Meteorites Found in Sahara Desert

উল্কা রহস্য! সাহারার বুকে খসে পড়া জোড়া প্রস্তরখণ্ড এসেছিল কোন গ্রহ থেকে, জানা গেল

সৌরজগতের গ্রহগুলির মধ্যে এখনও পর্যন্ত এই গ্রহের বিষয়েই সব চেয়ে কম তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ‘রহস্যময়’ এই খুদে গ্রহ সূর্যের এতই কাছে রয়েছে যে মানুষ তো দূরের কথা, কোনও ‘প্রোব’-এর পক্ষেও এর কাছাকাছি যাওয়া কঠিন। এখন পর্যন্ত মাত্র দু’টি মানববিহীন যান এর ধারেকাছে যেতে পেরেছে। ফলে এ হেন গ্রহ থেকে আসা উল্কা নিয়ে উত্তেজিত বিজ্ঞানীরাও।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫ ০৯:০৭
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম। গ্রাফিক সহায়তা: এআই।

বছর দুয়েক আগে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির বুকে পাওয়া গিয়েছিল জোড়া উল্কাপিণ্ড। সেই মহাজাগতিক বস্তু এমন আগ্রহের জিনিস হয়ে উঠবে অনেকেই ভাবতে পারেননি। কোথা থেকে এল , কী তার তাৎপর্য, খুঁজতে শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানীকুল। বিস্তর গবেষণার পর যা পাওয়া গেল, তা বিস্ময়কর। বহু দিক থেকেই যাচাই করে বোঝা গেল এমনটি অতীতে আর সম্ভবত ঘটেনি।

Advertisement

আদতে সেই উল্কাপিণ্ড এসেছিল বুধ থেকে! এ বার তেমনটাই জানাল গবেষণা। আর তা-ই যদি হয়, তা হলে এটাই হবে বুধ থেকে পৃথিবীতে উ়ড়ে আসা প্রথম চিহ্ন। যা পরীক্ষানিরীক্ষা করে সৌরজগতের সব চেয়ে অন্তঃস্থ গ্রহের বিষয়ে আরও বিশদ জানা যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে বুধের ভূতত্ত্ব এবং গঠন সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কমই জানা গিয়েছে। এর আগে কখনও বুধ থেকে আসা কোনও উল্কাপিণ্ডেরও খোঁজ মেলেনি। সে দিক থেকে সাহারার জোড়া উল্কাপিণ্ডই প্রথম! মিটিওরিটিক্যাল সোসাইটির তথ্যসূচি বলছে, এ যাবৎ চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা ছোট-বড় ১,১০০টিরও বেশি উল্কার নমুনা পাওয়া গিয়েছে। এই ১,১০০টি উল্কাপিণ্ডের বেশির ভাগেরই জন্ম চাঁদ এবং মঙ্গলের পৃষ্ঠে বিভিন্ন গ্রহাণুর আঘাতে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনও মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে গ্রহপৃষ্ঠের সংঘর্ষ হলেই যে সব সময় উল্কাপাত হবে, তা নয়। প্রতিটি গ্রহের এই ক্ষমতা থাকে না। যেমন, মঙ্গলের তুলনায় শুক্র পৃথিবীর বেশি কাছাকাছি অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও অত্যধিক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং ঘন বায়ুমণ্ডলের বাধা অতিক্রম করে উল্কাপিণ্ড বেশি দূর যেতে পারে না। তবে বুধের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম খাটে না। তাই অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করেন, বুধের উল্কাপিণ্ড তৈরির ক্ষমতা রয়েছে।

Advertisement

সাহারায় খুঁজে পাওয়া সেই উল্কাপিণ্ড। ছবি: সংগৃহীত।

ব্রিটেনের ওপেন ইউনিভার্সিটির উল্কাবিষয়ক গবেষক বেন রাইডার-স্টোকসের কথায়, ‘‘চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা উল্কাপিণ্ডের সংখ্যা দেখে অনুমান করা যায়, এত দিনে বুধ থেকেও অন্তত ১০টি উল্কাপিণ্ড পৃথিবীতে আসা উচিত। তবে, বুধ সূর্যের অনেক কাছাকাছি থাকায় বুধ থেকে নির্গত যে কোনও উল্কাপিণ্ডকে আমাদের কাছে পৌঁছোনোর জন্য সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবও অতিক্রম করতে হয়। খাতায়কলমে এই ঘটনা অসম্ভব নয়, তবে বাস্তবে বেশ কঠিন। সে কারণেই এত দিন বুধ থেকে আসা একটিও উল্কাপিণ্ড শনাক্ত করা যায়নি।’’ সাহারায় পাওয়া জোড়া উল্কাপিণ্ডের উপর গবেষণার নেপথ্যে রয়েছেন বেন। চলতি বছরের জুন মাসেই ‘ইকারাস’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে বেনদের গবেষণাপত্র।

বেন আরও জানান, সৌরজগতের গ্রহগুলির মধ্যে এখনও পর্যন্ত সব চেয়ে কম তথ্য পাওয়া গিয়েছে বুধের বিষয়েই। ‘রহস্যময়’ এই খুদে গ্রহ সূর্যের এতই কাছে রয়েছে যে, মানুষ তো দূরের কথা, কোনও ‘প্রোব’-এর পক্ষেও এর কাছাকাছি যাওয়া কঠিন। এখন পর্যন্ত মাত্র দু’টি মানববিহীন যান বুধের ধারেকাছে যেতে পেরেছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনও অভিযান বুধ থেকে মাটি বা পাথরের নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়নি। ১৯৭৩ সালে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পাঠানো ‘মেরিনার ১০’ প্রথম বার বুধের কাছাকাছি পৌঁছোয়। এর দীর্ঘ তিন দশক পর ২০০৪ সালে বুধের কক্ষপথে পৌঁছোতে সক্ষম হয় দ্বিতীয় যান ‘মেসেঞ্জার’। অদূর ভবিষ্যতে বুধে তৃতীয় যান পাঠানোর কথাও ভাবা হচ্ছে। ‘বেপিকলম্বো’ নামে ওই যান ২০২৬ সালের শেষের দিকে বুধে পৌঁছোনোর কথা। কিন্তু সে এখনও বছর দেড়েকের অপেক্ষা। অগত্যা জোড়া উল্কাপিণ্ডেই আশার আলো দেখছেন বিজ্ঞানীরা।

২০২৩ সালে সাহারা মরুভূমির বুকে পাওয়া গিয়েছিল উল্কাপিণ্ড দু’টি। এদের নাম দেওয়া হয় ‘নর্থ-ওয়েস্ট আফ্রিকা ১৫৯১৫’ (এনডব্লিউএ ১৫৯১৫) এবং ‘ক্সার ঘিলানে ০২২’ (কেজি ০২২)। সম্প্রতি ওই দুই উল্কাপিণ্ডকেই বুধ থেকে আসা বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। আর তা-ই যদি হয়, তা হলে এক ধাক্কায় অনেক দূর এগিয়ে যাবে বুধ সম্পর্কে গবেষণা। গবেষকদের দাবি, পাথরগুলির বেশ কিছু গঠনগত বৈশিষ্ট্য দেখে অনুমান করা যায়, ওই উল্কাপিণ্ড দু’টি সূর্যের কাছাকাছি কোনও গ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত। তা ছাড়া, বুধ সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত যা যা তথ্য বিজ্ঞানীদের জানা, তার সঙ্গে এই শিলাখণ্ডগুলির একাধিক মিলও পাওয়া গিয়েছে।

অবশ্য বুধ থেকে আসা উল্কা নিয়ে জল্পনা এই প্রথম নয়! এর আগে ২০১২ সালের গোড়ার দিকে দক্ষিণ মরক্কোয় পাওয়া ‘নর্থ-ওয়েস্ট আফ্রিকা ৭৩২৫’ (এনডব্লিউএ ৭৩২৫) নামে এক উল্কাপিণ্ড নিয়েও বিস্তর আলোচনা চলেছিল। বেনের কথায়, ‘‘সে সময় অনেকেই এটা নিয়ে খুব উত্তেজিত ছিলেন! বিশ্ব জুড়ে অনেক মনোযোগও আকর্ষণ করেছিল এই উল্কাপিণ্ড।’’ পরে গবেষণায় দেখা যায়, বুধের পৃষ্ঠের রাসায়নিক গঠনের সঙ্গে ওই উল্কার গঠনগত নানা পার্থক্য রয়েছে। তবে এ বার আশাবাদী বেনও। তিনি বলেন, ‘‘আমরা উল্কা দু’টির নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, সেগুলোর রাসায়নিক গঠন বুধের পৃষ্ঠের সঙ্গে নিখুঁত ভাবে মিলে যাচ্ছে!’’ বেন জানিয়েছেন, দু’টি উল্কাপিণ্ডেই অলিভাইন এবং পাইরক্সিন রয়েছে— দুই’ই হল লোহার-ঘাটতিযুক্ত খনিজ, যা বুধে রয়েছে। তা ছাড়া, উল্কাপিণ্ডের নমুনাগুলিতে লোহার ছিটেফোঁটাও নেই, কেবল সামান্য পরিমাণে প্লেজিওক্লেস রয়েছে। আর এই সবই বুধের পৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়।

তবে, বেন বলছেন, এই দাবিতে কিছু অসঙ্গতিও রয়েছে। কারণ, এই শিলাখণ্ড দু’টির বয়স বুধের গ্রহপৃষ্ঠের চেয়ে প্রায় ৫০ কোটি বছর বেশি। বুধের পৃষ্ঠের বেশির ভাগ অংশ তৈরি হয়েছে ৪০০ কোটি বছর আগে, অথচ এই শিলাখণ্ডদু’টির বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর! তবে এই যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে এখনই বেনদের দাবি নাকচ করে দেওয়া সম্ভব নয়। ঠিক যেমনটা নিশ্চিত ভাবে বলা চলে না যে ওই উল্কা দু’টি এসেছিল বুধ থেকেই! কারণ, বুধের গ্রহপৃষ্ঠ সম্পর্কে এ যাবৎ যা যা জানা গিয়েছে, তার বেশির ভাগই নাসার ‘মেসেঞ্জার’ প্রোবের হাত ধরে। এতে বুধের কক্ষপথ থেকে মূল্যায়ন করে দেখা হয়েছে গ্রহের ভূত্বকের গঠন। এখনও পর্যন্ত কোনও প্রোব বুধে নামতে পারেনি। ফলে যত দিন না বুধ থেকে কোনও নমুনা পৃথিবীতে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে, তত দিন অনুমানের উপর ভিত্তি করেই চলবে গবেষণা!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement