১১ মে পরিবারের সম্মতিতে চার হাত এক হয়েছিল রাজা ও সোনম রঘুবংশীর। ইনদওরের বাসিন্দা এই নবদম্পতি মধুচন্দ্রিমার জন্য বেছে নিয়েছিলেন উত্তর-পূর্বের মেঘের রাজ্য মেঘালয়কে। গত ২০ মে স্ত্রী সোনমকে নিয়ে মেঘালয়ের উদ্দেশে পাড়ি দেন রাজা। ২৩ মে তাঁরা এসে পৌঁছোন চেরাপুঞ্জিতে।
২৩ মে থেকেই নিখোঁজ হয়ে যান ইনদওরের ব্যবসায়ী রাজা। ১১ দিন নিখোঁজ থাকার পর ২ জুন রাজার দেহ মেলে সোহরায় (চেরাপুঞ্জি) একটি খাদের নীচ থেকে। উদ্ধার হয়েছিল একটি রক্তমাখা দা এবং বর্ষাতি। সেই দেখে স্থানীয় পুলিশ অনুমান করেছিল পর্যটককে খুনই করা হয়েছে। রাজার দেহ উদ্ধার হলেও তাঁর স্ত্রী সোনম যেন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিলেন। সোনমের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি শুরু হয়।
১৭ দিন পর রাজা হত্যারহস্য সম্পূর্ণ অন্য দিকে মোড় নেয়। খোঁজ মেলে সোনমের। রাজাকে খুনের দায় স্বীকার করে উত্তরপ্রদেশে আত্মসমর্পণ করেন সোনম। পুলিশ জানিয়েছে, উত্তরপ্রদেশের গাজ়িপুরের নন্দগঞ্জ থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন সোনম। আরও এক জনকে উত্তরপ্রদেশ থেকে গ্রেফতার করেছে মেঘালয় পুলিশ। আত্মসমর্পণ করার আগে বাড়িতে ফোন করেছিলেন সোনম।
এ ছাড়া ইনদওর থেকে বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) হাতে ধরা পড়েছেন আরও দু’জন। এখনও পর্যন্ত এই ঘটনায় গ্রেফতারির সংখ্যা চার। এঁদের মধ্যে দু’জন মধ্যপ্রদেশের এবং একজন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। আরও এক জনের সন্ধান চলছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, স্বামীকে খুন করানোর জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করেছিলেন সোনম।
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনের দাবি, রাজাকে খুন করতেই মধুচন্দ্রিমায় পাহাড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন সোনম। মধুচন্দ্রিমার জন্য বেছে নিয়েছিলেন দেশের অন্য প্রান্তের একটি রাজ্যকে। সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিয়ের আগের সম্পর্কের কারণে এই হত্যার ছক কষেন সোনম। পুলিশ তদন্তে জানা যায় যে, বিয়ের আগে রাজ কুশওয়াহা নামে এক যুবকের সঙ্গে সোনমের প্রেম ছিল। প্রেমের পথ থেকে রাজাকে সরিয়ে দিতে মধুচন্দ্রিমায় শিলং গিয়েছিলেন তাঁরা।
বিয়ের পরেও রাজ ও সোনমের যোগাযোগ ছিল। সোনম রাজাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং প্রেমিকের সঙ্গে শিলংয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। রাজা হত্যায় আরও এক অভিযুক্তকে খুঁজছে পুলিশ। বর্তমানে পলাতক সেই উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দাই সোনমের প্রেমিক কিনা তা জানা যায়নি।
গত ২৩ মে দুপুর সওয়া ১টায় মার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল সোনমের। সে দিন সোনমের উপবাস ছিল। সোনমকে তাঁর মা অনুরোধ করেছিলেন, যাতে উপবাস ভেঙে তিনি কিছু খেয়ে নেন। ঘুরতে গিয়ে না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। যদিও সোনম জানান, ঘুরতে গিয়েছেন বলে কখনওই উপবাস ভাঙবেন না।
সোনম তাঁর মাকে জানান যে, তাঁরা একটি জলপ্রপাত দেখতে জঙ্গলে গিয়েছেন। পাহাড়ে চড়তে হচ্ছে। আচমকাই ফোন কেটে যায়। আর ফোন আসেনি। মনে করা হচ্ছিল, দুষ্কৃতীদের কবলে পড়েছেন তিনিও। এমনকি, তাঁকে অপহরণ করে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন।
২৩ মে সোহরার একটি হোমস্টেতে শেষ বার দেখা গিয়েছিল নবদম্পতিকে। সেই সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ খুঁজে পায়। সেখানে দেখা গিয়েছে নীল রঙের একটি স্কুটিতে চেপে রাজা এবং সোনম সোহরার একটি হোমস্টেতে ঢুকছেন। তাঁদের দু’জনেরই পরনে ছিল কালো রঙের বর্ষাতি। সঙ্গে ছিল একটি ছোট ট্রলিব্যাগ। স্কুটি থেকে নেমে তাঁরা হোমস্টের রিসেপশনে যান। সেখানে কথা বলেন রাজা। তার পর তাঁদের ব্যাগ রাখেন।
হোমস্টেতে না ঢুকে স্কুটির সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সোনমকে। তিনি বর্ষাতি খুলে রেখে স্কুটির ডিকিতে রেখে দেন। তাঁর পরনে ছিল সাদা টি শার্ট এবং কালো প্যান্ট। রাজা অবশ্য তাঁর বর্ষাতি খোলেননি। সিসিটিভি ফুটেজে তেমনই দেখা গিয়েছে। দু’জন তাঁদের প্রয়োজনীয় জিনিস ট্রলিব্যাগ থেকে বার করে গাড়ির ডিকি এবং সঙ্গে থাকা ছোট ব্যাগে ভরে নেন। তার পর দু’জনে স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
রাজার দেহ সোহরারিমের জলপ্রপাতের কাছ থেকে উদ্ধার হয়। সেখানে একটি সাদা জামা পড়ে ছিল। এ ছাড়াও একটি বর্ষাতিও পাওয়া যায়। এই বর্ষাতি এবং জামা নিয়েই সন্দেহের উদ্রেক হয়। কারণ নিখোঁজ হওয়ার দিন সোনমও একটি সাদা টি শার্ট পরেছিলেন।
মেঘালয়ের এক ট্যুর গাইডের বক্তব্য অনুযায়ী, সোনম এবং রাজার সঙ্গে তিনি তিন হিন্দিভাষীকে দেখেছিলেন। অ্যালবার্ট নামের ওই গাইড দাবি করেছিলেন, তিনি ২৩ তারিখ রাজা এবং সোনমকে তিন জন যুবকের সঙ্গে পাহাড়ে উঠতে দেখেছিলেন। সে দিন সকাল ১০টা নাগাদ নোংরিয়াট থেকে মাওলাখিয়াটে ৩০০০ সিঁড়ি চড়ছিলেন দম্পতি। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আরও তিন জন।
অ্যালবার্ট জানান, তিনি ইনদওরের ওই নবদম্পতির মুখ ভাল ভাবে চিনে রেখেছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন তিনিই সোনমদের নোংরিয়াত ঘুরিয়ে দেখানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সোনমেরা অন্য এক গাইডের সঙ্গে যান। অ্যালবার্টের দাবি, সে দিন চার জন পুরুষ পর্যটক আগে আগে যাচ্ছিলেন। পিছনে ছিলেন সোনম। চার জন পুরুষ পর্যটকই হিন্দিতে কথা বলছিলেন। তিনি হিন্দি না জানায় তাঁদের কথা বুঝতে পারেননি বলেও দাবি করেন অ্যালবার্ট।
গাইডের সূত্র ধরে পুলিশ তদন্ত করে দেখে, স্বামীকে খুনের জন্য ওই তিন জনকে ভাড়াটে খুনি হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন সোনম। গ্রেফতারির পর অভিযুক্তেরাও জানান, রাজা রঘুবংশীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন সোনম এবং এর জন্য তাঁদের অর্থ দিয়েছিলেন।
যে জায়গায় রাজার মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেখান থেকে হোমস্টের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ ভাড়া করা স্কুটি নিয়ে ২৫ কিমি গিয়েছিলেন তাঁরা। এই দূরত্ব মামলায় সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়। রাজার মোবাইল, পার্স, সোনার চেন এবং আংটি কিছুই মৃতদেহের কাছে পাওয়া যায়নি। কেবল তাঁর স্মার্ট ঘড়িটি কব্জিতে বাঁধা পাওয়া যায়।
এর পর ৯ জুন ভোর ৩টে থেকে ৪টের মধ্যে গাজীপুরের একটি ধাবায় পৌঁছোন ‘নিখোঁজ’ সোনম। সেখান থেকে তিনি ধাবার মালিকের ফোন থেকে তাঁর ভাইকে ভিডিয়োকল করেন। ভাইকে সোনম জানান যে, তিনি গাজীপুরে আছেন। ভাই প্রাথমিক বিহ্বল ভাব কাটিয়ে ইনদওর পুলিশকে খবর দেন। সেখান থেকে গাজীপুর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছোয় এবং সোনমকে পরীক্ষার জন্য ওয়ান স্টপ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। তদন্তে তাঁর শরীরে কোনও আঘাত বা আক্রমণের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।