গবেষণায় দাবি, আলোয় নিজের ছাপ রেখে দেয় ডার্ক ম্যাটার। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
অস্তিত্ব রয়েছে। টেরও পাওয়া যায়। কিন্তু কখনওই তাদের দেখা মেলেনি। কারণ, তারা অদৃশ্য। অন্ধকারাচ্ছন্ন। ব্রহ্মাণ্ডের সেই সব ভূতুড়ে বস্তুর খোঁজে অবশেষে পথ দেখাল আলো। এতকাল অন্ধকার হাতড়াতে থাকা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে আলোই হয়ে উঠল ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’!
আমাদের চারপাশে গাছপালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, গ্রহ-উপগ্রহ, ছায়াপথ-সহ যে সমস্ত দৃশ্যমান জড় পদার্থগুলি দেখা যায়, তারা এই মহাবিশ্বের মোট ভরশক্তির ৫ শতাংশ মাত্র। বাকি ৯৫ শতাংশ সম্পূর্ণ অদৃশ্য। অজানা। রহস্যময় এক অন্ধকার জগৎ। তার মধ্যে ৭০ শতাংশই হল অদৃশ্য শক্তি (জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ডার্ক এনার্জি)। আর ২৫ শতাংশ সেই সব ভূতুড়ে বস্তু। বিজ্ঞানীরা যাকে ‘ডার্ক ম্যাটার’ বলে থাকেন।
ব্রহ্মাণ্ডের সব নক্ষত্রমণ্ডলই ঘুরছে লাট্টুর মতো। আশ্চর্য, অত জোরে ঘুরেও কিন্তু তারা অটুট। অভিকর্ষ বল নক্ষত্রমণ্ডলের মধ্যে নক্ষত্রদের টেনে রাখার কাজ করে বটে। কিন্তু লাট্টুর ঘোরার যে গতি, তাতে সেই টান উপেক্ষা করে নক্ষত্রদের দিগ্বিদিকে ছিটকে পালানোর কথা। তা ঘটছে না কেন? বিজ্ঞানীদের অনুমান, এখানেই ভেলকি দেখায় ডার্ক ম্যাটার, যা চেনা যায়নি আজ পর্যন্ত। এই সব পদার্থের অভিকর্ষ বল নাকি বাড়তি আকর্ষণ-বল জুগিয়ে আঁটসাঁট ভাবে বেঁধে রেখেছে সব নক্ষত্রমণ্ডলকে।
এই ডার্ক ম্যাটারের শুধু অস্তিত্বটুকুই বিজ্ঞানীদের জানা। এটুকুও পরিষ্কার যে, তারা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন চরিত্রের নয়। কিন্তু তার উৎস কী, কী দিয়ে তৈরি, তা এখনও সম্পূর্ণ অজানা। শুধু বোঝা যায় যে, আলোর সঙ্গে এই সব ভূতুড়ে পদার্থের কিছু একটা শত্রুতা রয়েছে। সে আলো শোষণ করে না। আলো প্রতিফলন, প্রতিসরণ বা বিচ্ছুরণ কিছুই করে না। মহাবিশ্বের এখানে-ওখানে সর্বত্র ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা সত্ত্বেও ডার্ক ম্যাটার দেখা যায় না। কারণ, কোনও যন্ত্র বা ডিটেক্টর দিয়ে শনাক্ত করা যায় না একে। অন্য কোনও পদার্থের সঙ্গে কোনও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও হয় না।
তবে এ বার ব্রিটেনের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দাবি করে বসলেন, ডার্ক ম্যাটারকে এতকাল যে ভাবে পুরোপুরি অদৃশ্য বলে মনে করা হয়েছে, তা আদতে ঠিক নয়। আলো দিয়েই এই ভূতুড়ে বস্তুর রহস্য ভেদ করা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের দাবি, মহাবিশ্বের যে সব স্থান ডার্ক ম্যাটারে পরিপূর্ণ, সেখান দিয়ে আলো গেলে আলোর রং বদলায়। আলোয় একটি হালকা নীল বা লাল আভা দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ, আলোয় নিজের ছাপ রেখে দেয় ডার্ক ম্যাটার।
গবেষণায় দাবি, কোনও দূর নক্ষত্রের আলো যদি ডার্ক ম্যাটারে পরিপূর্ণ এলাকা দিয়ে যায়, তা হলে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যও পরিবর্তিত হবে। অর্থাৎ, আলো যদি লালচে হয়, তা হলে বুঝতে হবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রসারিত হয়েছে। আর যদি নীলচে হয়, বুঝতে হবে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমেছে। তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এই বদল ঘটে মূলত আলোর কণা ডার্ক ম্যাটারের সংস্পর্শে এলে।
মনে করা হয়, এই পৃথিবীতে যে কোনও দুই ব্যক্তি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত সর্বোচ্চ ছ’জন পরিচিতের মাধ্যমে। একে ‘ছয় করমর্দন সূত্র’ (সিক্স হ্যান্ডশেক রুল) বলা হয়। ডার্ক ম্যাটারের সঙ্গে আলোর সম্পর্কও খানিকটা তেমনই বলে দাবি ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের। তাঁদের মত, আলোর সঙ্গে ডার্ক ম্যাটারের সরাসরি কোনও যোগ নেই। তবে অন্য কিছু কণা (হিগস বোসন কণা)-র মাধ্যমে এই যোগাযোগ তৈরি হতে পারে।
গবেষকেরা জানান, এতকাল ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের খোঁজ মিলেছে মহাকর্ষ বল থেকে। কিন্তু এ বার আলোর গতিবিধি দেখেও এই সব ভূতুড়ে পদার্থের হদিস মিলতে পারে। অর্থাৎ, আর ভূতুড়ে কণাদের পিছনে ধাওয়া করতে হবে না। আলোর রং পরীক্ষা করেই ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি টের পাওয়া যেতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মিখাইল বাশকানভ জানান, এর জন্য ভীষণ শক্তিশালী টেলিস্কোপের প্রয়োজন। তাঁর কথায়, ‘‘বিজ্ঞানীদের প্রায় সকলেই বিশ্বাস করেন, ডার্ক ম্যাটার অদৃশ্য। কিন্তু আমরা দেখিয়ে দিলাম, সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ডার্ক ম্যাটারও আলোয় নিজের ছাপ রেখে দিতে পারে। এই গবেষণা বাস্তবে সত্য প্রমাণিত হলে ডার্ক ম্যাটার অনুসন্ধান অনেক সহজ, দ্রুত এবং কম খরচে হতে পারে।’’