প্রথমে ভারত। তার পর ইজ়রায়েল। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফের এক বার দুই ‘বন্ধু’র হাতে বিরাশি সিক্কার জোড়া থাপ্পড় খেল পাকিস্তান! এর মধ্যে ইহুদিদের অপমান ছিল আরও এককাঠি উপরে। কারণ মাত্র চার সেকেন্ডে ‘গোটা অপারেশন’ শেষ করে দেন এক ইজ়রায়েলি আইনজীবী। শুধু তা-ই নয়, ওই ঘটনার পর দুনিয়ার সামনে উঠে এসেছে একটিই প্রশ্ন। সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়া কোনও দেশের সদস্যপদ রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে থাকা কতটা যুক্তিযুক্ত?
চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় বোমাবর্ষণ করে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী। ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে রাষ্ট্রপুঞ্জে বিবৃতি দেয় পাকিস্তান। ইসলামাবাদের প্রতিনিধি বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে কাতারে বেপরোয়া বোমাবর্ষণ করেছে ইহুদি বায়ুসেনা। তাদের এই বেআইনি কার্যকলাপ দোহার সার্বভৌমত্বে আঘাতের সামিল।’’ এর পর ইজ়রায়েলি আইনজীবী হিলাল নিউয়ারকে জবাব দেওয়ার জন্য মাত্র চার সেকেন্ড সময় দেন আন্তর্জাতিক সংগঠনটির সভাপতি।
সঙ্গে সঙ্গে বলতে উঠে ইসলামাবাদকে নিয়ে মাত্র সাতটি শব্দ খরচ করেন ইহুদি কৌঁসলি। তাঁর কথায়, ‘‘রাষ্ট্রীয় মদতে সন্ত্রাসবাদ চালানো দেশ হল পাকিস্তান।’’ ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। আর তাই অতীতে কখনওই কোনও অন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের সরাসরি নিশানা করেনি ইজ়রায়েল। সেই বাঁধা ছক ভেঙে হিলাল বেরিয়ে আসায় তাঁর বক্তব্যকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
কানাডার বাসিন্দা হিলাল বর্তমানে রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। কাতারকাণ্ডের পর সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইজ়রায়েলের প্রবল সমালোচনা শুরু হলে মাতৃভূমির পক্ষে যুক্তিজাল সাজিয়ে সেখানে হাজির হন তিনি। দোহার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে বোমাবর্ষণ চালিয়েছে ইহুদি বিমানবাহিনী। সেটা এড়াতে চাইছেন অথচ কুখ্যাত জঙ্গিদের রাজধানীতে আশ্রয় দিচ্ছেন। দিনের পর দিন বিলাসবহুল হোটেলে থাকছেন তাঁরা। কেন এই দ্বিচারিতা?’’
রাষ্ট্রপুঞ্জে পাকিস্তান এবং ইজ়রায়েলের মুখোমুখি সংঘাত এখানেই থামেনি। পরে নিরাপত্তা পরিষদে এই নিয়ে আলোচনার ফের এক বার তেল আভিভকে নিশানা করেন ইসলামাবাদের রাষ্ট্রদূত আসিম ইফতিকার আহমেদ। ইহুদিদের স্থায়ী প্রতিনিধি তথা রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যাননের বক্তব্যকে মাঝপথে থামিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদের নাম করে বিদেশের মাটিকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এটা কখনওই বরদাস্ত করা উচিত নয়।’’ এর পাশাপাশি দোহায় হামলাকে ইজ়রায়েলের ‘বৃহত্তর আগ্রাসন’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
আসিম ইফতিকারের এই মন্তব্যের পর কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা-বিন লাদেনের প্রসঙ্গ টেনে ইসলামাবাদকে আয়না দেখান ইহুদি রাষ্ট্রদূত ড্যানি। পাল্টা যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তানে ঢুকে বিন লাদেনকে নির্মূল করা হয়েছিল। তখন বিদেশের মাটিতে কেন জঙ্গিনেতাকে নিকেশ করা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন কেউ তোলেননি। আসল প্রশ্নটা হল, কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের কেন আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে? লাদেনের ক্ষেত্রে যদি কোনও দায় না থাকে, তা হলে হামাসের ক্ষেত্রেও থাকবে না।’’
রাষ্ট্রপুঞ্জের সবচেয়ে শক্তিশালী অঙ্গ হল নিরাপত্তা পরিষদ। পাঁচ স্থায়ী এবং ১০ অস্থায়ী দেশ মিলিয়ে এর মোট সদস্যসংখ্যা ১৫। স্থায়ী সদস্যেরা হল আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। অস্থায়ী সদস্যদের দু’বছরের জন্য নির্বাচন করা হয়। তবে তাদের কোনও ভিটো ক্ষমতা নেই। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সংগঠনে অস্থায়ী সদস্য হিসাবে থাকবে পাকিস্তান। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কাতারকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইজ়রায়েলকে কোণঠাসা করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে ইসলামাবাদ।
বিশ্লেষকদের দাবি, পাকিস্তানের এ-হেন পদক্ষেপের নেপথ্যে দ্বিমুখী উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তার পরিষদে ইহুদিবিরোধী বক্তব্য রেখে আরব দুনিয়ার ইসলামীয় দেশগুলির কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চাইছে ইসলামাবাদ। কারণ, আর্থিক দুরবস্থা কাটতে তাদের ‘কৃপাদৃষ্টি’ থেকে বঞ্চিত হতে নারাজ ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী। দ্বিতীয়ত, নীতিগত ভাবে তেল আভিভের অস্তিত্ব স্বীকার করে না তারা। আর তাই এখনও ইজ়রায়েলকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি পাক সরকার।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে বিমান ছিনতাই করে ভয়ঙ্কর ফিদায়েঁ হামলা চালায় আল কায়দা। চোখের নিমেষে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার) জোড়া অট্টালিকাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় তারা। তদন্তে এর ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে উঠে আসে লাদেনের নাম। অন্য দিকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলে ঢুকে বড়সড় আক্রমণ শানায় ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। নিরাপত্তা পরিষদের ভাষণে এই দুই ঘটনার মধ্যে তুলনা টানেন ড্যানি।
রাষ্ট্রপুঞ্জে তেল আভিভের প্রতিনিধি বলেন, ‘‘৭ অক্টোবর আমাদের কাছে ৯/১১-র মতোই একটা দুঃস্বপ্নের দিন। হয়তো তার চেয়েও কিছুটা ভয়ঙ্কর। কারণ, ওই তারিখে শুধু আগুন আর রক্তই দেখেছে ইজ়রায়েল।’’ উল্লেখ্য, ইহুদিভূমিতে ঢুকে আক্রমণের পর হামাসকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন জানায় পাকিস্তান। শুধু তা-ই নয়, ইসলামাবাদের ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে এই নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। প্রতি বারই ‘ইসলামীয় ভ্রাতৃত্ববোধ’-এর (ইসলামিক ব্রাদারহুড) কথা বলে প্যালেস্টাইনপন্থী গোষ্ঠীটির পাশে দাঁড়ানোয় সায় দিতে দেখা গিয়েছে সেখানকার শাসক-বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে।
২০১১ সালের ২ মে পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের অ্যাবোটাবাদে বিন-লাদেনের গোপন আস্তানায় কমান্ডো অপারেশন চালায় মার্কিন ফৌজ। আর তাতে মৃত্যু হয় আল কায়দা প্রধানের। ঘটনার পর সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রশ্নের মুখে পড়ে ইসলামাবাদ। ফলে পিঠ বাঁচাতে লাদেনের লুকিয়ে থাকার বিষয়টি ‘জানা ছিল না’ বলে বার বার দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে পাক সরকার ও সেনা, যা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
অন্য দিকে ৭ অক্টোবরের হামলার পর হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইজ়রায়েল। গত দু’বছর ধরে চলছে সেই লড়াই। সম্প্রতি প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হতে চাপ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে কাতারের রাজধানী দোহায় বৈঠক করতে জমা হন তাঁরা। ঠিক সেই সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’ লড়াকু জেট থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে তেল আভিভের আকাশযোদ্ধারা।
কাতারের সামরিক অভিযানের পর লক্ষ্যপূরণ হয়েছে বলে বিবৃতি দেয় ইজ়রায়েল। এতে হামাসের শীর্ষ মধ্যস্থতাকারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। অন্য দিকে প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির পাল্টা দাবি, ইহুদি হামলায় বর্ষীয়ান নেতা খলিল আল-হাইয়ারের ছেলে, দোহা দফতরের পরিচালক, তিন জন দেহরক্ষী এবং কাতারের এক জন নিরাপত্তারক্ষী-সহ প্রাণ হারিয়েছেন মোট ছ’জন। তবে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সুরক্ষিত রয়েছেন।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০১২ সালে দোহায় রাজনৈতিক দফতর খোলা হামাস। এ ব্যাপারে আমেরিকার থেকে সবুজ সঙ্কেত পেয়েছিল কাতার প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট দফতরটি থাকার কারণে কোনও বহিঃশত্রুর আক্রমণ হবে না বলে উপসাগরীয় দেশটিকে লিখিত প্রতিশ্রুতিও দেয় ওয়াশিংটন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আরব মুলুকটির রাজধানীর একাধিক এলাকাকে নিশানা করে ইহুদি বায়ুসেনা। ফলে পশ্চিম এশিয়ায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে মার্কিন গ্রহণযোগ্যতা।
বর্তমানে কাতারের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে রয়েছে পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম মার্কিন সামরিক ছাউনি। ইজ়রায়েলি হামলার সময় সেখানকার সৈনিকেরা যে ‘শীতঘুমে’ ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। সক্রিয় হয়নি সংশ্লিষ্ট ঘাঁটিতে মোতায়েন থাকা আমেরিকার ‘প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)। এই ঘটনার পর ভরসাযোগ্য নতুন বন্ধুর খোঁজ শুরু করেছে দোহা। ইতিমধ্যেই রুশ বিদেশমন্ত্রী সর্গেই লেভরভের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তারা।
বিশ্লেষকদের দাবি, কাতারে হামলা চালিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে ইজ়রায়েল। সেটা হল, আমেরিকার সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ পাতিয়ে সন্ত্রাসবাদকে মদত দিলে মোটেই তা রেয়াত করবে না তেল আভিভ। আর তাই প্রমাদ গুনছে ইসলামাবাদ। কারণ, পাকভূমিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জঙ্গিদের আঁতুড়ঘর বললে অত্যুক্তি করা হবে না।
আর ঠিক এই জায়গা থেকেই রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কাউন্সিলে পশ্চিমের প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে ভারত। সুইৎজ়ারল্যান্ডের জেনেভায় সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির একটি সম্মেলনে এ দেশের দুঁদে কূটনীতিক ক্ষিতীশ ত্যাগী পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাস আসক্ত’ এবং ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বলে উল্লেখ করেন। এ বার সেই একই কথা শোনা গেল ইজ়রায়েলের গলাতেও।
১৯৮০-র দশকে ইসলামাবাদ দ্রুত গতিতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে এগোতে থাকে। পাক সেনার সদর দফতর রাওয়ালপিন্ডি সংলগ্ন কাহুতায় এই সংক্রান্ত গবেষণা চালাচ্ছিলেন সে দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। যদিও বিশ্লেষকদের বড় অংশই মনে করেন চিন এবং উত্তর কোরিয়া থেকে প্রযুক্তি চুরি করে আণবিক বোমা তৈরি করেছেন তাঁরা।
পাকিস্তানের পরমাণু হাতিয়ার তৈরির বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেনি তেল আভিভ। ১৯৮১ সালে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক প্রতিষ্ঠান উড়িয়ে দেয় ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। ইহুদিদের বিমানহানায় ধ্বংস হয় বাগদাদের আণবিক চুল্লি। এই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ব্যাবিলন’। ওই সময়ে ঠিক একই কায়দায় পাকিস্তানের কাহুতার পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল ইহুদি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।
গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের পরমাণু কেন্দ্রগুলিকে নিশানা করতে চেয়েছিল ইজ়রায়েল। যদিও নানা কারণে শেষ পর্যন্ত বাতিল হয় সেই অভিযান। তবে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয় ইহুদিরা। ইসলামাবাদ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মঞ্চে যে ভাবে এ দেশের সুরে তেল আভিভ কথা বলেছে, তাতে পশ্চিমের প্রতিবেশীর কপাল পুড়তে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।