UK’s Child Poverty

দু’বেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে না ৪৫ লক্ষ খুদে, দারিদ্রের আওতায় দুনিয়া-রাজ করা ব্রিটেনের এক-তৃতীয়াংশ শিশু!

রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে ব্রিটেনের শিশু-দারিদ্র। দেশের এক-তৃতীয়াংশ কচিকাঁচার মৌলিক চাহিদা মিটছে না বলে প্রকাশ্যে এসেছে চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:০৪
Share:
০১ ১৮

ইংলিশ চ্যানেলের পারের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র। একটা সময়ে দুনিয়া জুড়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তারা। এটির আকার এতটাই বড় ছিল যে সূর্য কখনও অস্ত যেত না সেখান। ২১ শতকে এ-হেন দ্বীপরাষ্ট্রের উপর পড়েছে রাহুর বক্রদৃষ্টি! আর তাই বড়লোক দেশের তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে সেখানকার শিশু-দারিদ্র। অবস্থা এতটাই খারাপ যে বিপন্ন শৈশবকে বাঁচাতে বেশ কিছু দাতব্য সংস্থার উপরে ভরসা করতে হচ্ছে আমজনতা ও সরকারকে।

০২ ১৮

ভারতের উপর ২০০ বছর রাজত্ব করা ব্রিটেনের এই আর্থিক অবস্থার জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিকেই দুষছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের যুক্তি, বছরের পর বছর ধরে বেশ কিছু কঠোর নিয়মকানুন চালু রেখেছে সেখানকার সরকার। ফলে ধীরে ধীরে ভেঙে যায় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই পরিস্থিতিতে শিশু-দারিদ্র হ্রাসের পদক্ষেপগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন লেবার পার্টিশাসিত দ্বীপরাষ্ট্রের কিয়ের স্টার্মার সরকার।

Advertisement
০৩ ১৮

শিশু-দারিদ্রে ভয়াবহতা নিয়ে চলতি বছরের এপ্রিলে একটা রিপোর্ট প্রকাশ করে ব্রিটিশ প্রশাসন। ফলে প্রকাশ্যে চলে এসেছে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্টার্মার সরকারের দাবি, বর্তমানে আপেক্ষিক দারিদ্রসীমায় বড় হচ্ছে দেশের এক তৃতীয়াংশ শিশু। এদের সংখ্যা কম-বেশি ৪৫ লক্ষ। আগামী দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

০৪ ১৮

এখানে আপেক্ষিক দারিদ্র বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা অবশ্য স্পষ্ট করেছে ব্রিটিশ সরকার। প্রশাসনের দাবি, প্রায় ৪৫ লক্ষ শিশু এমন পরিবারে বড় হচ্ছে যাদের মা-বাবা বা অভিভাবকেরা আবাসন খরচের পর জাতীয় গড় আয়ের ৬০ শতাংশের কম রোজগার করেন। ফলে সন্তানদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না তাঁরা। এর জেরে দেশের ভবিষ্যৎ যে বিপদের মুখোমুখি হতে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য।

০৫ ১৮

ইংল্যান্ডের বিপন্ন শৈশব নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই গবেষণা চালাচ্ছে ‘জোসেফ রাউন্ট্রি ফাউন্ডেশন’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। ২০২৩ সালে প্রকাশিত তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, দ্বীপরাষ্ট্রের প্রায় ১০ লক্ষ শিশু শীতের দিনে ঠিকমতো উষ্ণ এবং শুষ্ক পোশাক পায় না। দু’বেলা পেট ভরে খাবার জুটছে না তাদের। ফলে অনেকেই ভুগছে অপুষ্টিজনিত সমস্যায়। কেউ কেউ তো ছোটবেলা থেকেই শরীরে নানা ধরনের রোগ নিয়ে বড় হচ্ছে বলেও জানিয়েছে তারা।

০৬ ১৮

ব্রিটিশ শিশুদের দারিদ্ররেখার উপর টেনে তুলতে ইতিমধ্যেই একাধিক নীতি প্রণয়নের জন্য সরকারের কাজে আর্জি জানিয়েছে ‘জোসেফ রাউন্টি ফাউন্ডেশন’। সম্প্রতি এ ব্যাপারে গণমাধ্যম সিএনএনের কাছে মুখ খোলেন ‘লিটল ভিলেজ’ নামের দাতব্য সংস্থার চিফ এক্‌জ়িকিউটিভ সোফি লিভিংস্টোন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা বহু পরিবারকে শুধুমাত্র কর্নফ্লেক্স এবং ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে দেখেছি। তাঁদের সন্তানরা স্বাস্থ্যকর দুধটুকু পর্যন্ত পায় না। নিম্ন মানের আবাসনে একই ছাদের তলায় গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে তাঁদের।’’

০৭ ১৮

যে সমস্ত ইংরেজ পরিবার সন্তানদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে, তারাও যে বিপদসীমার বাইরে এমনটা নয়। জোসেফ রাউন্টি এবং লিটল ভিলেজের মতো সংস্থার দাবি, মাসের পর মাস কোনও আর্থিক নিরাপত্তা ছাড়াই বড় হতে হচ্ছে তাদের। ফলে ব্রিটিশ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির মধ্যে বাড়ছে আতঙ্ক। আবাসন ও সন্তানকে বড় করার খরচ এতটাই বেশি যে দারিদ্রসীমার উপরে বসবাসকারীরা সেটা সামলে অন্য কিছুতে আর ব্যয় করতে পারছেন না।

০৮ ১৮

একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দারিদ্রের মধ্যে বসবাসকারী প্রায় ৭০ শতাংশ শিশুর মা-বাবা দু’জনেই কর্মরত। কিন্তু তার পরেও সন্তানের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সমীক্ষক সংস্থা ‘দ্য ইনস্টিটিউট ফর ফিসক্যাল স্টাডিজ়’-এর দেওয়া ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীর অন্যান্য ধনী দেশের তুলনায় ব্রিটেনে শিশুদের লালন-পালন অনেক বেশি ব্যয়বহুল। এর জন্য কোনও দম্পতিকে তার মোট পারিবারিক আয়ের ২৫ শতাংশ এবং একক মা-বাবাদের ৬০ শতাংশ খরচ করতে হচ্ছে।

০৯ ১৮

সমীক্ষকদের দাবি, বর্তমানে বছরে ৪৫ হাজার পাউন্ড (প্রায় ৫৯ হাজার ডলার) আয়ের মহিলার পক্ষে তিন সন্তানের প্রতিপালন কঠিন হয়ে পড়েছে। ছেলে-মেয়ের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য একটা টাকাও জমাতে পারছেন না তিনি। উল্টে কোনও কোনও মাসে ঋণ করতে হচ্ছে তাঁদের। একটু উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে মাসের শেষে হাতে থাকছে মাত্র ২৫০ ডলার।

১০ ১৮

বিশ্বের অন্যান্য ধনী দেশগুলির তুলনায় ব্রিটেনের শিশু-দারিদ্রের সংখ্যা যে হারে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, তাতে স্টার্মার সরকারের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ইউনাইটেড নেশন্‌স ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন্স ইমার্জেন্সি ফান্ড’ বা ইউনিসেফ জানিয়েছে, ২০১২-’২১ সালের মধ্যে এর সূচক বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, গ্রিসকে বাদ দিলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ভুক্ত যে কোনও দেশের তুলনায় ব্রিটেনের শিশু-দারিদ্রের হার বেশি।

১১ ১৮

জীবনযাত্রার মান সংক্রান্ত গবেষণাকারী সংস্থা ‘রেজ়োলিউশন ফাউন্ডেশন’-এর কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রসীমার আওতায় চলে আসবে ব্রিটেনের তিন লক্ষ শিশু। এ ব্যাপারে একটা বৈষম্যের ছবিও তুলে ধরেছেন তাঁরা। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্রটিতে বসবাসকারী কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয়দের প্রায় অর্ধেক সন্তান বেশ গরিব। সেখানে শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে এই হার ২৪ শতাংশ।

১২ ১৮

ইংল্যান্ডের ‘চাইল্ড পভার্টি অ্যাকশন গ্রুপ’-এর পরিসংখ্যানে আবার বলা হয়েছে, একা মা-বাবা বা প্রতিবন্ধী পরিবারের শিশুদের মধ্যে দারিদ্র সবচেয়ে বেশি। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার খারাপ হওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে মনে করে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। তাদের দাবি, এর জেরে কমেছে কর্মসংস্থান এবং লাফিয়ে বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতির হার। ফলে দামি হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। এর সর্বাধিক কুপ্রভাব দেখা যাচ্ছে নিম্ন আয়ের বাসিন্দাদের উপর।

১৩ ১৮

২০১০-’২৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের ক্ষমতায় ছিল মধ্য-ডানপন্থী রক্ষণশীল কনজ়ারভেটিভ পার্টি। দ্বীপরাষ্ট্রের শিশু দারিদ্রের ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য তাদের ঘাড়েই দোষ ঠেলেছেন বর্তমানে কুর্সিতে থাকা লেবার পার্টির নেতা-নেত্রীরা। তাঁদের অভিযোগ, কনজ়ারভেটিভদের শাসনকালে জনকল্যাণমূলক একাধিক প্রকল্পের খরচ কাটছাঁট করা হয়েছিল। এখন তারই ফল ভোগ করতে হচ্ছে।

১৪ ১৮

বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক জোনাথন ব্র্যাডশ। তাঁর কথায়, ‘‘২০০৮ সালে আর্থিক সঙ্কট দেখা দেওয়ায় সরকারি খরচ কমানো ছাড়া কনজ়ারভেটিভদের কাছে আর কোনও রাস্তা ছিল না। ওই সময়ে তিনটি নীতি নিয়েছিল রক্ষণশীলেরা। আজকের শিশু-দারিদ্র বৃদ্ধির জন্য সেটাকেই দায়ী করা যেতে পারে।’’

১৫ ১৮

২০১৬ সালের গণভোটের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটেন। এর জেরে দ্বীপরাষ্ট্রে শুরু হয়ে যায় আর্থিক সঙ্কট। ফলে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা গণকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রথমেই ইংল্যান্ডের পরিবারগুলির সরকারি আর্থিক সাহায্য পাওয়ার একটা সীমা বেঁধে দেন তাঁরা।

১৬ ১৮

এ ছাড়া আবাসন নীতিতে বদল আনে ব্রিটিশ সরকার। কোনও দম্পতি সর্বাধিক দু’টি সন্তানের জন্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ফলে ২০১৭ সালের পর থেকে তিন সন্তানের মা-বাবাদের ক্ষেত্রে শিশু মানুষ করা বেশ ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনও কিছু দাবি করার অধিকারও হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা।

১৭ ১৮

২০১৮-’২৩ সালের মধ্যে একাধিক বার ব্রিটেন সফর করেন রাষ্ট্রপুঞ্জের দুই প্রতিনিধি ফিলিপ অ্যালস্টন এবং অলিভিয়ার ডি শুটার। শিশু-দারিদ্রের হার বাড়তে দেখে সরকারের নিন্দা করেন তাঁরা। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতির বদল ঘটাতে ব্যর্থ হয় তৎকালীন প্রশাসন।

১৮ ১৮

গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) ক্ষমতার আসার পর এ ব্যাপারে কিছুটা উদ্যোগী হয় লেবার পার্টি। সরকারি উদ্যোগে ব্রিটেনে চালু হয় ‘বেস্ট স্টার্ট ফ্যামিলি হাব’। এর জন্য ৫০ লক্ষ পাউল্ড বরাদ্দ করে স্টার্মার সরকার। ফলে দ্বীপরাষ্ট্রের স্কুলগুলিতে বিনামূল্যে শিশুদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ছুটির সময়ে তাদের পেটভর্তি রাখতে আরও ১০০ কোটি পাউন্ড প্যাকেজের কথা ঘোষণা করেছে সরকার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement