টেস্ট অভিষেকের টুপি পরে অংশুল কম্বোজ। ছবি: সমাজমাধ্যম।
অংশুল কম্বোজের গ্রাম ফাজিলপুর থেকে নীরজ চোপড়ার গ্রাম পানীপতের দূরত্ব মেরেকেটে ৬০ কিলোমিটার। একজন ক্রিকেটার, অপর জন অলিম্পিক্সে সোনাজয়ী জ্যাভলিন খেলোয়াড়। তবে দু’জনের যাত্রার শুরুটা একই রকম। নীরজের কাকা ভীম চোপড়া তাঁকে খেলাধুলোর মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন ওজন কমাতে। অংশুলের বাবা উধম সিংহও একই উদ্দেশ্য নিয়ে ছেলেকে ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিলেন।
নীরজ কালক্রমে ভারতের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। অলিম্পিক্সে সোনা এবং রুপো, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া, ৯০ মিটার পেরোনো— কিছুই বাদ নেই। সেখানে কম্বোজকে অনেক রাস্তা পেরোতে হয়েছে দেশের হয়ে টেস্ট খেলার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য।
বুধবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চতুর্থ টেস্টে অভিষেক হল কম্বোজের। অথচ টেস্ট দলে তিনি ছিলেনই না। ভারত ‘এ’ দলে রাখা হয়েছিল ইংল্যান্ড লায়ন্সের বিরুদ্ধে খেলার জন্য। খেলে দেশেও ফিরে গিয়েছিলেন কম্বোজ। তবে আকাশদীপ, অর্শদীপ সিংহ চোট পাওয়ায় ভারতের হাতে পেসার কম পড়ে যায়। তবে টেস্ট খেলা হর্ষিত রানা, মুকেশ কুমারের বদলে গৌতম গম্ভীর, অজিত আগরকরেরা ডেকে নেন কম্বোজকে।
২০০০-এর ৬ ডিসেম্বর জন্ম কম্বোজের। অনিল কুম্বলের মতো তাঁরও অভিষেক হল ম্যাঞ্চেস্টারে। ঘটনাচক্রে, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দু’জনেরই ইনিংসে ১০ উইকেট রয়েছে। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয় হরিয়ানার ছেলে কম্বোজের। গত বছর তৃতীয় বোলার হিসাবে ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার নজির গড়েন। বাংলার প্রেমাংশু চট্টোপাধ্যায় এবং রাজস্থানের প্রদীপ সুন্দরমের পর। এখনও পর্যন্ত ২৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৭৯টি উইকেট নিয়েছেন।
গত মরসুমের বিজয় হজারে ট্রফিতে ১০টি ম্যাচে ১৭ উইকেট নেন কম্বোজ। প্রথম বার ট্রফি জেতে হরিয়ানা। গত বছরই আইপিএলে অভিষেক। মুম্বইয়ের হয়ে তিনটি ম্যাচ খেলেন। এ বার ৩.৪ কোটি টাকায় তাঁকে কিনেছিল চেন্নাই। ১১টি ম্যাচ খেলে ১০ উইকেট নিয়েছেন কম্বোজ।
গত এক দশকে অনেক বার মৃগীতে আক্রান্ত হয়েছেন কম্বোজের বাবা উধম। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ছেলের বল করা দেখার জন্য তর সইছে না তাঁর। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র ওয়েবসাইটে তিনি বলেছেন, “ওর ওজন কমানোর জন্য ক্রিকেট খেলাতে শুরু করেছিলাম। সতীশ রানাকে (কম্বোজের ছোটবেলার কোচ) আলাদা করে বলেছিলাম বল করাতে। ওর ওজন বেশি ছিল। সেটা ঠিক করতে চেয়েছিলাম। কোনও দিন ভাবিনি এক দিন ভারতের হয়ে খেলতে নামবে। যে দিন ওকে অ্যাকাডেমিতে নিয়ে গিয়েছিলাম সে দিন থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আসক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেটাই ওর জীবন হয়ে দাঁড়াল।”
তৃতীয় বর্ষে পড়েন কম্বোজের ভাই সান্যম। দাদা ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে দেখাও করতে পারেননি। তিনি জানালেন, টেস্ট দলে দাদা সুযোগ পাওয়ায় পরিবারের মেজাজটাই বদলে গিয়েছে। সান্যম বলেছেন, “আমি বাবাকে এত হাসতে কখনও দেখিনি। অসুখের কারণে মুখের হাসিই চলে গিয়েছিল। যে দিন থেকে বোর্ডের ফোনটা এসেছে, বাবার উত্তেজনা কমছে না। দাদাকে ছাড়তে যেতে পারিনি। ও ম্যাঞ্চেস্টারে রওনা দেওয়ার দিন মা হাসপাতালে ভর্তি। কিডনিতে পাথর রয়েছে। আমার খারাপ লেগেছিল। ও ফিরলে জমিয়ে মজা করব।”
ভারত ‘এ’ দলের হয়ে কিছু দিন আগেই ইংল্যান্ডে খেলে গিয়েছেন কম্বোজ। দলের হর্ষিত রানাকে রেখে দেওয়া হলেও কম্বোজকে ফেরত পাঠানো হয়। পর দিন সকাল থেকেই বোলিং শুরু করে দেন। ইংল্যান্ড থেকে ডিউক বল সঙ্গে করে এনেছিলেন। একটি স্টাম্প লক্ষ্য করে বল করা অনুশীলন করেছেন।
কোচ সতীশ ভেবেছিলেন, সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন কম্বোজ। তাঁর কথায়, “ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘সব ঠিক আছে’? বলেছিল, ‘স্যর, আমি আশাবাদী’। আজ দেখুন। কঠোর পরিশ্রম, দায়বদ্ধতা এবং শৃঙ্খলার আদর্শ উদাহরণ কম্বোজ।” তাঁর সংযোজন, “ইনিংসে ১০ উইকেট ওর জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। অনেক রাস্তা খুলে গিয়েছে ওর জন্য।”
২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ঠিক আগে চোট পেয়ে প্রতিযোগিতায় খেলতে পারেননি কম্বোজ। সেই সময় বাবা দাঁড়িয়েছিলেন পাশে। সতীশের কথায়, “তখন প্রথম বার ওর চোখে জল দেখেছিলাম। ক্রিকেটই ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। উধম সিংহজিই ওকে ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যেতে বলেন। উনি জানতেন ছেলের প্রতিভা। বলেছিলেন, ‘লেংথে বল করে যা’।”
সেটাই করেছেন কম্বোজ। চেন্নাইয়ে থাকার সময় তাঁর লেংথে মজেছিলেন কোচ স্টিফেন ফ্লেমিং, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও। ফ্লেমিং বলেছিলেন, “ওর বল পিছলে আসে। স্পিড গানে যা দেখা যায়, তার থেকেও জোরে বল করে। লেংথটাই ওর শক্তি।” ধোনি বলেছিলেন, “কম্বোজ সুইং পায় না। কিন্তু সিমের নড়াচড়া খুবই ভাল। বল গ্লাভসে আসার সময় যথেষ্ট জোর থাকে।”
প্রশংসা করেছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিনও। বলেছেন, “অংশুল পরিকল্পনাটা ভাল বুঝতে পারে। আমি অনেক জোরে বোলারকে দেখেছি যাদের পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞাসা করলে বলত খেলাটাকে উপভোগ করতে চায়। অংশুল পরিকল্পনা বুঝে মাঠে সেটা কাজে লাগায়। সবার এই প্রতিভা থাকে না।”
গত দুই মরসুমে হরিয়ানার কোচ থাকা অমরজিৎ কেপি বলেছেন, “ওর বুদ্ধি দারুণ। কম কথা বলে। তবে জানে ওকে কী করতে হবে। ওর বোলিং অ্যাকশন খুব সাধারণ। লম্বা স্পেল করতেও ভয় পায় না। ইংল্যান্ডে ও ভারতের সম্পদ হতে চলেছে।”