Iran Hostage Crisis

যে সিনেমা কখনও তৈরি হয়নি, অথচ বাঁচিয়েছিল ছ’টি প্রাণ! ইরান থেকে ৬ পণবন্দিকে ফিরিয়েছিলেন ‘পরিচালক’ মার্কিন গুপ্তচর

১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর সমস্ত রোষ গিয়ে পড়ে তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে। শীতের রাতে হামলা চলে দূতাবাসে। মূল ফটক ভেঙে দূতাবাসে ঢুকে পড়েছিল উন্মত্ত ইরানি জনতা। দূতাবাসে থাকা ৫২ জন আমেরিকান কূটনীতিক ও মার্কিন নাগরিককে পণবন্দি করে ফেলে তারা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ১০:০১
Share:
০১ ১৮

১৯৭৯ সালের শেষ দিক। ইরানের স্বৈরাচারী নেতাকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে আমেরিকা ও ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক তখন তলানিতে। ১৯৫৩ সালে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ মোসাদ্দেগকে উৎখাত করে দ্বিতীয় বারের জন্য নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন শাহ মহম্মদ রেজ়া পাহলভি।

০২ ১৮

ইরানে রাজতন্ত্র কায়েম করতে রেজ়াকে সহায়তা করেছিল আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা। মার্কিন প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত রেজ়ার আধিপত্য কায়েমকে মেনে নিতে পারেনি ইরানের বিপ্লবী দলগুলি। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামি বিপ্লব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। রেজ়াকে টপকে তাদের রোষ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে। সেই স্ফুলিঙ্গে আগুন ধরায় রেজ়ার একটি কূটনৈতিক চাল।

Advertisement
০৩ ১৮

১৯৭৯ সালে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাসিত রেজ়াকে চিকিৎসার জন্য আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়াশিংটন। ইরানের জনসাধারণ ও বিশেষ করে বিপ্লবী ছাত্র সংগঠনগুলি এই সিদ্ধান্তকে ভাল চোখে দেখেনি। রেজ়াকে গদিচ্যুত করা বিপ্লবী, বিশেষ করে ইমাম খামেনেই-পন্থী মুসলিমদের মধ্যে বিশেষ একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, ইরানি বিপ্লবকে নষ্ট করে রেজ়াকে মসনদে পুনর্বহাল করার ষড়যন্ত্র করছে আমেরিকা।

০৪ ১৮

ইরানের স্বৈরাচারী শাসক রেজ়াকে সমর্থন করার কারণে বেশির ভাগ ইরানির মধ্যে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছিল। সেই আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করে আমেরিকায় গিয়ে রেজ়ার ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য প্রবেশাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত। বিদ্রোহীরা রেজ়াকে তাঁর অপরাধের বিচারের জন্য দেশে প্রত্যাবর্তনের দাবি জানায় আমেরিকার কাছে। সেই দাবি মানেনি মার্কিন প্রশাসন। ইরানিদের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে জনতার ক্রোধ।

০৫ ১৮

১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর সমস্ত রোষ গিয়ে পড়ে তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে। শীতের রাতে হামলা চলে দূতাবাসে। মূল ফটক ভেঙে দূতাবাসে ঢুকে পড়ে উন্মত্ত ইরানি জনতা। দূতাবাসে থাকা ৫২ জন আমেরিকান কূটনীতিক ও মার্কিন নাগরিককে পণবন্দি করে ফেলে তারা। আজ থেকে ঠিক ৪৬ বছর আগে ঘটা এই ঘটনা চিরতরে পাল্টে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্কের ইতিহাস।

০৬ ১৮

দূতাবাসে যাঁরা আটকে পড়েন তাঁদের মধ্যে ছ’জন ভবনের পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে সক্ষম হন। পরে এ রবার্ট অ্যান্ডার্স নামের এক কূটনীতিক কানাডার কূটনীতিক জন শিয়ারডাউনকে সাহায্যের জন্য ফোন করেন। পালিয়ে আসা দলটির মধ্যে চার জন শিয়ারডাউনের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকেন। বাকি দু’জনকে কানাডার রাষ্ট্রদূত কেনেথ টেলরের বাসভবনে রাখা হয়েছিল।

০৭ ১৮

এই খবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছোনোর পর ইরানে পণবন্দি মার্কিন কূটনীতিবিদদের মুক্ত করতে বিপজ্জনক অপারেশন চালায় সিআইএ। তবে তারাও মার্কিন নাগরিকদের বার করে আনার ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী ছিল না। ইতিহাসে এই উদ্ধার অভিযান ‘ইরান হস্টেজ ক্রাইসিস’ হিসাবে পরিচিত।

০৮ ১৮

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রতিনিধি এবং তেহরানে থাকা অন্যান্য দেশের কূটনীতিকেরা পণবন্দিদের মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। আমেরিকার অ্যাটর্নি জেনারেল রামসে ক্লার্কের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলও আলোচনায় বসতে চেয়েছিল। ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ছিল। তাঁকেও ইরানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

০৯ ১৮

দূতাবাস আক্রমণের দিন যে ছ’জন প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁদেরও নিরাপদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনার জন্য আসরে নামে সিআইএ। দায়িত্ব দেওয়া হয় টনি মেন্ডেজ়কে। কূটনীতিবিদদের উদ্ধার করতে জীবন বাজি রেখে অগ্নিগর্ভ তেহরানে ঝাঁপ দেন সিআইয়ের গোপন উদ্ধার অভিযানের বিশেষজ্ঞ টনি।

১০ ১৮

গোটা তেহরান তখন বিদ্রোহীদের দখলে। আমেরিকান নাগরিক মানেই মৃত্যুর শঙ্কা। সেই উদ্ধার অভিযান ছিল কার্যত অসম্ভব। তেহরানের রাস্তায় তখন ভাসছে বিপ্লবের স্লোগান। দূতাবাসের দেওয়ালে জ্বলছে আগুন। রাস্তায় উত্তেজিত জনতা আর তার মাঝখান থেকে উদ্ধার করে আনতে হবে কানাডার কূটনৈতিকদের আশ্রয়ে থাকা ছ’জন মার্কিন নাগরিককে।

১১ ১৮

এর পর যা ঘটেছিল তা ছিল ‘সিনেমা’। সিনেমার শুটিংয়ের আড়ালে টনি উদ্ধার করেছিলেন সহ-নাগরিকদের। সিআইয়ের সদর দফতরে বসে ক্ষুরধার মস্তিষ্কের টনি ছকে ফেলেন অভিনব পরিকল্পনা।

১২ ১৮

টনি তেহরানে প্রবেশ করেন এক জন হলিউড প্রযোজক সেজে। তাঁর পরিকল্পনা? একটি ‘সিনেমা’ বানানো, যা আদৌ তৈরি হবে না কোনও দিন। ‘স্টার ওয়ার্স’-এর আদলে একটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনির শুটিংয়ের জন্য প্রাণ হাতে করে তেহরানে আসেন তিনি। হাতে চিত্রনাট্য, গলায় আত্মবিশ্বাস। ছ’জন লুকিয়ে থাকা কূটনীতিক তখন সিনেমার ‘লোকেশন স্কাউটিং টিম’-এর ছদ্মবেশে। ‘পরিচালক’ টনির ‘ফিল্ম ইউনিট’-এর সদস্য।

১৩ ১৮

খুব সন্তর্পণে জাল গুটোতে শুরু করেন টনি। সামান্য ভুলচুক হলেই বন্দুকের গুলি ঝাঁঝরা করে দিত সকলকে। এই অপারেশনের সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘কানাডিয়ান ক্যাপার’।

১৪ ১৮

নভেম্বরে শুরু হওয়া পণবন্দির ঘটনার পর কেটে যায় দু’মাসেরও বেশি সময়। ১৯৮০ সালের ২৭ জানুয়ারি ছিল সেই দিন। সকালে, তাঁরা তেহরান বিমানবন্দরে পৌঁছোন। সামনে ইরানি নিরাপত্তার কঠোর তল্লাশি, পিছনে উত্তেজনায় ভরা প্রতিটি মুহূর্ত। শেষ মুহূর্তে এক অফিসার প্রশ্ন করেন, “সিনেমার নাম কী?” টনি হেসে জবাব দেন, ‘আর্গো’। তেহরানের বিমানবন্দরে শেষ মুহূর্তের ছাড়পত্র পান টনি মেন্ডেজ় এবং ছয় কূটনীতিক। কানাডিয়ান সরকারের সহায়তায় ইরান থেকে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন তাঁরা। ভুয়ো কানাডিয়ান পাসপোর্টকে হাতিয়ার করে নির্বিঘ্নে শত্রুশিবির ত্যাগ করেন টনি-সহ ছয় কূটনীতিক।

১৫ ১৮

‘ইরান হস্টেজ ক্রাইসিস’-এর ঘটনা অবলম্বনে ২০১২ সালে মুক্তি পায় ‘আর্গো’ নামের চলচ্চিত্রটি। টনির ভূমিকায় অভিনয় করেন বেন অ্যাফ্লেক। ২৫ বছরের কর্মজীবনে টনি মেন্ডেজ় বহু গোপন অভিযানে অংশ নিয়েছেন। ২০১৯ সালে মারা যান এই দক্ষ গোয়েন্দা।

১৬ ১৮

ছ’জনকে নিয়ে পালিয়ে আসার পর ঘটনার রেশ কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি। ৪৪৪ দিন ধরে চলেছিল ইরানে পণবন্দির সমস্যা। প্রেসিডেন্ট জিম কার্টার ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। সমস্ত ইরানি কূটনীতিককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। অবশিষ্ট পণবন্দিদের তেহরান থেকে বার করে আনার জন্য ‘অপারেশন ইগল ক্ল’ নামের একটি সামরিক অভিযান চালায় আমেরিকা। যদিও তা ব্যর্থ হয়েছিল। অভিযানের জন্য পাঠানো আটটি হেলিকপ্টারের মধ্যে দু’টিতে ত্রুটি ধরা পড়ে এলাকায় পৌঁছোনোর আগেই। অন্য একটি ঘটনাস্থলেই বিকল হয়ে পড়ে।

১৭ ১৮

অবশিষ্ট হেলিকপ্টারগুলির মধ্যে একটির সংঘর্ষ হয় বিমানের সঙ্গে। এতে আট জন মার্কিন সেনা নিহত হন। অবশেষে ১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের শপথগ্রহণের দিন দীর্ঘ আলোচনার পর পণবন্দিদের মুক্তি দেয় ইরান। তত দিনে মিশরে মারা গিয়েছেন মহম্মদ রেজ়া। অর্থনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার ফলে ইরান বিশ্বের দরবারে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।

১৮ ১৮

১৯৮০ সালে ইরাকের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইরান। ইরানের ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে ছিল ইসলামী বিপ্লবকে ছড়িয়ে দেওয়া। তাতে বাধ সাধে ইরাক। সেই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একাধিক রাষ্ট্রনেতা ইরানকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন যে তাঁরা যত ক্ষণ আমেরিকানদের পণবন্দি করে রাখবে তত ক্ষণ ইরাকের সঙ্গে সংঘাতে কোনও সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা। আন্তর্জাতিক চাপেই ইরান বাধ্য হয়ে ৪৪৪ দিন ধরে আটকে রাখা মার্কিন নাগরিকদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

সব ছবি: রয়টার্স ও সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement