এখন করোনাভাইরাস সংক্রান্ত তিনটে বিষয়ে আমরা খুব উৎসুক। প্রথমত, কতটা মারণশক্তি রাখে এই ভাইরাস এবং ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে আগামী দিনগুলো। দ্বিতীয়ত, ঠিক কী ভাবে এল এই ভাইরাস? এটা কি কোনও ষড়যন্ত্র? এবং তৃতীয়ত, বাঁচব কী করে? তাই করোনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা মুলতুবি রেখে শুধু এই তিনটে বিষয়ের বিজ্ঞানটাকে বুঝতে চেষ্টা করি।
গোড়ার কথা হল, এই ভাইরাসের প্রাণভোমরা একটা জিন বা আরএনএ, যা তার বংশগতি রক্ষা করে। এই জিনে জৈব রাসায়নিক ভাষায় ভাইরাসের চরিত্র লেখা থাকে মাত্র চারটে অক্ষর ব্যবহার করে, এবং এই জিনটার দৈর্ঘ্য ৩০,০০০ শব্দের। বংশগতি-বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী, যদি এই অক্ষর এবং শব্দাবলি (জেনেটিক কোড) কোনও ক্রমে বদলে যায়, তা হলে ভাইরাসের চরিত্রও পাল্টে যাবে। ভাইরাসের মারণশক্তি নির্ভর করে তার প্রাণভোমরার ওপর। সেটাই ভাইরাসের অবয়বের প্রোটিন বর্ম এবং মানব কোষের গায়ে তাকে আটকে রাখার আঁকশি তৈরি করে দেয়, যাকে বলা হয় আরবিডি প্রোটিন। ভাইরাস আসলে একটা নির্জীব রাসায়নিক বস্তু, কিন্তু জীব কোষে থাকাকালীন সে কোষের বিপাক প্রক্রিয়া বা মেটাবলিজ়ম ধার নিয়ে দ্রুত প্রজনন করার ক্ষমতা রাখে। এই দ্রুত প্রজননের সময় সে তার ৩০,০০০ শব্দের লেখাটাকে টুকতে গিয়ে প্রচুর বানান ভুল করে বসে, কেননা সজীব প্রাণীর মতো তার সেই লেখার কোনও প্রুফ রিডিং হয় না। এই ভুল বানানের ফলে নিয়ত তার চরিত্র পাল্টায়। একেই আমরা পরিব্যক্তি বা মিউটেশন বলি।
ক’দিন আগেই সুইৎজ়ারল্যান্ডের বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত অভিব্যক্তিবিদ অধ্যাপক রিচার্ড নেহের ‘দ্য সায়েন্টিস্ট’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জানান, কোভিড-১৯ ভাইরাসটি বিগত চার মাসে প্রায় আট বার নিজেকে পাল্টেছে। সে যদি ১৫ দিনেরও কম সময় এ ভাবে নিজেকে পাল্টায়, তা হলে এই অসুখ মহামারির রূপ নেবেই। আজ আমরা সেই আতঙ্কেরই দোরগোড়ায়। কিন্তু এই নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রাণভোমরা যে প্রতিটা পরিবর্তনেই আরও সাঙ্ঘাতিক হয়ে উঠবে, সে কথা তো বিজ্ঞান বলেনি। বুদ্ধি দিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে, সে আরও ভালমানুষও হয়ে উঠতে পারে এবং তার সম্ভাবনাও ৫০ শতাংশ। কাজেই, ভয় পেয়ে লাভ নেই। এ কথাও অবশ্য সত্যি যে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি যদি এই পরিবর্তিত ভাইরাসটা চিনতে না পারে, তা হলেও আর এক বিপদ আছে। ভাইরাসটা তখন নতুন করে উৎপাত আরম্ভ করে দেবে আবার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-এর মতে, প্রতিটি সংক্রমণ ৫-৬ দিনের মাথায় আরও ২.৬ জন লোককে সংক্রমিত করে এবং এই সূত্র ধরে চললে দশটা সংক্রমণ চক্রে— অর্থাৎ ৫০ দিনের মাথায়— প্রায় ৩,৫০০ জন ব্যক্তি সংক্রমিত হওয়ার কথা। আশার খবর এটাই যে সেই জায়গায় আমাদের দেশে ৩০ জানুয়ারি থেকে ২০ মার্চ— অর্থাৎ এই ৫০ দিনে— মাত্র ২৮০ জন সংক্রমিত। আমরা যদি এ কথা ভুলেও যাই যে এ দেশের সব সংক্রমণই বহিরাগত এবং ধরেও নিই যে এর দ্বিগুণ লোক আসলে সংক্রমিত, তা হলেও আমাদের ঝুঁকি প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ মাত্র। তার মানে, আমাদের দেশে এখনও এই সংক্রমণ সমষ্টিগত স্তরে পৌঁছতে পারেনি, যেমনটা চিন বা ইটালিতে ঘটেছে। আমরা যদি একটু সতর্ক ভাবে এই সংক্রমণ চক্রকে ভেঙে দিতে পারি, তা হলেই জিত আমাদের মুঠোয়।
পাশাপাশি, করোনার ওষুধ বা প্রতিষেধক নিয়েও কথা বলা দরকার। সেটা বুঝতে গেলে আর একটু বিজ্ঞান আলোচনা করতেই হবে। কোভিড-১৯ আসলে তেমন অচেনা নয়। এটা একটা বড় ভাইরাস দলের সদস্য, যার নাম করোনা। ২০০৩ সালে এর প্রথম প্রাদুর্ভাব সেই চিনেই ঘটে। তখন তাকে আমরা জেনেছি সার্স ভাইরাস বলে। তাই চিন যখন প্রথম এর কথা হু-কে জানায়, তখন এর নাম রাখে সার্স-কভ-২। বিজ্ঞান জগতে এখনও সেই নাম চলে। এ বার সন্দেহ উঁকি দেয় যে তা হলে সেই মারণ ভাইরাস কি কেউ আবার ইচ্ছে করে তৈরি করছিল, জৈব অস্ত্র বানাবে বলে? স্বাভাবিক সওয়াল। সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকায় এই সন্দেহ একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রোটিনের যে আঁকশি দিয়ে কোভিড-১৯ মানুষের দেহকোষের গ্রাহক স্থানে (রিসেপ্টর এসিই২) অতি সুচারু ভাবে নিজেকে আবদ্ধ করে, সেই প্রোটিন আঁকশি গবেষণাগারে চটজলদি তৈরি করা সম্ভব নয়। একমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনেই এই সূক্ষ্ম বিবর্তন সম্ভব। তা ছাড়া, কোভিড-১৯’এর মৌলিক জিনটি করোনা সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও তার বিন্যাস অন্যান্য মানব করোনাভাইরাসের বদলে বাদুড়ের করোনাভাইরাসের সঙ্গে বেশি মেলে। গবেষণাগারে কেউ মারণ অস্ত্র বানাতে চাইলে সে বাদুড়ের এই নিরীহ মৌলিক জিনটিকেই বা বেছে নেবেন কেন?
এ বার তা হলে আরও একটা বিষয় সামনে আসে। বাদুড়ের সঙ্গে মানব সংস্পর্শ তো অত্যন্ত কম, তা হলে এটা কোন প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের দেহে লাফিয়ে এল, এবং বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এমন ভয়ঙ্কর রূপ নিল? চিনের নাঙ্কাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুয়ান জোশু এবং তার সহ-গবেষকরা কোভিদ-১৯’এর ক্ষেত্রে একটা সাংঘাতিক বিষয় লক্ষ করেন। মিউটেশনে রূপান্তরিত ভাইরাসটির প্রায় ৮০ শতাংশ সার্স ভাইরাসের সঙ্গে মেলে, কিন্তু এই ভাইরাসের আর একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। এটা রিসেপ্টার এসিই২ ছাড়াও ফিউরান নামে মানব কোষের আর একটি প্রোটিনকে পরিবর্তিত করে সংক্রমণ জারি রাখতে পারে। এই বদগুণটি নাকি এইডস ভাইরাসেরও আছে, এবং এতেই এদের মারণশক্তি আরও হাজার গুণ বেড়ে যায়। এই জন্যই ওষুধ তৈরি নিয়ে যত সমস্যা। ওষুধ বা প্রতিষেধক যা-ই হোক না কেন, তাকে এই দু’টো আক্রমণ পদ্ধতিই নিষ্ক্রিয় করতে হবে। এখানেই প্রশ্ন থেকে যায় যে তা হলে কি বাদুড় আর মানুষের মধ্যে আর একটা না-মানুষ আছে, যে এই রূপান্তর ঘটিয়েছে, এবং সে এখনও অন্ধকারে? না কি আছে বিজ্ঞানের আর এক অন্ধকার অধ্যায় বা একটা গবেষণাগার দুর্ঘটনা? সে কথা এখনও আমাদের অজানা।
আপাতত সামনে আছে একটা অদৃশ্য লড়াই আর একটা দৃশ্যমান আতঙ্ক। এ দু’টোই আমাদের জিততে হবে। মারি অরি পারি যে কৌশলে।