— প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
দূর গ্রহে মিলেছে প্রাণের সন্ধান! চলতি বছরের শুরুতেই এমনই নানা শিরোনামে ছেয়ে গিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সংবাদপত্রগুলি। সে সময় পৃথিবী থেকে প্রায় ১২০ আলোকবর্ষ দূরের সেই গ্রহ নিয়ে কম জল্পনা হয়নি। ভিন্গ্রহী সেই অনুজীবদের খোঁজে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গবেষণায় নেমে পড়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও। কিন্তু সেই ঘটনার মাত্র মাস দুয়েকের মাথায় যাবতীয় জল্পনায় জল ঢেলে দিল নতুন এক গবেষণা।
ঘটনার সূত্রপাত ২০২৩ সালে। গবেষণা করতে করতে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী হঠাৎই খুঁজে পেয়ে যান সৌরজগৎ থেকে অনেক দূরের এক গ্রহ। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু এর পরেই আসে আসল চমক! গ্রহটির পরিবেশ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে হাইড্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেনের পাশাপাশি আরও একটি রাসায়নিকের সন্ধান পান তাঁরা, যা পৃথিবীতেও রয়েছে। পৃথিবীতে শুধুমাত্র সামুদ্রিক অনুজীবেরাই ওই রাসায়নিক তৈরি করে। তখনই প্রশ্ন জাগে বিজ্ঞানীদের মনে। তা হলে সৌরজগৎ থেকে এত দূরের ওই গ্রহে ওই রাসায়নিক কী ভাবে এল? তবে কি প্রাণ রয়েছে সেখানে?
‘কে২-১৮বি’। মাসদুয়েক আগে আলোড়ন ফেলে দেওয়া সেই গ্রহের পোশাকি নাম এটাই। পৃথিবী তথা সৌরজগৎ থেকে অনেক দূরের এই গ্রহকে এক্সোপ্ল্যানেট (বহির্সৌরজাগতিক গ্রহ)-ও বলা হয়। সেই বছরই ‘কে২-১৮বি’-তে প্রাণের অস্তিত্বের জল্পনা নিয়ে নড়েচড়ে বসেন গবেষকেরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিক্কু মধুসূদনের নেতৃত্বে গবেষণা শুরু করেন কেমব্রিজের এক দল বিজ্ঞানী। মহাকাশের অতি শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ’-এর পাঠানো তথ্য নিয়ে শুরু হয় ঘাঁটাঘাঁটি। আর তখনই তাজ্জব হয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেন, সত্যিই হাইড্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন ছাড়াও চতুর্থ এক যৌগ রয়েছে ওই গ্রহে! সেটি হল ডাইমিথাইল সালফাইড (ডিএমএস)। পৃথিবীতে একমাত্র সালোকসংশ্লেষকারী সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনেরা এই রাসায়নিক তৈরি করে। সমুদ্রের লবণাক্ততার তারতম্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে বাঁচতে প্রতিরক্ষাবলয় হিসাবে এই অণু তৈরী করে তারা। বিশেষ ধরনের উৎসেচক বা এনজ়াইমের সংস্পর্শে ডাইমিথাইল সালফোনিয়োপ্রপিয়োনেট (ডিএমএসপি) ভেঙে গিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি হয় ডিএমএস। ফলে ডিএমএস রয়েছে মানেই আলবাত রয়েছে অনুজীবও! পর পর বার কয়েক পরীক্ষা করে একই ফল পান বিজ্ঞানীরা। ব্যাস, জল্পনা বাড়তে থাকে আরও।
এর পরের কয়েক বছর শুধুই নিরন্তর গবেষণা। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয় মধুসূদন ও তাঁর দলের গবেষণালব্ধ ফল। কিন্তু তখনও সংশয় যাচ্ছিল না বিজ্ঞানীদের। ফলে সেই গবেষণাপত্রের তথ্যগুলি আবারও খতিয়ে দেখা শুরু হয়। মাঠে নামেন শিকাগো থেকে আরিজ়োনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। আর তাতেই ভুল প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে ভিন্গ্রহে প্রাণের ওই তত্ত্ব। আরিজ়োনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক লুইস ওয়েলব্যাঙ্কসের কথায়, গত এক মাস ধরে স্বাধীন ভাবে সে সব তথ্য খতিয়ে দেখেছেন একাধিক গবেষক। তার মধ্যে অন্তত তিনটি পৃথক গবেষণা বলছে একই কথা— ‘কে২-১৮বি’-তে প্রাণের স্পন্দন নেই!
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাফায়েল লুক জানাচ্ছেন, কে২-১৮বি আকারে পৃথিবীর থেকে প্রায় আড়াই গুণ বড়। আর এই গ্রহ রয়েছে পৃথিবী থেকে ১২০ আলোকবর্ষ দূরে। কিলোমিটারের হিসাবে ধরলে যা দাঁড়ায় ১১৩৫ লক্ষ কোটি কিলোমিটারের কাছাকাছি। এত দূরের গ্রহ খালিচোখে তো দূরের কথা, সাধারণ টেলিস্কোপেও দেখা অসম্ভব। এ দিকে ‘কে২-১৮বি’ তার নিজের ‘সূর্যে’র চারপাশে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। অগত্যা ভিন্ন পদ্ধতির শরণ নেন বিজ্ঞানীরা। ওই নক্ষত্রের যে আলো গ্রহটির গায়ে প্রতিফলিত হচ্ছে, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের সাহায্যে তাঁরা তা দেখতে শুরু করেন। দেখা যায়, যখনই গ্রহটি তার সূর্যের সামনে চলে আসছে, তখনই নক্ষত্রের আলোয় সূক্ষ্ম পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ থেকেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন রয়েছে। কিন্তু যা নেই তা হল— ডিএমএসের উপস্থিতির সপক্ষে কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ। গ্রহ থেকে আসা নিয়ার-ইনফ্রারেড এবং মিড-ইনফ্রারেড তরঙ্গগুলি খতিয়ে দেখেও গবেষকেরা বুঝতে পেরেছেন, ‘কে২-১৮বি’-র বায়ুমণ্ডলে নানাবিধ গ্যাসীয় অণু থাকলেও ডিএমএস রয়েছে, এমনটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। ওই গ্রহে থাকতে পারে এমন অন্তত ৯০টি অণু নিয়ে গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ওই অণুগুলি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে মানেই প্রাণের স্পন্দন রয়েছে, এমনও নয়। বরং আলোর সংস্পর্শে রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকেও ওই অণুগুলি তৈরি হতে পারে।
আর এ ভাবেই আশা জাগিয়েও নিরাশ করেছে ‘কে২-বি১৮বি’। এর আগে বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন, ওই গ্রহে হয়তো বিশাল সমুদ্র রয়েছে, আর তাতেই হয়তো রয়েছে প্রাণশক্তির ভান্ডার! কিন্তু আপাতত সে সম্ভাবনা বিশ বাঁও জলে। ভিন্গ্রহী জীবনের দেখা পেতে এখনও শুধুই অনিশ্চিত অপেক্ষা।