রাকেশ শর্মার চার দশক পর মহাকাশে গেলেন আর এক ভারতীয়— শুভাংশু শুক্ল (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
আমাদের দেশে কবে সেই যান হবে!
১২ এপ্রিল। ১৯৬১ সাল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভস্তক-১ যানে চড়ে প্রথম মানুষ হিসাবে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন রুশ নভশ্চর ইউরি গ্যাগারিন। তার পর পেরিয়ে গিয়েছে ৬৪ বছর। মহাকাশে পা রাখা মানুষের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। তালিকায় নাম জুড়েছে ভারতীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদেরও। সর্বশেষ সংযোজন শুভাংশু শুক্ল। মার্কিন এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং ইসরো-র যৌথ উদ্যোগে বুধবার দুপুরে মহাকাশে উড়ে গেলেন লখনউয়ের ছেলে শুভাংশু। এ বারও কিন্তু ভিন্দেশি যানে চড়েই।
রাকেশ থেকে শুভাংশু— মাঝে ৪১ বছর
১৯৬১ সালের পর থেকে একে একে মহাকাশে মানুষ পাঠিয়েছে রাশিয়া, আমেরিকা, চিন। অথচ ভারত একের পর এক অভিযান সফল ভাবে পরিচালনা করলেও দেশজ যানে কোনও ভারতীয়ের মহাকাশযাত্রার স্বপ্ন এখনও রয়ে গিয়েছে অধরাই। ১৯৮৪ সালে প্রথম ভারতীয় নাগরিক হিসাবে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন রাকেশ শর্মা। রুশ যান ‘সয়ুজ টি-১১’-য় চেপে। অবশেষে রাকেশের ৪১ বছর পরে আবার কোনও ভারতীয় মহাকাশে পাড়ি জমালেন। এ বার মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার হাত ধরে, ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেস এক্সের যানে চড়ে। শুভাংশু ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন। ‘অ্যাক্সিয়ম-৪’ (বা অ্যাক্স-৪) নামের বিশেষ অভিযানে দেশবিদেশের আরও তিন নভশ্চরের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাচ্ছেন শুভাংশু। ১৪ দিন ধরে সেখানে থেকে নানান গবেষণামূলক কাজ করবেন তাঁরা। শুভাংশুই প্রথম ভারতীয়, যিনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পা রাখবেন।
যান: জট অনেক
মহাকাশে মানুষ পাঠানো সহজ নয়। মহাকাশের মতো প্রতিকূল পরিবেশে মনুষ্যবাহী যান পাঠানোর ক্ষেত্রে নানা জটিল বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যেমন, লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম, মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে যাত্রীদের রক্ষা করা, শক্তিশালী ক্রু মডিউল, আরও কত কী। শুধু তা-ই নয়, উৎক্ষেপণ এবং প্রত্যাবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময় মহাকাশচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য নির্ভরযোগ্য লঞ্চ সিস্টেম প্রয়োজন। পাশাপাশি, মহাকাশে যাওয়ার আগে নভশ্চরদের দীর্ঘ প্রশিক্ষণের পরিকাঠামোও থাকা প্রয়োজন। ব্যয়বহুল এই সব অভিযানের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত তহবিলেরও। মূলত পরিকাঠামোগত কারণেই এখনও মহাকাশে মানুষ পাঠানোর মতো প্রস্তুতি নেই ভারতের। সে কারণেই চন্দ্রযান কিংবা মার্স অরবাইটার মিশন (মম)-এর মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে সাফল্য পেলেও ইসরোর মহাকাশে মনুষ্যবাহী যান পাঠানোর স্বপ্ন এত দিন অধরাই রয়ে গিয়েছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে ‘গগনযান’-এর হাত ধরে সেই স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।
‘গগনযান’ কী? কবে?
ভাবনাচিন্তা চলছিল আগে থেকেই। ২০১৮ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচিতে ইসরোর প্রথম মনুষ্যবাহী ‘গগনযান-২০২২’ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ইসরোর তৎকালীন চেয়ারম্যান কে সিভন জানিয়েছিলেন, ২০২২ সালে শ্রীহরিকোটার উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে ওই যান উৎক্ষেপণ হবে। মহাকাশের ৪০০ কিলোমিটার কক্ষপথে মানুষকে পাঠানোর যে পরিকল্পনা, তার অঙ্গ হিসাবে পরীক্ষামূলক ভাবে মহাকাশে মানববিহীন গগনযানও পাঠায় ইসরো। মহাকাশচারীদের মহাকাশে পাঠানোর পর কী ভাবে তাঁদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যায়, খুঁটিয়ে দেখা হয় তা-ও। তার পর থেকে অবশ্য ক্রমশই পিছোচ্ছে গগনযানের উৎক্ষেপণ। শেষমেশ ইসরো জানিয়েছে, সব ঠিক থাকলে আগামী ২০২৭ সালে প্রথম বার মহাকাশে নভশ্চর পাঠাতে পারে ভারত। গগনযানে সওয়ার হয়ে মহাকাশে পাড়ি দেবেন চার নভশ্চর। প্রথম বার দেশের প্রতিনিধি হিসাবে যাঁরা মহাকাশে যাবেন, বছরখানেক আগে তাঁদের নামও ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে। এঁরা ভারতীয় বায়ুসেনা (আইএএফ)-র আধিকারিক বালাকৃষ্ণণ নায়ার, অঙ্গদ প্রতাপ, অজিত কৃষ্ণণ এবং নাসা-র বর্তমান অভিযানের শরিক শুভাংশু। গগনযান অভিযানে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপরে পৃথিবীর কক্ষপথে তিন দিন টানা অবস্থান করবেন মহাকাশচারীরা। এর পর ভারতের সমুদ্র উপকূলবর্তী কোনও জায়গায় তাঁদের অবতরণ করানো হবে। এই প্রকল্প যদি সফল হয়, তা হলে নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাকাশে নভশ্চর পাঠানোর দৌড়ে আমেরিকা, রাশিয়া, চিনের পরে চতুর্থ দেশ হিসাবে নাম জুড়বে ভারতের।
অপেক্ষা
ভারত কবে মহাকাশে নভশ্চর পাঠাবে, সে সব পরের কথা। আপাতত দেড়শ কোটি ভারতীয়ের চোখ শুভাংশুর দিকেই। ইসরোর ভবিষ্যৎ ‘গগনযান’ অভিযানেও থাকবেন বায়ুসেনার এই ক্যাপ্টেন। তবে এ বারের অভিযান নাসার হাত ধরে। ‘অ্যাক্স-৪’ নামের এই অভিযানের জন্য বাছা হয়েছে ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেস-এক্সের ‘ড্রাগন’ মহাকাশযানকে। মহাকাশযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে ফ্যালকন ৯ রকেটের মাধ্যমে। ভারতীয় সময় অনুযায়ী বুধবার বেলা ১২টা ১ মিনিটে আমেরিকার ফ্লরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের ঐতিহাসিক লঞ্চপ্যাড ‘৩৯এ কমপ্লেক্স’ থেকে উড়ান দিয়েছে ‘ড্রাগন’। ১৯৬৯ সালে এই লঞ্চপ্যাড থেকেই নিল আর্মস্ট্রংদের নিয়ে উড়েছিল আমেরিকার ‘অ্যাপোলো ১১’ মহাকাশযান! মানুষ প্রথম পা রেখেছিল চাঁদে। সেখান থেকেই শুভাংশুদের নিয়ে ডানা মেলেছে ‘ড্রাগন’।
ইতিমধ্যে পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছেও গিয়েছেন চার মহাকাশচারী। বুধবার দুপুরে সেখান থেকেই পৃথিবীকে বার্তা দেন ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন। উচ্ছ্বসিত গলায় বলেন, ‘‘সকল দেশবাসীকে নমস্কার। অসাধারণ সফর ছিল! ৪১ বছর পর ভারত আবার মহাকাশে পা রাখল। এই মুহূর্তে আমরা সেকেন্ডে সাড়ে সাত কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছি। আমার কাঁধে ভারতের তেরঙা পতাকা রয়েছে। এই পতাকাই আমাকে বলে দিচ্ছে যে আমি আপনাদের সঙ্গেই রয়েছি!’’ শুভাংশুকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেন, ‘‘শুভাংশু শুক্লই প্রথম ভারতীয় মহাকাশচারী যিনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পা রাখবেন। নিজের কাঁধে ১৪০ কোটি ভারতীয়ের ইচ্ছা, আশা, আকাঙ্ক্ষার ভার বহন করছেন তিনি।’’
প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও, পরোক্ষে ভারতের মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে বুধবারের এই অভিযান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কারণ, এই অভিযানের মাধ্যমেই যেন অলিখিত ভাবে স্থাপিত হয়ে গেল ভবিষ্যতের গগনযান অভিযানের ভিত্তি। শুভাংশু-সহ ইসরোর বিজ্ঞানীরাও মনে করছেন তেমনটাই। এখন কেবল অপেক্ষার পালা।