ডেড সি। জর্ডন এবং ইজরায়েল সীমান্তে থাকা এই সমুদ্র ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য। এর কাছে এক প্রাচীন গুহা থেকে উদ্ধার হয়েছিল প্যাপিরাসে লেখা একগুচ্ছ লিপি। তার মধ্যে একটি আবার ছিল তামার পাতে লেখা। কাগজের মধ্যে কেন একটি তামার পাত? সেই নিয়ে শুরু হয় হাজারো জল্পনা। মনে করা হয়, ওই তামার পাতে খোদাই করে গুপ্তধনের সন্ধান লেখা রয়েছে। সেই গুপ্তধনের সন্ধান আজও পাননি ইতিহাসবিদরা।
ইজরায়েলের কুমরানে রয়েছে প্রাচীন এক গুহা। সেখান থেকেই মিলেছিল এই তামার লিপি। ডেড সি থেকে ওই এলাকার দূরত্ব মেরেকেটে দেড় কিলোমিটার। তাই ওই লিপিগুলিকে ‘ডেড সি কপার স্ক্রল’ বলা হয়।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় কুমরানের গুহায় প্যাপিরাসে লেখা একাধিক লিপির খোঁজ পেয়েছিলেন আরব বেদুইনরা। ওই গুহার আশপাশের এলাকায় গবাদি পশু চড়াতে যেতেন তাঁরা। তখনই খোঁজ পান প্রাচীন সে সব লিপির। সেগুলি লেখা ছিল হিব্রু ভাষায়।
তামার পাতে লেখা লিপি উদ্ধার করেছিলেন এক প্রত্নতত্ত্ববিদ। ১৯৫২ সালের ১৪ মার্চ গুহায় সেই তামার পাত পাওয়া গিয়েছিল। তামার সঙ্গে এক শতাংশ টিন মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছিল পাতটি। এখন আম্মানের জর্ডন জাদুঘরে রাখা রয়েছে সেই তামার পাতে লেখা লিপি। তার সাঙ্কেতিক নাম ৩কিউ১৫।
লিপিটি কাগজের মতো রোল করে গোটানো ছিল। কিছুতেই খোলা যাচ্ছিল না সেই তামার লিপি। তাই সেটিকে ২৩টি টুকরো করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদ জন মার্কো অ্যালেগ্রো সেই লিপির পাঠোদ্ধারের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি লিপি খুলেই বুঝেছিলেন, আর পাঁচটি লিপির মতো সেটি নয়।
জন বুঝতে পারেন, ওই তামার পাতে একটি তালিকা রয়েছে। বেশ ধন্দ লাগে তাঁর। প্রায় ৬৪টি জায়গার কথা রয়েছে সেই লিপিতে। হিব্রুতে লেখা ওই লিপি পড়ে জনের মনে হয়, ৬৩টি জায়গায় এমন কোনও ঠিকানার কথা বলা রয়েছে, যেখানে রয়েছে টন টন সোনা এবং রুপো।
হিব্রুর অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক মুর ক্রস মনে করেন ২৫ থেকে ৭৫ সালে লেখা হয়েছিল ওই তামার লিপি। আনেরিকার প্রত্নতত্ত্ববিদ উইলিয়াম এফ অলব্রাইট মনে করেন ৭০ থেকে ১৩৫ সালের মধ্যে ওই লিপি খোদাই করা হয়েছিল।
সেই লিপির অনুবাদ করে জানা গিয়েছে, ‘‘নুনের খাদের নীচে পড়ে রয়েছে সিঁড়ি। পুরনো ধোপার বাড়ির গুহায় তিন নম্বর ছাদে রয়েছে ৬৫টি সোনার স্তম্ভ। মাতিয়ার উঠোনে যে সমাধিস্থল রয়েছে, সেখানে রয়েছে ৭০টি রুপোর স্তম্ভ। কাঠের পাত্রে সেগুলি রয়েছে। পূর্বদিকের গেটে রয়েছে ১৫ হাত পরিমাণ ধনরত্ন।’’
এ ভাবেই একের পর এক স্থানের কথা উল্লেখ রয়েছে লিপিতে, যেখানে খোঁজ দেওয়া হয়েছে সোনা, রুপো, ধনরত্নের। মোট ৯০০ ট্যালেন্ট সোনা সঞ্চিত রয়েছে বলে লিপিতে লেখা রয়েছে। যা প্রায় ২৪ হাজার ৬০০ গ্রামেরও বেশি সোনা।
এই বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন, যা তামার লিপিতে লেখা রয়েছে, সেগুলি এল কী ভাবে? এই নিয়ে চারটি মতামত রয়েছে।
কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, কুমরানের বাসিন্দারা অতীতে তাঁদের বিপুল পরিমাণ ধনসম্পত্তি ওই ৬৪টি জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। তারই তালিকা তৈরি করে গিয়েছেন তারা। হয়তো ডাকাতের ভয়ে এ সব করেছিলেন।
যদিও কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, কুমরানের বাসিন্দারা ছিলেন ধর্মপ্রাণ। তাঁরা ধনসম্পত্তি সঞ্চয়ে বিশ্বাসী ছিলেন না। ধনসম্পদ সঞ্চয় ছিল তাদের ধর্মের বিরোধী।
কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, জেরুজালেমে দ্বিতীয় মন্দির থেকে এ সব সোনা, রুপো মিলেছে। অতীতে জেরুজালেমের মন্দিরে সঞ্চিত থাকত টন টন সোনা, রুপো। ৭০ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমের দ্বিতীয় মন্দিরটি ভাঙা হয়েছিল। তখন বা তার আগে সে সব ধনরত্ন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তামার লিপিতে নাকি লেখা রয়েছে তারই হদিস।
প্রথম শতকের ইতিহাসবিদ জোসেফাস আবার মনে করেন, ধ্বংসের সময় জেরুজালেমের মন্দিরের মধ্যেই রাখা ছিল ধনরত্ন। সেই ধনরত্ন কেউ নিয়ে যেতে পারেননি। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, তামার লিপিতে কোন ধনরত্নের কথা লেখা রয়েছে?
আবার এক দল ইতিহাসবিদের মতে, জেরুজালেমের দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংসের সময় সেখান থেকে মিলেছিল প্রচুর ধনরত্ন। সে সবই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তামার পাতে লেখা রয়েছে সেই গুপ্তধনের সন্ধান।
খ্রিস্ট জন্মের ৫৮৬ বছর আগে ভাঙা হয়েছিল জেরুজালেমের দ্বিতীয় মন্দির। ভেঙেছিলেন ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাদনেজ়ার। সেই মন্দিরের ধনরত্ন নাকি পরে লুকিয়ে রাখা হয়। অনেকের মতে, সেই খোঁজই দেওয়া রয়েছে তামার লিপিতে। তবে কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, ওই তামার লিপি জেরুজালেমের দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংসের ৫০০ বছর পর লেখা হয়েছে। তাই সেই লিপিতে কোনও ভাবে ওই মন্দির থেকে পাওয়া সোনাদানার কথা থাকতে পারে না।
অনেক ইতিহাসবিদই মনে করেন, তামার লিপিতে শুধুই কিছু অর্থহীন কথা লেখা রয়েছে। কোনও গুপ্তধনের হদিস সেখানে নেই। তাঁদের মতে, জেরুজালেমের মন্দিরের ধনরত্ন কয়েক হাজার বছর আগে লুট করে নিয়ে গিয়েছে রোমানরা। সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
১৯৬২ সালে জন অ্যালেগ্রোর নেতৃত্বে একটি দল গুপ্তধনের সন্ধানে নেমেছিল। কিন্তু কিছুই পাননি তাঁরা। অভিযানকারী দলের ধারণা, তামার লিপিতে গুপ্তধনের কোনও সন্ধানই ছিল না।