Pakistan Double Game

কখনও সাপ, কখনও ব্যাঙের গালে চুমু খেয়ে ফয়দা লোটার তাল! দুই মহাশক্তির সঙ্গে আগুন নিয়ে খেলে কি নিজেই পুড়বে পাকিস্তান?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের সঙ্গে দ্বিচারিতা করছে পাকিস্তান। দুই ‘সুপার পাওয়ার’-এর থেকেই ক্রমাগত আর্থিক সাহায্য নিয়ে যাচ্ছে ইসলামাবাদ। এর মাধ্যমে গোটা দেশকে তাদের লড়াইয়ের ময়দানে পরিণত করছেন সেখানকার রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ফৌজি জেনারেলরা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৪:২৪
Share:
০১ ১৯

কখনও সাপের গালে চুমু তো কখনও আবার ব্যাঙের গালে! আমেরিকা ও চিনের মতো দুই মহাশক্তিধরকে ঠিক এই কায়দাতেই নাচাচ্ছে ইসলামাবাদ। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের এ-হেন বিদেশনীতির পাকিস্তান জুড়ে জয়জয়কার। যদিও গোটা ব্যাপারটিতে ভুরু কুঁচকেছেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখা দুঁদে কূটনীতিকদের একাংশ। দু’নৌকায় পা দিয়ে চলার চরম খেসারত ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশীকে অচিরেই দিতে হবে বলে মনে করেছেন তাঁরা।

০২ ১৯

গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা সামরিক জোটে যোগ দেয় পাকিস্তান। যদিও পরবর্তী বছরগুলিতে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করে ইসলামাবাদ। এরই ফলস্বরূপ বর্তমানে বেজিংকে ‘লৌহ বন্ধু’ বলে মানতে দ্বিধা করছেন না পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। তাই বলে আমেরিকার হাত তারা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে, এমনটা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে মাখামাখি করতে দেখা গিয়েছে দেশটির সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে।

Advertisement
০৩ ১৯

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, চিন এবং আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক মোটেই মধুর নয়। মতাদর্শগত দিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে রয়েছে এই দুই ‘সুপার পাওয়ার’। পাশাপাশি সামরিক, আর্থিক, ভূ-রাজনীতিক এবং মহাকাশ গবেষণার মতো প্রতিটা ক্ষেত্রে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা রয়েছে তাদের। শুধু তা-ই নয়, প্রভাব বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নিজেদের দিকে টানতে সর্বদাই লড়াই করছে বেজিং এবং ওয়াশিংটন। এরই সুযোগ নিয়ে দু’পক্ষের কাছে নিজেকে ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে পাকিস্তান।

০৪ ১৯

এ ব্যাপারে প্রথমেই বলতে হবে ফিল্ড মার্শাল মুনিরের কথা। গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারেন তিনি। সেখানে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে মনোনীত করার প্রস্তাব পর্যন্ত দিতে শোনা যায় তাঁকে। বিনিময়ে পাকিস্তানে ট্রাম্পের ক্রিপ্টো ব্যবসার দেখভালের দায়িত্ব পান মুনির। পাশাপাশি, খনিসমৃদ্ধ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশ বালোচিস্তানে আমেরিকার সংস্থাকে ঢালাও প্রবেশাধিকার দিয়েছে ইসলামাবাদ।

০৫ ১৯

অন্য দিকে, চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর বেজিঙের বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। সেখানে ‘চিন পাকিস্তান আর্থিক বারান্দা’ বা সিপিইসির (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের জন্য ড্রাগনের ৮০০ কোটি ডলারের লগ্নি নিশ্চিত করেন তিনি। দেশে ফিরে সরকারের শীর্ষ আধিকারিকদের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দেন শরিফ। সিপিইসিকে মান্দারিনভাষীদের বিনিয়োগ এবং দক্ষতার থেকে উপকৃত হওয়ার ‘শেষ সুযোগ’ বলে উল্লেখ করতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।

০৬ ১৯

কূটনীতিকদের কথায়, শাহবাজ়ের এ-হেন মন্তব্যের নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, পাক ফিল্ড মার্শাল মুনিরের মার্কিন ঘনিষ্ঠতাকে মোটেই ভাল চোখে দেখছে না বেজিং। দ্বিতীয়ত, গত মে মাসে ভারতীয় সেনার ‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে এ দেশের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়ে ইসলামাবাদ। ওই সময় রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারদের বহুল পরিমাণে চিনা হাতিয়ার ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছিল। যদিও সংঘর্ষবিরতির পর এই নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেননি মুনির বা শরিফ।

০৭ ১৯

উল্টে ‘যুদ্ধ’ থামতেই ট্রাম্পের ভূয়সী প্রশংসা শুরু করে পাকিস্তান। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বেজিঙের রক্তচাপ বাড়িয়ে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনর্দখলের হুঁশিয়ারি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সংশ্লিষ্ট ছাউনিটিতে বাহিনী মোতায়েন করে চিনের পরমাণু কর্মসূচি এবং হাতিয়ারের উপর নজরদারির পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যেই বিবৃতি দিয়েছেন তিনি। এর জন্য ইসলামাবাদকে ব্যবহার করতে পারে ওয়াশিংটন। ফলে প্রমাদ গুনছে ড্রাগন সরকার।

০৮ ১৯

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মনদীপ সিংহ। তাঁর কথায়, ‘‘দু’নৌকায় পা দিয়ে চলতে গিয়ে বর্তমানে ‘শাঁখের করাত’ অবস্থার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান। ফলে চিন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সংঘাতের মাসুল রক্ত ঝরিয়ে দিতে হবে ইসলামাবাদকে। শেষ মুহূর্তে কোনও একটা দিকে ঝুঁকে গিয়ে অপর পক্ষের পিঠে ছোরা মারা তাদের কাছ থেকে একেবারেই আশ্চর্যের নয়। আর সেটা চিন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’’

০৯ ১৯

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, পাকিস্তানকে নিয়ে চিন ও আমেরিকার একাধিক ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ রয়েছে। তার মধ্যে বালোচিস্তান অন্যতম। ইসলামাবাদের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশটির গ্বদর সমুদ্রবন্দর নিজেদের দখলে রাখতে চায় বেজিং। এর জন্য সিপিইসি প্রকল্পের মাধ্যমে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির সরকারের হাতে কয়েক কোটি ডলার তুলে দিয়েছে তারা। গ্বদর হাতে পেলে আরব সাগরীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ যে অনেকাংশেই ড্রাগনের হাতে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

১০ ১৯

অন্য দিকে বালোচিস্তানের খনিজ সম্পদের দিকে নজর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তা ছাড়া গ্বদরের মতো কৌশলগত এলাকায় চিনা প্রভাব মানতে নারাজ ওয়াশিংটন। সংশ্লিষ্ট প্রদেশটিতে পাক সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ রয়েছে প্রবল। ইসলামাবাদের থেকে আলাদা হতে চেয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালাচ্ছে সেখানকার স্বাধীনতাকামী বালোচদের একাংশ। এর মধ্যে বেজিং এবং ওয়াশিংটনের সংঘাত গিয়ে পড়লে, পরিস্থিতি যে জটিল হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

১১ ১৯

তবে শাহবাজ় সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গা হল আফগানিস্তান। স্থলবেষ্টিত পঠানভূমির বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনর্দখল করতে হলে পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর জন্য ইসলামাবাদ সেই রাস্তা খুলে দিলে বেজিঙের পক্ষে চুপ করে বসে থাকা অসম্ভব। বাগরাম ছাউনি থেকে ওয়াশিংটন তাদের পরমাণু কর্মসূচির উপর নজরদারি করুক, তা নিশ্চয়ই চাইবে না চিন।

১২ ১৯

২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে আমেরিকা। এর পরই হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরে তালিবান। ওই বছরের ডিসেম্বরেই কাবুলের সরকারকে স্বীকৃতি দেয় বেজিং। শুধু তা-ই নয়, গত চার বছরে তালিবানের সঙ্গে একাধিক চুক্তি সেরে ফেলেছেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। পঠানভূমির খনিজ সম্পদের উপর বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে তাদের।

১৩ ১৯

গত মে মাসে কাবুলে পাক বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার এবং তালিবানের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেন চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। সেখানে সিপিইসি প্রকল্পকে পঠানভূমিতে সম্প্রসারণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় বেজিং। এই অবস্থায় বাগরামের জন্য হিন্দুকুশের কোলের দেশটিকে আক্রমণ করে তাদের যাবতীয় পরিকল্পনায় জল ঢালতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

১৪ ১৯

আফগানিস্তানের তালিবান সরকার অবশ্য ট্রাম্পের হুমকিকে পাত্তা দিতে নারাজ। উল্টে পাল্টা যুক্তরাষ্ট্রকেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা। কোনও অবস্থাতেই বাগরাম বিমানবন্দর ওয়াশিংটনের হাতে তুলে দেওয়া হবে না বলে স্পষ্ট করেছে তালিবান। এর জন্য প্রয়োজনে আগামী ২০ বছর ‘মহাশক্তিধর’ আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ করতেও তাঁরা প্রস্তুত।

১৫ ১৯

গত ২১ সেপ্টেম্বর এই ইস্যুতে মুখ খোলেন পঠানভূমির তালিবান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের চিফ অফ স্টাফ ফাসিহুদ্দিন ফিতরত। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু লোক রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চাইছেন। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের এক ইঞ্চি জমিও বিদেশি শক্তির হাতে সমর্পণ করা হবে না। এখানে তাঁদের কোনও প্রয়োজন নেই।’’ এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এতে বিঘ্নিত হবে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা।

১৬ ১৯

২০০১ সালে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের সেই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন এন্ডুরিং ফ্রিডম’। সে বার ওয়াশিংটনের বাহিনীকে রাস্তা দিতে দ্বিধা করেনি পাকিস্তান। এ বারও সেই একই পন্থা অবলম্বন করলে প্রত্যাঘাতের রাস্তায় যেতে পারে কাবুল। ইসলামাবাদের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়ায় প্রবল ভাবে সক্রিয় রয়েছে ‘তেহরিক ই তালিবান পাকিস্তান’ বা টিটিপি নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। স্বাধীন পাশতুনিস্তান তৈরির স্বপ্ন রয়েছে তাদের।

১৭ ১৯

পর্দার আড়ালে থেকে টিটিপিকে যাবতীয় মদত আফগানিস্তানের তালিবান সরকার দিয়ে যাচ্ছে বলে দীর্ঘ দিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে পাক সরকার ও সেনার। কাবুল অবশ্য সেটা অস্বীকার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর জন্য ইসলামাবাদ রাস্তা দিলে টিটিপিকে সামনে রেখে আক্রমণের ঝাঁজ বৃদ্ধি করতে পারে হিন্দুকুশের কোলের দেশ, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

১৮ ১৯

এই ইস্যুতে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন সাবেক পাক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি। দীর্ঘ দিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ছিলেন তিনি। লোধির কথায়, ‘‘চিন ও আমেরিকা, এই দুই দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে ফারাক রয়েছে। মানতে অসুবিধা নেই যে বেজিং ও ওয়াশিংটনের স্বার্থ আলাদা। সেটা মেনে নিয়েই এগোনোর চেষ্টা করছে ইসলামাবাদ।’’

১৯ ১৯

যদিও সাবেক সেনাকর্তা মেজর জেনারেল মনদীপ সিংহ এ কথা মানতে নারাজ। তিনি বলেছেন, ‘‘দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান দু’টি দেশের থেকেই দু’হাত ভরে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এর সিংহভাগই লুট করছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। চিন ও আমেরিকা একে অপরকে আক্রমণ না করা পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে পারবেন তাঁরা। কিন্তু তার পর আর সেটা সম্ভব নয়।’’

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement