চার বছরে পা রাখতে চলা ইউক্রেন যু্দ্ধকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত ইউরোপ। এক দিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন)। অন্য দিকে রাশিয়া। চলতি বছরের শেষে পৌঁছে দু’পক্ষই সুর চড়াতে থাকায় জটিল হয়েছে পরিস্থিতি। এই আবহে মস্কোর রক্তচাপ বাড়িয়ে অত্যাধুনিক রণতরী নির্মাণের কাজ শুরু করল নেটো-ভুক্ত তুরস্ক। ফলে ক্রেমলিনের পাশাপাশি গ্রিস এবং সাইপ্রাসের কপালেও পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
গত ২৭ নভেম্বর এ ব্যাপারে বড় ঘোষণা করে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়েছে, ইস্তানবুলের শিপইয়ার্ডে পরবর্তী প্রজন্মের ড্রেস্ট্রয়ার শ্রেণির রণতরী নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। যুদ্ধজাহাজটির পোশাকি নাম ‘টিএফ-২০০০’ রেখেছে আঙ্কারা। এই রণতরী তুর্কি নৌবাহিনীর বহরে শামিল হলে পূর্ব ভূমধ্যসাগর, এজ়িয়ান সাগর এবং নেটোর বৃহত্তর সামুদ্রিক থিয়েটারের শক্তি যে কয়েক গুণ বৃদ্ধি করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী এক দশকের মধ্যে অন্তত আটটি ডেস্ট্রয়ার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ানের। সংশ্লিষ্ট রণতরীগুলিতে থাকবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। নেটো-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের নৌবাহিনী বেশ শক্তিশালী। তাদের হাতে থাকা রণতরীর সমতুল্য ডেস্ট্রয়ার নির্মাণে আঙ্কারা মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে খবর সূত্রের।
‘ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, তুর্কি নৌবাহিনীর জন্য নির্মিত ডেস্ট্রয়ারগুলির ওজন হবে কমবেশি ৮,৩০০ টন। প্রায় ১৫০ মিটার হালের উপর গড়ে উঠবে ওই রণতরী। শত্রুর রেডারের নজরদারি থেকে বাঁচতে যুদ্ধজাহাজগুলিতে যথাসম্ভব ‘স্টেলথ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন আঙ্কারার প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এতে থাকবে অত্যাধুনিক ‘অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে’ রেডার। প্রতিপক্ষের রণতরী ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে এর সাহায্যে চিহ্নিত করতে পারবেন ক্যাপ্টেন।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, বিমানবাহী রণতরীর নৌবহরের অংশ হিসাবে ‘টিএফ-২০০০’ ডেস্ট্রয়ার তৈরি করছে তুরস্ক। এর নির্মাণ আঙ্কারার কোনও ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রকল্প নয়। বরং এর মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় শক্তিবৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট রণতরীকে নৌফৌজে যুক্ত করতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান। ওই জায়গায় তুরস্কের ভূ-কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষিত করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে (১৯৩৯-’৪৫) উত্তর তুরস্কের নৌবাহিনী খুব শক্তিশালী ছিল, এমনটা নয়। গত দু’দশকে সে দিকে নজর যায় আঙ্কারার। ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জলযোদ্ধাদের আধুনিকীকরণে জোর দেন এর্ডোয়ান। ফলে নৌসেনার ব্যবহার্য অত্যাধুনিক হাতিয়ার নির্মাণ বা আমদানির উপর মোটা টাকা খরচ করতে থাকে তাঁর সরকার। এর নেপথ্যে অবশ্য একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
সাবেক সেনাকর্তাদের দাবি, পূর্ব ভূমধ্যসাগর, এজ়িয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরীয় এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে প্রবল ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে তুরস্ক। ভূমধ্যসাগরে ‘একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ইইজ়েড (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জ়োন) নিয়ে গ্রিসের সঙ্গে তীব্র বিরোধ রয়েছে আঙ্কারার। একই কথা ওই এলাকার ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
১৯৭৪ সালে সামরিক অভিযান চালিয়ে সাইপ্রাসের উত্তর অংশ দখল করে তুরস্ক। এর পরই ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির সঙ্গে তুঙ্গে ওঠে আঙ্কারার বিবাদ। অন্য দিকে কৃষ্ণ সাগরীয় এলাকায় রুশ নৌবহর ও ডুবোজাহাজের একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে। আর তাই শক্তিশালী ডেস্ট্রয়ারকে বাহিনীর বহরে শামিল করে শত্রুদের পাল্টা চাপে রাখতে চাইছেন এর্ডোয়ান, এমনটাই মত সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের।
২০০০ সালের গোড়ার দিকে ‘ব্লু হোমল্যান্ড’ প্রকল্প নেয় তুরস্ক। এর আওতায় প্রথমে অ্যাডা শ্রেণির কর্ভেট এবং ইস্তানবুল-ক্লাস ফ্রিগেট নির্মাণ করে আঙ্কারা। পরবর্তী পর্যায়ে হালকা বিমানবাহী রণতরী এবং আটটি ডেস্ট্রয়ার তৈরিতে হাত দিয়েছে এর্ডোয়ান প্রশাসন। যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিদেশি নির্ভরশীলতা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’।
তুর্কি নৌকমান্ডারেরা ২০১৭ সালে প্রথম বার ‘টিএফ-২০০০’ ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির রণতরীর প্রয়োজনীয়তার কথা তুললে এই ইস্যুতে চিন্তাভাবনা শুরু করে এশিয়া মাইনর সংলগ্ন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। যুদ্ধজাহাজটিকে উভচর আক্রমণের জলযান এবং বিমানবাহী রণতরীর পরিপূরক হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে প্রেসি়ডেন্ট এর্ডোয়ানের। গত বছরের শেষ দিকে এর নকশা প্রস্তুত করে ফেলে আঙ্কারা।
চলতি বছরের জুলাইয়ে সংশ্লিষ্ট ডেস্ট্রয়ার নির্মাণের বরাত পায় ইস্তানবুলের শিপইয়ার্ড। গত নভেম্বরে রণতরী নির্মাণের কাজ শুরু করে তারা। ২০২৯ সালের মধ্যে পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট যুদ্ধজাহাজটি জলে নামবে বলে মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ২০৩০ সালে ‘টিএফ-২০০০’কে হাতে পাবে আঙ্কারার নৌবাহিনী। প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিদেশি নির্ভরশীলতা থাকার কারণে এই সময়সীমার মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করা যে বেশ চ্যালেঞ্জের, তা বলাই বাহুল্য।
সংশ্লিষ্ট যুদ্ধজাহাজটি তৈরি করতে ৩০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে এর্ডোয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। ‘টিএফ-২০০০’ রণতরীটিতে থাকবে একাধিক শ্রেণির ক্ষেপণাস্ত্র। আর তাই এর নির্মাণ খরচ বাড়তে পারে বলে ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে আঙ্কারা। এ ব্যাপারে কোন কোন দেশের থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা মিলছে, তা অবশ্য গোপন রেখেছে তুরস্ক।
সম্প্রতি আকাশযুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’। এই প্রথম চালকবিহীন জেট ইঞ্জিন চালিত লড়াকু জেটের (ফাইটার ড্রোন) সফল পরীক্ষা চালিয়েছেন সেখানকার প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির সাহায্যে ‘আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র’ (এয়ার টু এয়ার মিসাইল) ছুড়ে উড়ন্ত লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় এশিয়া মাইনর সংলগ্ন এই মুসলিম দেশ।
তুরস্কের নৌবাহিনী অনেকটাই নড়বড়ে হলেও অতি শক্তিশালী একটি ড্রোন ফৌজ রয়েছে তাদের। ডিসেম্বরের গোড়ায় আঙ্কারা যে মানববিহীন লড়াকু জেটের পরীক্ষা চালিয়েছে, তার পোশাকি নাম ‘কিজ়িলেলমা’। এ ব্যাপারে একটি বিবৃতিতে এর্ডোয়ান প্রশাসন জানিয়েছে, ‘আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের’ সাহায্যে নিখুঁত নিশানায় জেট ইঞ্জিন চালিত লক্ষ্যবস্তুকে ওড়াতে সক্ষম হয়েছে তাদের ফাইটার ড্রোন। পরীক্ষার সময় নজরদারির জন্য ছিল এফ-১৫ যুদ্ধবিমান।
যুদ্ধ ড্রোন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে উড়ন্ত কোনও জেট ইঞ্জিন বিমানকে নিশানা করে হামলার সফল পরীক্ষার ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম। যদিও এই পরীক্ষা সম্পর্কে বিশদ তথ্য দেয়নি তুরস্কের এর্ডোগানের সরকার। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, উপকূলীয় সিনোপ ফায়ারিং রেঞ্জে এই পরীক্ষায় গোকডোগান ‘এয়ার-টু-এয়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং মুরাদ আইসা রাডার ব্যবহার করে আঙ্কারার বিমানবাহিনী। এগুলি সব তুরস্কেরই দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি বলে জানা গিয়েছে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এর জেরে পূর্ব ইউরোপে বেধে যায় যুদ্ধ। মস্কোর এই পদক্ষেপকে সাম্রাজ্যবাদী আখ্যা দিয়ে প্রথম থেকেই কিভের পাশে থেকেছে পশ্চিম ইউরোপের যাবতীয় নেটো-ভুক্ত দেশ। শুধু তা-ই নয়, সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের আতঙ্কে সম্প্রতি আট লাখ সেনার একটি বিশাল ফৌজ তৈরির দিকে নজর দিয়েছে জার্মানি।
ইউক্রেন যু্দ্ধ অবশ্য থামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইতিমধ্যেই ক্রেমলিনে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন তাঁর বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার। আলোচনায় বসার আগে অবশ্য ইউরোপীয় দেশগুলিকে যুদ্ধের হুমকি দেন রুশ প্রেসিডেন্ট। বলেন, ‘‘যদি ইউরোপ হঠাৎ করে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করতে চায়, আমরা তার জন্য এখনই প্রস্তুত রয়েছি।’’
পুতিনের এই হুমকির পর তুরস্কের নৌশক্তি বৃদ্ধির খবর প্রকাশ্যে আসায় ইউরোপ জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। নেটোর মোট ৩২টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে গ্রিসের নামও রয়েছে। আঙ্কারার রণতরী নির্মাণকে মোটেই ভাল চোখে দেখছে না এথেন্স। ফলে পাল্টা প্রতিরোধ হিসাবে ভারতের থেকে একাধিক দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে পারে গ্রিকেরা। পাশাপাশি, নেটো ভেঙে রাশিয়ার দিকে তাদের ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কাও প্রবল, বলছেন বিশ্লেষকেরা।