঙ্ক, লড়াকু জেট, রেডার, বোমারু বিমান এবং হামলাকারী ড্রোন নিয়ে দু’দেশের সৈনিকদের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে দেখা গিয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, পোল্যান্ড দখলের মধ্যে দিয়ে বাল্টিক সাগরের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে চাইছে রাশিয়া। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশটির গায়ে কালিনিনগ্রাদ নামে মস্কোর একটি শহর রয়েছে। ক্রেমলিনের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে এটি সম্পূর্ণ ভাবে নেটো দ্বারা পরিবেষ্টিত। ফলে কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকায় ঝটিতি আক্রমণ শানাতে পারে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিম ইউরোপীয় সামরিক জোট। ওয়ারশ কব্জা করে সেই আশঙ্কা দূর করতে চাইছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আবার মনে করেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ফেরাতে চাইছে মস্কো। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তার সূচনা করেছেন পুতিন। পোল্যান্ড তাঁর হাতে এলে পূর্ব ইউরোপের তিনটি দেশ— এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া নেটোর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আলাদা করে কোনও অস্তিত্ব ছিল না। এগুলি ছিল ওই ইউনিয়নের অংশ।
অন্য দিকে রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে তৎপর হয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নেটোও। পোল্যান্ডের ভিতরে মস্কোর সামরিক ড্রোন ঢুকতেই সংবিধানের চার নম্বর ধারাকে সক্রিয় করেছে তারা। ওয়ারশর পাশে দাঁড়িয়ে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম), লড়াকু জেট এবং অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র পাঠিয়েছে নেটো-ভুক্ত একাধিক দেশ। এই সামরিক প্রস্তুতির পোশাকি নাম ‘অপারেশন ইস্টার্ন সেন্ট্রি’ রাখা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন নেটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুটে। তিনি বলেন, ‘‘রুশ আগ্রাসন থেকে পোল্যান্ড সীমান্তকে রক্ষা করতে প্রাথমিক ভাবে ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং জার্মানির সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে।’’ তবে আগামী দিনে নেটো-ভুক্ত অন্য দেশগুলিও যে অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদ এবং রসদ পাঠাবে, তা স্পষ্ট করেছেন তিনি। সূত্রের খবর, বাল্টিক সাগরে মস্কোর অনুপ্রবেশ আটকাতে রণতরী মোতায়েন করেছে তারা।
এর পাশাপাশি সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের কথা মাথায় রেখে পোল্যান্ড সীমান্তে পাল্টা যুদ্ধাভ্যাস শুরু করেছে নেটোর ফৌজ। বিবৃতি দেওয়ার সময় তার একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করেন রুটে। সেখানে মস্কোর হাইপারসনিক (শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্রকে কী ভাবে ঠেকানো হবে, তার নমুনা দেখানো হয়েছে। অন্য দিকে এই ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির মূল চালিকাশক্তি আমেরিকার অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে পোল্যান্ডের আকাশসীমায় রুশ সামরিক ড্রোন ঢুকে যাওয়ার ঘটনাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি, নেটোর প্রতিটা ইঞ্চি সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতিও দেয় ওয়াশিংটন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে ‘নরম মনোভাব’ প্রকাশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেন, ‘‘আমার ধারণা, ভুল করে মস্কোর ড্রোন ওই এলাকায় ঢুকে পড়েছে। এতে চিন্তা করার মতো কিছু নেই।’’
পোল্যান্ড অবশ্য ট্রাম্পের এই যুক্তি নামতে নারাজ। ওয়ারশর বিদেশমন্ত্রী রাডোস্লাও সিকোরস্কি জানিয়েছেন, ভুলবশত রুশ সামরিক ড্রোন তাঁদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি। আসলে সুচতুর পুতিন নেটোর শক্তি পরীক্ষা করতে সেগুলিকে পাঠিয়েছিলেন। পাশাপাশি, আগ্রাসী মস্কোকে থামাতে ওয়াশিংটনের পূর্ণ সমর্থন চেয়েছেন তিনি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ ব্যাপারে ক্রেমলিনের সরকারি বিবৃতির সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছে ট্রাম্পের বক্তব্য।
পোল্যান্ডকাণ্ডের পর রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে রুশ প্রতিনিধি তথা রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ‘‘ইউক্রেনের একটি শহর লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালানো হয়েছিল। ওই সময় দিকনির্ণয়ে সমস্যার কারণে কয়েকটি মানববিহীন উড়ুক্কু যান পোল্যান্ডের দিকে চলে যায়।’’ এ ছাড়া বেলারুশের সঙ্গে যুদ্ধাভ্যাসের ব্যাখ্যাও দিয়েছে মস্কো। ক্রেমলিনের দাবি, ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতি চার বছর অন্তর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে এই মহড়ায় অংশ নিচ্ছে তাদের বাহিনী। সোভিয়েত-উত্তর যুগে এটি সমন্বয় বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে ‘জ়্যাপাড’ যুদ্ধাভ্যাসে অংশ নেয় দুই দেশের প্রায় দু’লক্ষ সৈনিক। সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বার আরও বৃদ্ধি পেতে পারে সেই সংখ্যা। সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট মহড়ায় কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধের পাঠ ভাল ভাবে নেওয়ার চেষ্টা করছে মস্কো-মিনস্কের যৌথ ফৌজ। ফলে সম্ভাব্য পোল্যান্ড আক্রমণ ইউক্রেনের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে পুতিনের পক্ষে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ফেরানোর স্বপ্ন সত্যি করা মোটেই সহজ নয়। কারণ, ৩২টি দেশের সংগঠন নেটোর সামরিক শক্তি ধারে ও ভারে মস্কোর চেয়ে অনেকটাই বেশি। সেখানে তিনটি পরমাণু হাতিয়ারযুক্ত রাষ্ট্র রয়েছে। তারা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। এ ছাড়া আছে জার্মানি, ডেনমার্ক, ইটালি, স্পেন, পর্তুগাল এবং তুরস্কের মতো দেশ, যাদের ফৌজি ক্ষমতা প্রশ্নাতীত।
তবে এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই নেটোয় ভাঙন ধরাতে পেরেছেন পুতিন। কারণ সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির অন্তর্গত তুরস্কের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক মধুর। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় কানাডা ইউরোপীয় যুদ্ধে আদৌ জড়াতে চাইবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। একই কথা ইটালি, স্পেন এবং পর্তুগালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এ ছাড়া ট্রাম্প জমানায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে, তা একেবারেই স্পষ্ট নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার আগে নেটোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। এখনও সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে আপত্তি আছে তাঁর। তবে পশ্চিম ইউরোপকে অত্যাধুনিক হাতিয়ার দিয়ে সাহায্য করতে পারে ওয়াশিংটন।
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এ জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। ওই সময় ১৯৪৯ সালে পশ্চিম ইউরোপের ১১টা দেশ নিয়ে নেটো গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র। সংশ্লিষ্ট সামরিক সংগঠনটির সংবিধানের পাঁচ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে যে, অন্য কোনও রাষ্ট্র নেটো-ভুক্ত কোনও দেশকে আক্রমণ করলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামবে বাকি সমস্ত সদস্য। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রয়েছে এর সদর দফতর।
‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এর সময় ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৫ সালে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে মস্কো। সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটির নিয়মকানুন ছিল নেটোর মতোই। ওয়ারশ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড এবং রোমানিয়া। পরবর্তী কালে এই দেশগুলির বেশ কয়েকটির বিলুপ্তি ঘটে। উদাহরণ হিসাবে চেকোস্লোভাকিয়া ও পূর্ব জার্মানির কথা বলা যেতে পারে। প্রথমটি ভেঙে তৈরি হয় একাধিক দেশ। দ্বিতীয়টি পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে মিশে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠন করেছে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে ১৫টি দেশ তৈরি হলে ভেঙে যায় ওয়ারশ চুক্তি। এর পরই ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে বিস্তার লাভ করতে থাকে নেটো। প্রথমে জার্মানি ও পোল্যান্ড এবং পরবর্তী কালে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া যোগ দেয় এই সংগঠনে। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৩২-এ পৌঁছে গিয়েছে। পুতিনের অভিযোগ, মস্কোকে চারদিক থেকে ঘেরার চেষ্টা করছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নেটো। আর তাই মস্কোর দরজার সামনে বাহিনীকে এনে বসাতে চাইছে তারা।
১৯৩৯ সালে সেপ্টেম্বরে অ্যাডল্ফ হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে দিয়ে সূচনা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধের, যা পরবর্তী ছ’বছর চলেছিল। রাশিয়া শেষ পর্যন্ত ওয়ারশতে হামলা চালালে সেই স্মৃতি ফিরতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। নেটোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চিন, উত্তর কোরিয়া (ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা ডিপিআরকে) এবং ইরানের সমর্থন মস্কোর দিকে থাকবে বলে মনে করছেন তাঁরা।