ভোগ কাহিনি ছবি: সংগৃহীত।
পুজোর ভোগ, আলাদা তার ব্যপ্তি আর সুবাস। সে মথুরার মাখন মিছরি হোক, কি গুরুদ্বারের কাড়া প্রসাদ।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মন্দিরে ভোগ প্রসাদের ভিন্নতা ঠিক আমাদের দেশের বৈচিত্রের মতোই। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাধারণ আঞ্চলিক বিশেষত্ব মেনে প্রসাদ তৈরি হয়। দুর্গা পুজোর ভোগের ভিন্নতাও অনেক।
সাধারণত ক্লাব, সমিতি, বারোয়ারি অথবা সর্বজনীন পুজোয় ভোগ প্রসাদ নিবেদন করার পদ্ধতির সঙ্গে বাড়ির পুজোর রকম মেলে না। ক্লাব ইত্যাদিতে পুজোর এক দিন হয়তো খিচুড়ি ভোগ নিবেদন করা হয় এবং ভক্তদের সেই খিচুড়িই বিলানো হয়। বাড়ির পুজোয় প্রাসাদে বৈচিত্র অনেক, নিয়মবিধিও রকমারি।
কোন্ননগরের জয়গোপাল মিত্র যে পুজো প্রচলন করেন, সেখানে ভোগের থালায় শীতল ভোগ দেওয়া হয়। তাতে লুচি,ভাজাভুজি আর বোঁদে-পায়েস নিবেদন করার চল। আগে বালুসাই, দরবেশ জাতীয় মিষ্টি তৈরি হত, এখন তা প্রায় অবলুপ্ত। এখানে চার দিনই শীতল ভোগ দেওয়ার প্রচলন, যে মিষ্টি তৈরি হয়, ভক্তদের মধ্যে তা প্রসাদ হিসাবে বিলি করা হয়।
দেবী দুর্গার ভোগের বৈচিত্র অনেক। ছবি: সংগৃহীত।
সাউথ গড়িয়ায় ১২৬ বছরের আশুতোষ হালদার প্রতিষ্ঠিত পুজো, তাঁদের পুজোর কাঠামো বদল হয় না। এঁদের ভোগ প্রসাদে প্রতি দিন ১৩ থালা অন্ন, ১৩ থালা খিচুড়ি, ৭ রকম ভাজা আর কলার বড়া থাকে। দশমীতে অরন্ধন, তাই মায়ের ভোগে পান্তা, কচুশাক আর থোড় মিশিয়ে ঘন্ট। এঁদের বাড়িতে দুর্গার সঙ্গে চণ্ডীদেবীর প্রসাদও দেওয়া হয়, তাতে থাকে গোটা ফল। দশমীতে মায়ের বিসর্জনের পরে কণামাত্র সিদ্ধিপ্রসাদ সকলে গ্রহণ করেন।
দুর্গাপুরের সগরভাঙা এলাকার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো ৫০০ বছরের পুরোনো। তাঁদের পুজোতে মায়ের অন্নভোগ আর আমিষ ভোগ, দুইই হয়। মায়ের নামের পুকুর থেকে মাছ ওঠে, সেই মাছ রোজ রান্না হয় ভোগের প্রসাদে। গুড়-তেঁতুল দিয়ে মাছের টক থাকে প্রসাদে। এ ছাড়া নবমীতে পূজা প্রাঙ্গণের গাছের থোড়ের ঘণ্টও থাকে ভোগের থালায়।
বর্ধমানের চুরপুনি গ্রামের ক্ষেত্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুটুম্ব ছিলেন স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। বিধবা কন্যার বিবাহের জন্য বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার ব্রাত্য হয় গ্রামে। গ্রামীণ আচার অনুষ্ঠান থেকেও সেই পরিবারে সদস্যেরা ছিলেন ব্রাত্য। সেই সময় শুরু হয় বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো। এঁদের পুজোর ভোগে থাকে রোজকার বাঙালি বাড়ির রান্না। ধরাবাঁধা কিছু নিয়ম নেই। ভাত, ডাল, ভাজা, দু রকমের তরকারি, চাটনির মতো সাধারণ পদ থাকে ভোগ প্রসাদে।
মালদার কুশিদা গ্রামে তরফদার বাড়ির পুজোর অষ্টমীতে মিষ্টিভোগ, নাড়ু, মোয়া, মুড়কি ছাড়াও বাড়িতে ময়রা তৈরি করেন রসের মিষ্টি, শুকনো মিষ্টি, বেসনের লাড্ডু। এ ছাড়া এঁদের নিজস্ব এক মিষ্টি 'পেটানো সন্দেশ' নিবেদন করা হয় প্রসাদ রূপে। ছানা আর চিনি কাঠের মুগুরে পিটিয়ে পিটিয়ে ছোট ছোট চ্যাপ্টা সন্দেশ বানানো হয়, যা মায়ের ভোগে শুরু থেকেই দেওয়া হয়।
দেবী দুর্গার ভোগ তৈরি ঘিরে উন্মাদনা কিন্তু সব জায়গাতেই সমান। ফর্দ মিলিয়ে বাজার করা থেকে বাড়ির মহিলাদের হেঁশেলে জমায়েত, ভোগের প্রস্তুতি থেকে বিতরণ, সব বাড়িতেই রয়েছে আলাদা গল্প, যে গল্পগুলিতে বছরের পর বছর কোনও বদল আসে না।