অ্যান্ডি পাইক্রফ্ট। ছবি: পিটিআই।
করমর্দন বিতর্কের কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যান্ডি পাইক্রফ্টকেই সুপার ফোরে ভারত বনাম পাকিস্তান দ্বৈরথের ম্যাচ রেফারি হিসাবে নির্বাচিত করল আইসিসি। সংবাদ সংস্থাকে খবরটি নিশ্চিত করেছেন প্রতিযোগিতার এক আয়োজক। অর্থাৎ, সুপার ফোরের ম্যাচেও পাকিস্তানের দাবি মানা হল না।
গ্রুপ পর্বে এই ম্যাচের পর পাকিস্তান বোর্ড অভিযোগ করেছিল যে, পাইক্রফ্টই নাকি সলমন আঘাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ভারত অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদবের সঙ্গে করমর্দন না করার। পাইক্রফ্ট যাতে তাদের কোনও ম্যাচে রেফারি হিসাবে না রাখা হয়, তার অনুরোধ করেছিল পাকিস্তান বোর্ড। সেই দাবি মানেনি আইসিসি। তারা গোড়া থেকেই জানিয়েছিল, বিতর্কে পাইক্রফ্টের কোনও ভূমিকা নেই। তাই আগামী রবিবার সুপার ফোরের ম্যাচেও পাইক্রফ্টকে ম্যাচ রেফারি রাখা হয়েছে।
আইসিসির এক কর্তা জানিয়েছেন, করমর্দন না করার সিদ্ধান্ত ভারতীয় দল নেয়নি। বিষয়টি তাঁদের জানিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)। সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর নয়াদিল্লির পরামর্শে নিজেদের অবস্থানের কথা জানায় বিসিসিআই। বলা হয়, বহুদলীয় প্রতিযোগিতায় খেলায় আপত্তি না থাকলেও পাকিস্তানের অধিনায়কের সঙ্গে করমর্দন করবেন না সূর্যকুমার। পুরো ব্যাপারটা টসের কয়েক মিনিট আগে হওয়ায় সেই সময় পাইক্রফ্টের হাতে কোনও বিকল্প ছিল না। তাঁর মনে হয়েছিল, সলমন রীতি মেনে করমর্দনের জন্য হাত এগিয়ে দেওয়ার পর সূর্যকুমার সরে গেলে অন্য রকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তেমন কিছু যাতে না হয়, সেটাই নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন ম্যাচ রেফারি হিসাবে।
পাকিস্তান পাইক্রফ্টের সেই পরামর্শকেই তাঁর নির্দেশ বলে বিবেচনা করেছে। ক্ষুব্ধ পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায় আইসিসিকে। পাক কর্তাদের বক্তব্য ছিল, এমন অস্বাভাবিক অনুরোধের বিষয়টি আইসিসিকে জানানো উচিত ছিল পাইক্রফ্টের। তা না করে তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাইক্রফ্ট আইসিসির আচরণ বিধি এবং এমসিসির নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। ম্যাচ রেফারির নির্দেশে নষ্ট হয়েছে ক্রিকেটীয় স্পিরিট।
অভিযোগের পাশাপাশি পিসিবির দাবি ছিল, পাইক্রফ্টকে এশিয়া কাপের দায়িত্ব থেকেই সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু ৬৯ বছরের নির্দোষ এবং অভিজ্ঞ ম্যাচ রেফারির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে রাজি হননি আইসিসি কর্তারা। কারণ তিনি কোনও ভাবেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি। খেলার বাইরে কোনও কিছু দেখা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। ম্যাচ রেফারি হিসাবে তাঁর দায়িত্ব শুধু সুষ্ঠু ভাবে খেলা সম্পন্ন করা। পাইক্রফ্ট পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিস্থিতি সামলেছিলেন বলেও জানিয়ে দেয় আইসিসি।
পাইক্রফ্টকে এশিয়া কাপের দায়িত্ব থেকে না সরালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বিরুদ্ধে না খেলার হুঁশিয়ারি আগেই দিয়েছিলেন পাক কর্তারা। আইসিসির পর্যবেক্ষণ, পিসিবির ওই হুঁশিয়ারিই পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। পাইক্রফ্টকে সরানোর দাবি আইসিসি না মানায়, পিসিবি নতুন দাবি করে, তাঁকে পাকিস্তানের কোনও ম্যাচে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। তা-ও মানেনি আইসিসি। নির্দোষ ম্যাচ রেফারির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হলে অন্যদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যেতে পারত। তা ছাড়া পরিষ্কার বলা হয়, খেলার বাইরের বিষয়গুলি দেখার কথা ভেন্যু ইনচার্জ এবং প্রতিযোগিতার আয়োজক এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি)। এর পর পাক কর্তারা আমিরশাহির বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলা নিয়ে টালবাহানা শুরু করেন। কারণ ওই ম্যাচের দায়িত্বেও ছিলেন পাইক্রফ্ট।
সমস্যা সমাধানে আইসিসি কর্তারা ম্যাচের আগে পাকিস্তানের অধিনায়ক, কোচ এবং ম্যানেজারের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন পাইক্রফ্টকে। সেই মত তিনি কথা বলেন সলমনদের সঙ্গে। ভুল বোঝাবুঝি এবং ১৪ সেপ্টেম্বরের ম্যাচের আগে বিষয়টি ঠিক মতো বোঝাতে না পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন পাইক্রফ্ট। যদিও পিসিবি দাবি করে, পাকিস্তান দলের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন পাইক্রফ্ট। তাদের দাবি এক রকম খারিজ করে দিয়েছে আইসিসি।
ভারতের বিরুদ্ধে হারের পর সেই রাতেই আইসিসির কাছে অভিযোগ জানায় পিসিবি। পরের দিন সকালে আরও একটি অভিযোগ জানানো হয়। দুটো অভিযোগই পিসিবি জানিয়েছিল আইসিসির জেনারেল ম্যানেজার ওয়াসিম খানকে। ঘটনা চক্রে তিনি পিসিবির প্রাক্তন সিইও। দ্বিতীয় অভিযোগে প্রশ্ন তোলা হয় পাইক্রফ্টের নিরপেক্ষতা নিয়েও। তার পর আইসিসি চিঠি দিয়ে জানায়, অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে পাইক্রফ্টের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছে। পাইক্রফ্টের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। কথা হয়েছে প্রতিযোগিতার ডিরেক্টর অ্যান্ড্রু রাসেলের সঙ্গেও। তবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তাঁর কোনও দোষ নেই।
ওয়াসিমের সই করা এই চিঠি পেয়ে কিছুটা চাপে পড়ে যান পাক কর্তারা। আইসিসির অবস্থানে হতাশ হলেও মহসিন নকভির (পিসিবি চেয়ারম্যান এবং এসিসি সভাপতি) সে সময় বিশেষ কিছু করার ছিল না। নকভি পাকিস্তান সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী। তাঁর উপর চাপ ছিল পাক প্রশাসনেরও। পাইক্রফ্টকে দায়িত্ব থেকে সরানো না হলে পিসিবিকে এশিয়া কাপ থেকে দল প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। ক্রিকেটীয় আইনের যুক্তিতে ‘ব্যাকফুট’এ চলে পাওয়া নকভি তবু মরিয়া ছিলেন।
আমিরশাহি ম্যাচের আগের দিন রীতি মেনে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হননি পাকিস্তান দলের কেউ। তা থেকে শুরু হয় জল্পনা। পাকিস্তান কি তা হলে সত্যিই এশিয়া কাপ থেকে সরে দাঁড়াবে? ম্যাচের দিন পিসিবি সলমনদের হোটেল থেকে বেরোতে বারন করায় জল্পনা আরও বৃদ্ধি পায়। আইসিসি কর্তাদের সঙ্গে পিসিবি কর্তাদের দফায় দফায় বৈঠক শুরু হয় ভিডিয়ো কনফারেন্সে। বৈঠকে ছিলেন এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারাও। একাধিক ইমেল চালাচালিও হয়। তখনও পিসিবি পাইক্রফ্টের অপসারণের দাবিতে অনড় ছিলেন। উল্টো দিকে আইসিসি কর্তারাও নিয়ম না ভাঙার সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। তৈরি হয়েছিল জটিল পরিস্থিতি।
ম্যাচ শুরুর ২ ঘণ্টা আগে দুবাইয়ের সময় অনুযায়ী বিকাল ৪টে নাগাদ ম্যাচ আয়োজনের শেষ চেষ্টা করা হয় এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষে। আইসিসি এবং পিসিবিকে আবার বৈঠক করতে রাজি করান তাঁরা। চাপ বাড়াতে সে সময়ই ক্রিকেটারদের হোটেল না ছাড়ার নির্দেশ দেয় পিসিবি। কারণ বিকাল সাড়ে ৪টের সময় পাকিস্তানের বাস স্টেডিয়ামের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল। পরিস্থিতি সামলাতে ওয়াসিম এবং আইসিসির সিইও সঞ্জয় গুপ্ত আলোচনার প্রস্তাব দেন পাইক্রফ্টের সঙ্গে। যদিও জানিয়ে দেওয়া হয়, কোনও অবস্থাতেই পাইক্রফ্টকে দায়িত্ব থেকে সরানো হবে না।
দর কষাকষিতে নকভির সঙ্গী ছিলেন পিসিবির দুই প্রাক্তন চেয়ারম্যান নজম শেঠি এবং রামিজ় রাজা। আইসিসির প্রতিনিধিরা একের পর এক নিয়ম তুলে ধরে পিসিবি কর্তাদের দাবিগুলিকে যুক্তিহীন প্রমাণ করেন। দীর্ঘ আলোচনার পর বরফ গলে। দল নামাতে রাজি হন পিসিবি কর্তারা। ভারত এবং পাকিস্তানের দুই কর্তার যৌথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে শেষ পর্যন্ত। ম্যাচ ১ ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়।