বাজিরাও মহেন্দ্র আজ করব লড়ব জিতব রে-র বিরুদ্ধে মর্যাদার রণে

কলকাতার যদি দিকচিহ্ন হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা হাওড়া ব্রিজ। পুণে-র তা হলে দু’শো ছিয়াশি বছরের পুরনো কেল্লা। চোদ্দো তলার এই দুর্গ ঘিরে একটা ভুতুড়ে সংস্কার আছে যে, প্রতি পূর্ণিমার রাতে এখানে নাকি ভেতর থেকে এক কিশোরের আর্ত চিৎকার ভেসে আসে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

পুণে শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:২৭
Share:

শনিওয়ারওয়ারা!

Advertisement

কলকাতার যদি দিকচিহ্ন হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা হাওড়া ব্রিজ। পুণে-র তা হলে দু’শো ছিয়াশি বছরের পুরনো কেল্লা। চোদ্দো তলার এই দুর্গ ঘিরে একটা ভুতুড়ে সংস্কার আছে যে, প্রতি পূর্ণিমার রাতে এখানে নাকি ভেতর থেকে এক কিশোরের আর্ত চিৎকার ভেসে আসে। তার ঐতিহাসিক সত্যতা এটুকু যে, নারায়ণ রাও নামক মরাঠা রাজের ভাইপো এখানে গুপ্ত ঘাতকের হাতে প্রাণ দেয়। মারা যাওয়ার সময় সে নাকি বলেছিল, কাকা মালা ভাচওয়া। কাকু আমাকে বাঁচাও।

ভারতের অন্যতম গা ছমছমে কেল্লায় শনিবার ভরদুপুরে ঢুকতে গিয়ে মনে হল, সমকালীন ভারতবর্ষ মোটেও গুপ্তঘাতকের জন্য শনিওয়ারওয়ারাকে মনে রাখেনি! মনে রেখেছে কেল্লা স্থাপনকারী পেশোয়া বাজিরাওয়ের জন্য। সেলুলয়েডে যাঁকে অমর করে দিয়েছেন সঞ্জয় লীলা বনশালী।

Advertisement

তাঁর অধিষ্ঠান নিয়েও জাতীয় গণপিপাসা এত বেড়েছে যে, গত মাসে পুণে সুপারজায়ান্টস টিম প্রোমোশনাল গান শ্যুট করে এই কেল্লার মোড়ে দাঁড়িয়ে। মিকা গেয়েছেন সেই গান দম কা নয়া রং— যা সঞ্জীব গোয়েন্কার টিমের থিম সং। ধোনি থেকে অশ্বিন সবাই ছিলেন শ্যুটে। যা দেখার জন্য হাজার দশেক মানুষের ভিড় জমে যায়। পুণে ক্রিকেটের শহর। সচিনের ওপর তৈরি জাদুঘরের শহর। কিন্তু আপাতত তার পেশোয়া হলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।

রোববার রাত্তিরের রণ পেশোয়া বাজিরাও মহেন্দ্র-র জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ। পুণে টিমটাকে নিলাম পরবর্তী বলা হচ্ছিল, সিএসকে-২। টুর্নামেন্ট যত এগোচ্ছে তত তাদের আর একটা পরিচিতি বড় হচ্ছে— কলকাতা-২। তাঁর মালিক যে কলকাতার এত বছরের প্রতিষ্ঠিত অধিবাসী-সঞ্জীব গোয়েন্কা। সঞ্জীব বলছিলেন আইপিএলে তাঁদের প্রথম ম্যাচ খেলতে যখন পুণে টিম মুম্বইয়ের হোটেল থেকে বার হচ্ছিল, হোটেলের বাঙালি কর্মচারীরা এসে তাঁকে ক্রমাগত বলতে থাকে, এটাও কলকাতার টিম। আর তাই আমরা ফুল সাপোর্ট করছি।

কেকেআর যতই মুম্বইকরদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাক না কেন, তাঁরা এই কলকাতা বিভাজনে অবশ্যই বিশ্বাসী নন। এঁদের কাছে কেকেআরই আদি এবং অকৃত্রিম কলকাতা। কলকাতা-২ বলে কিছু নেই। আইপিএলে শহরের নাম ব্যবহারের অধিকারের সার্বভৌমত্ব নিয়ে এ হেন গোপন টেনশন কি সত্যি আছে? মনে হয় আছে আর সেটাই রোববারের ম্যাচকে বাড়তি আঙ্গিক জোগাচ্ছে।

তবে শুধু কি একটা আঙ্গিক নাকি? এক দিকে অধিনায়ক ধোনি। এক দিকে গম্ভীর। ভারতীয় ক্রিকেটের করোটি গুহার নোংরা প্রবাদ বিশ্বাস করলে দু’জনের সম্পর্ক মস্তানি আর বাজিরাও-পত্নী কাশীবাঈয়ের চেয়ে সামান্য ভাল। গম্ভীর শিবির বিশ্বাস করে, ভারত অধিনায়ক তিনি হয়েই গিয়েছিলেন চেন্নাইয়ের নির্বাচনী বৈঠকে। কিন্তু শ্রীনির প্রভাবে সেটা আটকে যায়। মোহিন্দর অমরনাথের সামনে রুল বই ছুড়ে সেই বদল আটকে দেন শ্রীনি। এর কিছু দিন বাদে দেখা যায় ভারতীয় দল থেকে ছাঁটাই গম্ভীর। এ বারের আইপিএলকে টিম ইন্ডিয়ায় প্রত্যাবর্তনের পাকদণ্ডী করে এগোচ্ছেন গম্ভীর। পারথে জাস্টিন ল্যাঙ্গারের কাছে কোচিং নিয়ে আসার পর তাঁর ফুটওয়ার্ক এখন অনেক ভাল। পুল মারার সময় অতীতে শরীর সরছিল না। এখন গোটা বডি অনেক স্বচ্ছন্দে ঘুরছে। চারটে ম্যাচের তিনটেতে হারা প্রবল পরাক্রান্ত টি-টোয়েন্টি ক্যাপ্টেনকে এ বার তিনি বিপক্ষে পাচ্ছেন। তাঁর রথের চাকা বসে যাওয়ার সময় ছেড়ে দেবেন কেন? পুণে গম্ভীরের কাছে পয়া মাঠও। চার বছর আগে এখান থেকেই তো প্রথম ফাইনাল গিয়েছিল শাহরুখের টিম!

কেকেআর টিমটাকে বাইরে থেকে খুব গোছানো, সুবিন্যস্ত দেখাচ্ছেও। সুনীল নারিনকে ফিরিয়েই শুধু ঢিলে দেয়নি টিম ম্যানেজমেন্ট। যে বায়োমেকানিস্ট তাঁর প্রত্যাবর্তনের মূলে সেই কার্ল ক্রো-কেও তারা টিমের সঙ্গে রেখে দিয়েছে। শুনলাম ক্রো কলকাতাতেও নারিনের সঙ্গে থাকবেন। পাছে যদি কিছু দরকার হয়। নতুন কোচ জাক কালিসের খুব প্রশংসা শোনা গেল কেকেআর মহলে। কালিস প্লেয়ার হিসেবে গত পাঁচ বছরে যত কথা বলেননি, কোচ হয়ে এই ক’মাসে নাকি তার চেয়ে বেশি বকে ফেলেছেন। সঙ্গে আক্রম তো আছেনই। যাঁর কাছে তাঁদের দেশের মুস্তাফিজুরকে সে দিন নিয়ে গিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের সেরা বোলিং সম্ভাবনাকে আক্রম দেখিয়ে দিয়েছেন ইনসুইং করতে হলে রিস্ট অ্যাকশন আরও কতটা বদলাবে। প্রথাগত কোচিং অনুশীলন করেন না আক্রম। কিন্তু এ সব খুচরো টোটকায় অদ্বিতীয়।

তবে কোচিং স্টাফের চেয়েও বেশি করে কেকেআর টিমের মানসিক ভিটামিন হচ্ছে ওপেনারদের ফর্ম আর ওই নারিন! বিকেলে একটা টুপি আর জ্যাকেটে শরীর জড়িয়ে কেকেআর শিবির থেকে সাময়িক বেরিয়ে গেলেন মণীশ পাণ্ডে। বেঙ্কি মাইসোরকে বললেন নিজের সমস্যার কথা। শুনলাম, তাঁর চিকেন পক্স হয়েছে। মাইসোরকে দেখে অবশ্য মনে হল না বিশেষ ঘাবড়েছেন বলে। টিমের অভ্যন্তরীণ ইনভার্টার এতই শক্তিশালী যে দু’-একটা খুচরো বিপদে ফিউজ উড়ছে না। নারিনের কথা লিখছিলাম। কেকেআরের হয়ে গত পাঁচ বছরে তাঁর পারফরম্যান্স রূপকথা-সদৃশ। ৫৭ ম্যাচে ৭৬ উইকেট। গড় ১৭.৯৩। টেবলের সবচেয়ে ওপরে আছি বলে আমাদের আত্মতুষ্ট হলে চলবে না। এক নম্বর র‌্যাঙ্কিং ধাঁ করে নেমে যেতে পারে টিমের মধ্যে এ সব সতর্ক আলোচনায় এক টুকরো ফুর্তিও বেরিয়ে এল। নারিন নাকি তাঁর অস্ত্রাগারে এ বার আরও একটা নাকল বল নিয়ে ফিরেছেন যা গুগলির মতো। অফ থেকে লেগে যায়। যেটা সবচেয়ে দামি হবে মে মাসের স্পিনিং ইডেন ট্র্যাকে।

একটা সময় আইপিএলে কেকেআর সামান্য সিঁটকে থাকত দু’টো টিমের কাছে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স আর সিএসকে। এমআই রোগটা পুরোপুরি না সারলেও ক্রমে কমল। সিএসকেটা থেকেই যায় যে, আর কাউকে না পারি এদের হারাতেই হবে। পাকেচক্রে আজ পারস্পরিক শক্তির ভাবমূর্তিতে নতুন সিএসকে যেন কেকেআর। আর পুণে পুরনো কেকেআর। বা কারও কারও কাছে পুরনো পুণে ওয়ারিয়র্স।

কে জানত, পেশোয়া বাজিরাওয়ের মতোই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অমিতযুদ্ধজয়ী মহেন্দ্র সিং ধোনির এমন করুণ অবস্থা হবে! এই যে ধারণা ধোনি যেখানে, সীমিত ওভারে সাফল্য সেখানে, সেটাই তো চুরচুর হয়ে যাচ্ছে। শিবাজি নগরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ম্যারিয়ট হোটেলে তাঁর ঘর যত দূর শুনলাম দশ না এগারো তলায়। ১৩০২ নয়। যে ঘরটা কলকাতার কোনও কোনও সাংবাদিকের কাছে নস্ট্যালজিক। ওটাই যে পুণে ওয়ারিয়র্স ক্যাপ্টেনের আস্তানা ছিল। আইপিএলে তাঁর শেষ মরসুমে ওই ঘরটারই অধিবাসী ছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। পুণের এক হোটেল তাঁদের এই ফর্ম্যাটে অন্তত এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিক অবশ্যই চাইবেন না ধোনি।

কিন্তু এই লজঝড়ে বোলিং অ্যাটাক নিয়ে করবেনই বা কী! আরপি সিংহ, ইশান্ত শর্মা আর ইরফান পাঠান। কাকে ছেড়ে কাকে লুকোবেন? একই সঙ্গে তাঁর ক্যাপ্টেন্সি নিয়েও যে একাধিক গুঞ্জন উঠছে। কাল ওই রকম রান তাড়ার সময় তিনি ৩৮ বলে ৪১ রানের ইনিংস খেলবেন কেন? কেন রবি অশ্বিনকে আবার পুরো কোটা শেষ করাবেন না?

বলছিলাম না, দূরত্বে শনিওয়ারওয়ারা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরবর্তী হোটেলে থাকলেও টানা তিন ম্যাচ হারা ধোনিকে যেন আঠারোশো শতাব্দীর কেল্লারই অধীপতি মনে হচ্ছে। বাজিরাওয়ের মতো কোনও মস্তানি প্রেমে অন্ধ হয়ে তাঁকে হিন্দু কুলপুরোহিতদের বিরোধ সামলাতে হচ্ছে না। কিন্তু আর দু’-একটা ম্যাচ হারলে তো প্রশ্নের গণজোয়ার বাড়বেই— তা হলে তুমি কীসের এত বড় ক্যাপ্টেন?

পুণে স্টেডিয়ামে রোববার রাত্তিরে মোটেও চল্লিশ ওভারের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট হচ্ছে না।

হচ্ছে কেল্লা আর রাজ্যপাট নিয়ে এক অমানুষিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন