পুজোর মরসুম চলে এসেছে। কেনাকাটাও শুরু করে দিয়েছেন নিশ্চয়ই। ‘বাঙালি মনের গেরস্তপৌষ যৌবনে’ শাড়ির জায়গাটা কিন্তু বরাবরই ‘ইস্পেশাল’। মায়ের আঁচলের গন্ধ কিংবা সরস্বতী পুজোয় প্রথম বার…এই শব্দগুলো শুনলে প্রথমেই মনে পড়ে শাড়ি। সুস্মিতা সেনের মতো অনেক নায়িকারই প্রথম পছন্দ শাড়ি। আমাদের দেশে রয়েছে শাড়ির অজস্র রকমফের।
‘শাড়ি’ শব্দের উৎস সংস্কৃত ‘শাটী’ থেকে। ‘শাটী’-র অর্থ পরিধেয় বস্ত্র। মুঘল আমলে শাড়ি পরা হত এক প্যাঁচে। ভিক্টোরিয়ান যুগে ফুলহাতা ব্লাউজ ও পেটিকোটের চল শুরু হয়। তবে এদেশের নারীরা আধুনিক শাড়ি পরার চলন শিখেছেন মূলত ঠাকুর বাড়ির কল্যাণে৷ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর অবদান এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য।
বাংলার তাঁত: শান্তিপুর, ধনেখালি বা বেগমপুরি, কখনও হালকা, কখনও বা একটু ভারী। কখনও চওড়া পাড়, কখনও সরু, কখনও বা গোটা শাড়িজুড়ে বুটি। এক্কেবারে হাতে বোনা সুতির শাড়ি ‘হ্যান্ডলুম’।
ঢাকাই জামদানি: অতি সূক্ষ্ম মসলিন ফ্যাব্রিকের উপর জামদানি কাজ। ঢাকা শহরের নামে এ শাড়ির নাম।
বাংলার বালুচরী: বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের তাঁতিরা বোনেন এই সিল্কের শাড়ি। পাড় ও আঁচলে থাকে রামায়ণ মহাভারতের গল্প, সুতোয় বোনা হয় কাহিনি। সুতোর রং সোনালি হলে বালুচরীকে বলা হয় স্বর্ণচরী। রয়েছে মুর্শিদাবাদের সিল্কের শাড়িও।
বাংলার কাঁথা শাড়ি: সেলাইয়ে কাঁথার নকশা এল শাড়িতে। মূলত সুতি, সিল্ক বা তসর সিল্কের উপরে রান সেলাই দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় নকশা।
বারাণসীর বেনারসী: শাড়িটি সূক্ষ্ম রেশমের। মুঘল আমলে সোনা ও রুপোর জরি দিয়েই তৈরি হত এই শাড়ি। পরবর্তীতে যা পাল্টেছে। বিয়ের আসর শুধু নয়। ঐতিহ্যবাহী শাড়ির অন্যতম এটি। এক বছরের বেশি সময় লাগে একটি খাঁটি বেনারসী বুনতে।
কেরলের কাসাভু বা সেত্তু: পেটিকোট, ব্লাউজ আর তার উপর দিয়ে জড়িয়ে নেওয়া একটা সোনালি পাড়ের চাদর, সবটা মিলেই তৈরি এই ‘সেত্তু’। ঐতিহ্যবাহী শাড়িটির ধরন আধুনিক হলেও পুরনো ধারা বজায় রেখেছেন প্রবীণরা। সোনালি পাড়টি প্রথমে সোনার পাত দিয়ে তৈরি হত। পরবর্তীতে কৃত্রিম সুতো ব্যবহার হয়।
তামিলনাড়ুর কাঞ্জিভরম: কাঞ্জিভরম এলাকারই সিল্কের শাড়িগুলিতে থাকে ভারী জড়ির পাড়। খুব জমকালো শাড়ি এগুলি। অন্ধ্রপ্রদেশে এই ধরনের শাড়িই আবার ধর্মাভরম।
অন্ধ্রপ্রদেশের কলমকারি: সুতি বা সিল্কের উপর কলমের নিব দিয়ে সূক্ষ্ম জ্যামিতিক বা কল্কা প্যাটার্ন দিয়ে জংলা কাজ এই শাড়ির বিশেষত্ব। প্রথমে কাপড়গুলি নাকি দুধে ধুয়ে নেওয়া হয়।
অন্ধ্রপ্রদেশের গাদোয়াল: একরঙা ঢালা জমি অথবা ছোট্ট ফুল বা কল্কা বুটি থাকে। উজ্জ্বল পাড় এবং আঁচল এই শাড়ির বিশেষত্ব। পাড়ে থাকে মন্দিরের চূড়ার মতো ত্রিভুজ প্যাটার্ন।
তামিলনাড়ুর কোনরাড: দেবদাসীদের পরনে থাকত এই শাড়ি। চওড়া পাড়ে জীবজন্তুর মোটিফ থাকে অনেক সময়। শাড়ির জমিতে চেক বা স্ট্রাইপ নকশা ফুটে ওঠে।
ওড়িশার বোমকাই: ইক্কত ও সুতোর কাজের সংমিশ্রণে তৈরি শাড়িগুলি সুতির হয় বা সিল্কের।
ওড়িশার সম্বলপুরী, বিচিত্রপুরী: শাড়ি বোনার আগে রং করা হয় সুতো। ঘন রঙের খাঁটি সম্বলপুরী শাড়ির রং তাই কখনওই ম্লান হয় না। অনেকে একে কটকিও বলে থাকেন।
মহারাষ্ট্রের পৈঠানি: ভারী জড়ির কাজ থাকে হাতে বোনা সিল্কের শাড়িগুলিতে। ঔরঙ্গবাদের শাড়িটিতে ময়ূরের মোটিফ ও সূক্ষ্ম বুটি থাকবেই।
গুজরাতের বাঁধনি: গুজরাতের ক্ষত্রি সম্প্রদায় প্রথম বোনেন এটি, এমনটাই মনে করা হয় বন্ধন থেকে বাঁধনি। ‘টাই অ্যান্ড ডাই’ প্রসেসে তৈরি শাড়ি মেলে রাজস্থানেও। রাজস্থানের লেহরিয়া বাঁধনিতে ‘ডাই’-এর সঙ্গে ‘টাই’ হয়।
রাজস্থানের কোটা: সম্ভবত সব থেকে স্বচ্ছ সুতির শাড়ী। এর বুননে চেক নকশা ফুটে ওঠে।
অসমের মুগা: সিল্ক ও তসরের মধ্যে অন্যতম সেরা এটি। উজ্জ্বল হলুদ রঙের রেশম সিল্কটি অসম ও সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রাকৃতিক ভাবে পাওয়া যায়। এক ধরনের মথের লালা থেকে তৈরি হয় সুতো।
বিহারের ভাগলপুরী তসর, ঘিচা: তসর সিল্কের উপর বিশেষ ধরনের ‘ডাই’ করা হয়। ২০০ বছরের বেশি প্রাচীন এই শাড়িটি।
মধ্যপ্রদেশের চান্দেরি: সিল্ক এবং সুতির মিশ্রণে তৈরি। গল্পে আছে ছোট্ট বাঁশের কৌটো করে মুঘল দরবারে উপহার দেওয়ার পর সম্রাটের কথামত সেই শাড়ি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয় একটি হাতিকে। চেক এবং ফুলের নকশা থাকে সমস্ত জমি জুড়ে। আঁচল-পাড়ে থাকে ভারী জরির কাজ।
তেলঙ্গানার পচমপল্লি: বুধন শহরের শাড়িটি ওড়িশার ইক্কতের মতো ‘টাই-এন-ডাই’ পদ্ধতিতে সুতো রাঙিয়ে নিয়ে জ্যামিতিক নকশায় বোনা হয়।
পাঞ্জাবের ফুলকারি শাড়ি: ‘হির-রঞ্ঝা’-র গল্পে উঠে এসেছে এটির কথা। ফুলের নকশা ফুটে ওঠে রঙিন সুতোর মাধ্যমে। উজ্জ্বল বর্ণের শাড়িটি সুতি বা খাদির হয়।
লখনউ চিঙ্কারি: প্রথম শুধু মসলিনে বোনা হত, পরবর্তীতে সবরকম কাপড়ের উপরেই লখনউয়ের চিকনের কাজের শাড়ি তৈরি করা হয়েছে।
গুজরাতের তাঞ্চোই: শাটিন জমির উপর শাটিন সুতো দিয়ে কাজ থাকে। মোটিফগুলো জমির সঙ্গে মিশে গিয়েছে মনে হয়। ভারী শাড়ি।
গুজরাতের জারদৌসি: অ্যাপলিক এবং জরি-চুমকির মিশ্রণে তৈরি হয় জারদৌসি কাজ। খুব উজ্জ্বল এই শাড়িটি মূলত সুরাতে তৈরি হয়।