সময়টা ১৯৮০-এর দশক! সে সময় একের পর এক সন্ত্রাসবাদী হামলা ও বিমান অপহরণের মতো ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছিল ভারত। বিশেষ করে ১৯৮৪-এর অপারেশন ব্লু স্টারের পর পঞ্জাবে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। এমন পরিস্থিতিতে ভারত বুঝতে পারে এই আন্দোলন ঠেকাতে হলে বিশেষ সন্ত্রাসদমন বাহিনীর প্রয়োজন রয়েছে, যে বাহিনীর সদস্যদের তৈরি করা হবে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে সংসদে ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড অ্যাক্ট (এনএসজি অ্যাক্ট ১৯৮৬) পাশ হয়। ওই বছরই আনুষ্ঠানিক ভাবে গঠিত হয় ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড’ (এনএসজি) বাহিনী। সাধারণ মানুষ যাঁদের ‘ব্ল্যাক ক্যাটস’ নামেও চেনেন। এই বাহিনী তৈরির পরিকল্পনার নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টারা।
জার্মানির জিএসজি-৯ (অ্যান্টি টেরর ফোর্স) এবং ব্রিটেনের এসএএস (স্পেশ্যাল এয়ার সার্ভিস)-এর বাহিনীর নকশা ধরেই তৈরি হয়েছে এই সন্ত্রাসদমন বাহিনী। এনএসজি-র দু’টি বিভাগ রয়েছে। প্রথমটা স্পেশ্যাল অ্যাকশন গ্রুপ (এসএজি) এবং দ্বিতীয়টি স্পেশ্যাল রেঞ্জার গ্রুপ (এসআরজি)।
এই দু’টি বিভাগই মুখ্য ভূমিকা নেয় কোনও অভিযান চলার সময়। এসএজি-কে ‘অ্যাকশন টিম’ বলা হয়। সেখানে থাকেন সেনাবাহিনীরা। সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের ময়দানে নামেন এঁরা। অন্য দিকে, এসআরজি দলকে বলা হয় ‘সাপোর্ট টিম’। এই দলে সিআরপিএফ, বিএসএফ সদস্যেরা থাকেন। এঁরা মূলত সুরক্ষা ও সহায়তার কাজে যুক্ত থাকেন।
১৯৮৬-এর অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার, ১৯৯৩-এর অপারেশন অশ্বমেধ, ১৯৯১-এর অপারেশন বজরং, ২০০২-এর অপারেশন অক্ষরধাম, ২০০৮-এর অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো (যা ২৬/১১ মুম্বই হামলা নামে পরিচিত), ২০১৬-এর অপারেশন গাজ়ি এবং অপারেশন পার্ল— এই সব ক’টি অভিযানেই ‘ব্ল্যাক ক্যাটস’-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তবে শুধু এই অভিযানগুলিই রয়েছে এমনটা নয়। সাম্প্রতিক ভারত-পাক সংঘাতের সময় সেনা ও বিমানবাহিনীর পাশাপাশি ‘ব্ল্যাক ক্যাটস’ও ভূমিকা নিয়েছিল। শত্রুপক্ষের বহু অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করেছিলেন এনএসজি সদস্যেরা। এ ছাড়াও সীমান্তে উচ্চ সতর্কতায় বাহিনী মোতায়েন-সহ আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব ছিল তাঁদের উপর।
এই দলে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণের। এই দলের সদস্যপদের জন্য ভারতীয় সেনা এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশবাহিনী থেকে প্রার্থী বাছাই করা হয়। বাছাই হওয়া প্রার্থীদের কঠোর প্রশিক্ষণ মেলে, যাতে পরবর্তী কালে তাঁরা এনএসজি সেনা হিসাবে গুরুদায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন। এর জন্য বিশেষ সরঞ্জামও সরবরাহ করা হয় তাঁদের।
এই দলে যুক্ত হওয়ার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর (স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী) কর্মী হতে হয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশবাহিনী (সিআরপিএফ, বিএসএফ, আইটিবিপি বা সিআইএসএফ)-তে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিরাও আবেদন করতে পারেন। তবে সব ক্ষেত্রেই কর্মজীবনে ন্যূনতম তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
আবেদনের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বয়সের মাপকাঠিও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে কোনও স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক হওয়া বাধ্যতামূলক। প্রার্থীর বয়স ৩৫ বছরের মধ্যে হতেই হবে। এনএসজি-তে খুবই কঠোর প্রশিক্ষণ চলে, তাই শারীরিক এবং মানসিক ভাবেও সুস্থ থাকতে হয়।
এনএসজি-তে কখনও কোনও কর্মীকে সরাসরি নিয়োগ করা হয় না। ডেপুটেশনের ভিত্তিতে কাজ করতে হয় এই বিভাগে। সে ক্ষেত্রে প্রার্থী যে বিভাগে কর্মরত সেখানকার অনুমতিপত্র জমা দিতে হয়। অর্থাৎ, কেউ যদি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কোনও শাখা থেকে এনএসজি-তে আসতে আগ্রহী হন, তখন তাঁকে বাধ্যতামূলক ভাবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সম্মতিপত্র প্রদান করতে হয়।
কর্মী নিয়োগের জন্য আলাদা ভাবে কোনও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে না এনএসজি। প্রয়োজন অনুযায়ী চাহিদাপত্র পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কাছে। সেখান থেকে আগ্রহী প্রার্থীরা আবেদন করতে পারেন।
পাঁচটি ধাপের মধ্যে দিয়ে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। প্রথমে চলে ডেপুটেশন প্রক্রিয়া। এর পর সম্মতিপত্র প্রদান। সেখান থেকে তালিকা অনুযায়ী যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রার্থীবাছাই প্রক্রিয়া চলে। অতঃপর বাছাই হওয়া প্রার্থীদের পাঠানো হয় প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে তাঁদের শারীরিক, মানসিক এবং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শেষ ধাপে চলে চূড়ান্ত পর্বের বাছাই প্রক্রিয়া। আগের দুই ধাপে সফল ভাবে উত্তীর্ণ হতে পারলেই এই ধাপে এনএসজি অফিসার পদে নিযুক্ত হওয়া যায়।
ন্যূনতম ১৬৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা হলে তবেই আবেদন করা যায়। যদিও বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। এ ছাড়াও নানা রকম শারীরিক মাপকাঠি রয়েছে। উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ওজন হতে হবে। খুব কম বা বেশি হলে বাছাই পর্বেই খারিজ হয়ে যায় আবেদনপত্র। চশমা ছাড়া দূরদৃষ্টি হতে হবে ৬/৬।
হার্ট ও ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কতটা রয়েছে তা-ও দেখা হয়। এ ছাড়াও, দীর্ঘ ক্ষণ না ঘুমিয়েও সক্রিয় থাকতে পারবেন কি না, আবেদনকারীদের উপর সেই পরীক্ষাও করা হয়। ছ’মিনিটের মধ্যে অন্তত ১৬০০ মিটার দৌড়ে সফল হতে হয় তাঁদের। প্রার্থী কত ভাল সাঁতারু তা-ও দেখা হয়।
এমন কঠোর প্রশিক্ষণের পর ডেপুটেশনের ভিত্তিতে কাজে নিয়োগ করা হয়। যেখানে কাজের মেয়াদ থাকে তিন থেকে পাঁচ বছর। মেয়াদ সম্পূর্ণ হওয়ার পর প্রার্থীদের আবার নিজেদের মূল বাহিনীতে ফিরে যেতে হয়। যদিও অনেক সময় প্রয়োজন অনুযায়ী এবং প্রার্থীর দক্ষতার ভিত্তিতে মেয়াদ বৃদ্ধিও করা হয়। সব সময় নতুন নতুন প্রার্থীকে খুঁজে পাওয়ার জন্য কম সময়ের মেয়াদ রাখা হয়।
ভারতের মানেসর, গুরুগ্রামে এনএসজি-র প্রধান প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। এই দু’টি জায়গাতেই সন্ত্রাসদমনের সব ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সাধারণত ন’মাস ধরে চলে প্রশিক্ষণ। শারীরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রার্থীর ভয়, নিদ্রার উপর নিয়ন্ত্রণ, অতিরিক্ত চাপ সামলানোর ক্ষমতা-সহ সব কিছুর প্রশিক্ষণই কঠোর ভাবে চলে। দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত দলের মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশই প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া শেষ করে উঠতে পারেন।
মূলত সন্ত্রাস দমনের কোনও অভিযান থাকলে, বিশিষ্টদের সুরক্ষার স্বার্থে, বিমান ছিনতাই প্রতিরোধে, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ এবং উদ্ধার করার কাজে যুক্ত থাকতে হয় ‘ব্ল্যাক ক্যাটস’দের। সাম্প্রতিক কালের অপারেশন সিঁদুর অভিযানে বড় ভূমিকা ছিল এনএসজি-র। ২৬/১১-এর মুম্বই হামলায় বহু সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করেছিল এনএসজি।
যে কোনও অভিযানেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ মানতে হয় এনএসজি-কে। তবে সে ক্ষেত্রেও বিশেষ কমিটি গঠন হয়। যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও এনএসজি প্রধান, বাছাই করা আইপিএস এবং সেনার উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা থাকেন। কোনও অভিযান শুরুর আগে অনেক দিন ধরে দীর্ঘ ক্ষণের বৈঠক করেন শীর্ষকর্তারা। প্রথমে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। তার পর সময় মেনে শুরু হয় অভিযান।
বলা হয়, কালো রং গোপনীয়তা, শক্তি ও শত্রুর চোখ এড়িয়ে চলার ক্ষমতার প্রতীক। এনএসজি-র সদস্যদের পরনে থাকে কালো হেলমেট, কালো মাস্ক, কালো বুট, কালো গ্লাভস, কালো জামা। পোশাকেও এনএসজি-র কালো রঙেরই ব্যাচ লাগানো থাকে। এঁরা বিড়ালের মতো নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারেন। এই সব কারণে সরকারি ভাবে না হলেও প্রচলিত ভাবে এনএসজি সদস্যদের নাম হয়ে গিয়েছে ‘ব্ল্যাক ক্যাটস’।
এই বাহিনীর সদস্যদের দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়। শুধু দূরত্বই নয়, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখারও সুযোগ থাকে না তাঁদের। ২৪x৭ কাজ করে যেতে হয় এঁদের। কেবল ভাল পদ, ভাল বেতন, বিশেষ সম্মান পাওয়া যায় এমনটাই নয়, এই বিভাগে কাজের জন্য প্রয়োজন দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং একাগ্রতা। কঠোর প্রশিক্ষণ সামাল দেওয়া, নিজের প্রতি ভরসা এবং বিশ্বাসেই এক জন সেনা ‘ব্ল্যাক ক্যাটস’ বাহিনীতে নাম লেখাতে পারেন।