Yuvraj Singh's Impact on Indian Cricket

অভিষেক-শুভমন থেকে প্রিয়াংশ- প্রভসিমরন! প্রায় নীরবে ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে মগ্ন ‘দ্রোণাচার্য’ যুবরাজ সিংহ

চাইলেই ধারাভাষ্যকার হতে পারতেন। এখন তো দেশের হয়ে হাতেগোনা ম্যাচ খেলেও প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা বিশেষজ্ঞ হয়ে ধারাভাষ্যকারের বক্সে বসে পড়েন। সেখানে যুবরাজ তো তারকা। কিন্তু তিনি সে আরামের পথে হাঁটেননি।

Advertisement

দেবার্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩:৫২
Share:

অভিষেক শর্মা (বাঁ দিকে) ও শুভমন গিলকে (মাঝে) তৈরি করেছেন যুবরাজ সিংহ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

শাহিন শাহ আফ্রিদির ১৩৮ কিলোমিটার গতিতে ধেয়ে আসা ম্যাচের প্রথম বলই বাউন্সার। ফুঁ দেওয়ার মতো হুক করে গ্যালারিতে উড়িয়ে দিলেন অভিষেক শর্মা। সেই শাহিনকেই কব্জির মোচড়ে ফ্লিক করে শুভমন গিল পাঠালেন স্টেডিয়ামের দোতলায়। ২০২৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর।

Advertisement

২০০৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। ডারবানের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লি-কে হুবহু এই ভাবে ফ্লিক করে ১১১ মিটার লম্বা ছক্কা মেরেছিলেন এক ভারতীয়। যুবরাজ সিংহ।

কেন এই দু’টি অনুচ্ছেদ পরপর লেখা। কারণ, এই দুই ঘটনার তিন কুশীলব একটি সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছেন। শিষ্যের সঙ্গে গুরুর সম্পর্ক। যুবরাজের গুরুকুলের ছাত্র অভিষেক-শুভমন। গুরুর মন্ত্রেই খেলছেন তাঁরা। আর গুরু নীরবে ব্যস্ত রয়েছেন ভবিষ্যতে আরও শুভমন-অভিষেক তৈরির কাজে। নিঃশব্দে। প্রচারের আলোর বাইরে।

Advertisement

২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরে নিজের অ্যাকাডেমি শুরু করেছিলেন যুবরাজ। চাইলেই ধারাভাষ্যকার হতে পারতেন। এখন তো দেশের হয়ে হাতেগোনা ম্যাচ খেলেও প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা বিশেষজ্ঞ হয়ে ধারাভাষ্যকারের বক্সে পড়েন। যুবরাজ তো তারকা! চাইলেই যে কোনও সম্প্রচারকারী চ্যানেল লুফে নিত তাঁকে। তিনি চাননি। চাইলে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বা নিদেনপক্ষে পঞ্জাব ক্রিকেট বোর্ডের প্রশাসনেও ঢুকতে পারতেন। ঠান্ডা ঘরে বসে ছড়ি ঘোরাতে পারতেন। তা-ও চাননি। জীবন তাঁকে আরাম করার সুযোগ দেয়নি। ক্যানসারে ভুগতে ভুগতে দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। সেই বিশ্বকাপে তিনিই সিরিজের সেরা। ক্যানসারকে জয় করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন। ভারতের অধিনায়ক হওয়া নিয়ে বার বার মহেন্দ্র সিংহ ধোনির পাশাপাশি তাঁর নাম নিয়ে আলোচনা হলেও যুবরাজ কোনওদিন মুখ খোলেননি। পিতা এবং তাঁর ছোটবেলার কোচ যোগরাজ সিংহ পুত্রের কেরিয়ার শেষ করার নেপথ্যে ধোনিকে দায়ী করলে যুবরাজ বরং পিতার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলেছেন। ধোনিকে দায়ী করেননি।

অবসরের পরেও আরাম ছেড়ে যুবরাজ বেছে নিয়েছেন রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে প্রতিভা তুলে আনার কাজ। সেখানেই তাঁর নজরে পড়েন অভিষেক ও শুভমন। দু’জনেই পঞ্জাবের ছেলে। স্কুল থেকে একসঙ্গে খেলছেন। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও একসঙ্গে ভারতীয় দলে খেলেছেন। প্রতিভা চিনতে পেরেছিলেন ‘জহুরি’ যুবরাজ। তাঁদের ঘষেমেজে আরও ঝকঝকে করে তুলেছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ আপাতত এই দু’জনের হাতে। শুভমন লাল বলের ক্রিকেটের অধিনায়ক হয়েছেন। ব্যাট হাতে ইংল্যান্ডের মাটিতে রেকর্ড গড়েছেন। অভিষেক টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটার। স্বল্প কেরিয়ারে তিনি ক্রিকেটদুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন।

এশিয়া কাপে মারমুখী মেজাজে অভিষেক শর্মা। ছবি: পিটিআই।

বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “ও যা করছে তার তুলনা নেই। পুরোপুরি নিজের চেষ্টায় ক্রিকেটার তৈরি করছে। বোর্ডের কাছে কোনও সাহায্য চায়নি। পঞ্জাবে যে এত ভাল ভাল ক্রিকেটার, বিশেষ করে ব্যাটার রয়েছে, যুবরাজ না থাকলে বোঝাই যেত না।” সম্বরণের নিজেরও অ্যাকাডেমি রয়েছে। ফলে তিনি জানেন, যুবরাজের কাজ কতটা কঠিন। বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটারের কথায়, “ক্রিকেটার তৈরি করা সহজ নয়। অনেক পরিশ্রম করতে হয়। যারা ক্রিকেটার তৈরি করে, তাদের কথা কেউ ভাবে না। কিন্তু তারাই আসল। যুবরাজও পিছনে থেকে নিজের কাজটা করে যাচ্ছে।”

সত্যিই তাই। অভিষেককে দিনের পর দিন নিজের বাড়িতে রেখেছেন। পার্টি করতে ব্যগ্র, বান্ধবী নিয়ে ঘুরতে যেতে উচাটন তরুণকে দু’দিন তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন তাঁর গুরু। কেড়ে নিয়েছিলেন মোবাইল ফোন। শুভমনের ক্ষেত্রে তাঁকে অতটা কঠোর হতে হয়নি। বস্তুত, শুভমনের চেয়ে অভিষেক যুবরাজের বেশি কাছের। নিজের গাড়িতে অনুশীলনে নিয়ে গিয়েছেন। গাড়ি থেকে অভিষেকের কিটব্যাগ নিজে বয়ে নিয়ে গিয়েছেন। হয়তো তাঁর মতো বাঁ-হাতি বলে। ছোট থেকেই বড় শট খেলতে ভালবাসেন অভিষেক। বাবা রাজকুমার শর্মা বলেছেন, “ওর ছক্কা মারার ক্ষমতা ঈশ্বরপ্রদত্ত। বাকিদের থেকে কয়েক সেকেন্ড আগে ও বল বুঝে যায়। তাই এত সহজে ছক্কা মারতে পারে।” যুবরাজ সেই ঈশ্বরদত্ত প্রতিভাকে আরও ধারালো করেছেন। তিনি অভিষেককে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছক্কা মারতে শিখিয়েছেন। অর্থাৎ সামনের নয়, পিছনের পায়ে ভর দিয়ে ‘হিট’ করার প্রশিক্ষণ। সামনের পায়ে বা ক্রিজ় ছেড়ে বেরিয়ে ছক্কা মারতে গেলে ব্যাটার বাড়তি গতি পেয়ে যান। যা ছক্কা মারতে সুবিধা করে। কিন্তু পিছনের পায়ে ছক্কা মারতে হলে গায়ের জোর এবং টাইমিং গুরুত্বপূর্ণ। সেই অনুশীলনই অভিষেককে দিনের পর দিন করিয়েছেন যুবরাজ। এশিয়া কাপে যে ভাবে ক্রিজ়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ২৫ বছরের অভিষেক স্পিনারদের ছক্কা মারছেন, তা ৪৩ বছরের যুবরাজকে সন্তুষ্টই করবে।

শিষ্য অভিষেকের (ডান দিকে) সঙ্গে গুরু যুবরাজ। ছবি: সমাজমাধ্যম।

তবে অভিষেকের ‘তারকা’ হয়ে ওঠার পিছনে নিজের চেষ্টার কথা বলেন না যুবরাজ। তিনি বলেন, ‘‘বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ও নিজেই উন্নতি করেছে। শারীরিক ভাবে আরও শক্তিশালী হয়েছে। যখন শুরু করেছিল তার থেকে ব্যাট স্পিড দ্রুততর হয়েছে। ওর টেকনিকের যে বদলগুলো আমরা করিয়েছি....। তবে তার কৃতিত্ব আমার নয়। পুরো কৃতিত্বটাই ওর এবং ওর বাবার। কঠোর পরিশ্রম করেছে। আমার মতে, এই মুহূর্তে ওকে এতটা বিপজ্জনক দেখাচ্ছে কারণ খেলাটার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিয়েছে।’’

যুবরাজ নিজেকে কৃতিত্ব দিতে না চাইলেও অভিষেকের বাবার কাছে যুবিই সব। রাজকুমারের কথায়, “যুবি পাজি ওর গুরু। অভিষেককে বার বার একটাই মন্ত্র দিয়েছেন উনি। পরিস্থিতি দেখে খেলো। ভারতকে জেতানোর কথা ভাবো।’’ তবে পাশাপাশিই জানাচ্ছেন, ছক্কা মারার অভ্যাস বদলাতে বলেননি যুবরাজ। উল্টে সেই ক্ষমতা আরও তীক্ষ্ণ করেছেন। রাজকুমারের কথায়, ‘‘এখন অভিষেক চোখ বন্ধ করেও ছক্কা মারতে পারে।”

অভিষেক-শুভমনকে জীবনের পাঠও দিয়েছেন যুবরাজ। তাঁর নিজের জীবনে চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই যুবরাজ তারকা। কোচবিহার ট্রফিতে ধোনির বিহারের মোট রানের থেকে একাই এক রান বেশি করেছিলেন যুবরাজ। যা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন ধোনি। পঞ্জাবকে একের পর এক ট্রফি জিতিয়েছেন যুবরাজ। যখন ধোনি খড়্গপুরে রেলের টিকিট পরীক্ষক, যুবরাজ তখন ভারতীয় দলের হয়ে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ খেলছেন। ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছয় ছক্কা মেরেছেন, এক দিনের ক্রিকেটে তাঁর ব্যক্তিগত সর্বাধিক স্কোর অপরাজিত ১৫০। আশ্চর্য নয় যে, গৌতম গম্ভীর বার বার বলেন, তাঁর চোখে ভারতের সেরা সাদা বলের ক্রিকেটার যুবরাজ।

বাবা যোগরাজের কড়া নজরে ক্রিকেটশিক্ষা হয়েছিল যুবরাজের। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ভারতের হয়ে একটি টেস্ট ও ছ’টি এক দিনের ম্যাচ খেলা যোগরাজ নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা ছেলের মধ্য দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিলেন। তাই পুত্রের উপর ‘অত্যাচার’ করতেও পিছপা হননি। তাঁর ১৫ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে বাবার সঙ্গে থাকতে হত যুবরাজকে। ১৯ বছর বয়সে ভারতের হয়ে খেলার প্রথম পারিশ্রমিক (২১ লাখ টাকা) পেয়ে দ্রুত ১৮ লাখ টাকা দিয়ে মাকে চণ্ডীগড়ে বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন যুবরাজ। তখন থেকে তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন। কিন্তু প্রকাশ্যেই বলেন, বাবা যোগরাজের মতো আর কেউ কথা বলে উজ্জীবিত করতে পারেননি তাঁকে। পারেন না।

ক্রিকেটের বাইরের শিক্ষার কথা শুনিয়েছেন ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়, “অ্যাকাডেমিতে তো ৪০০-৪৫০ ছেলে আসে। তাদের মধ্যে আসল প্রতিভা চেনাটাই কঠিন। যুবরাজ সেটা পেরেছে। তার পর অভিষেকদের নিয়ে খেটেছে। যুবরাজ যখন ওদের পেয়েছে, তখন দু’জনের ভিত তৈরি ছিল। সেটা আরও মজবুত করেছে যুবরাজ। ঘষেমেজে ধার বাড়িয়েছে।” শরদিন্দুর আরও পর্যবেক্ষণ, “অভিষেকদের মানসিকতাই বদলে দিয়েছে যুবরাজ। ওদের হাঁটাচলা, কথা বলা, খেলার ধরন— সবেতেই যুবরাজের ছাপ। এটাই যুবির কৃতিত্ব। ক্রিকেটের বাইরের শিক্ষাটাও দেওয়া।”

শুভমন গিলের (ডান দিকে) সঙ্গে যুবরাজ সিংহ। ছবি: সমাজমাধ্যম।

পঞ্জাবের আরও দুই ক্রিকেটার প্রিয়াংশ আর্য এবং প্রভসিমরন সিংহকে আপাতত গড়ছেন ‘দ্রোণাচার্য’। গত আইপিএলে পঞ্জাব কিংসের ওপেনিং জুটি। যুবরাজের প্রশিক্ষণে তাঁরাও ভারতীয় দলে কড়া নাড়বেন অচিরেই। তা হলে কি অভিষেক-শুভমনকে নিয়ে তাঁর কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে? নাহ, দুবাই থেকে ইনস্টাগ্রামে খুশিয়াল ছবি পোস্ট করেছিলেন অভিষেক। কালক্ষেপ না করে ‘গুরু’ লিখেছেন, ‘আমি কিন্তু তোমার উপর নজর রাখছি’।

অর্থাৎ, আবার যেন ফোন কেড়ে নিয়ে ঘরে তালাবন্ধ না-রাখতে হয়। ছয় ছক্কার ব্যাট এখনও মনে মনে বহন করেন যুবরাজ সিংহ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement