ইউসরা মারদিনি
মাঝ সমুদ্রে ভিড়ের চাপে নৌকা তখন প্রায় ডুবতে বসেছে। প্রাণ বাঁচাতে কিশোরীটিকে হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল ভূমধ্যসাগরে। কনকনে ঠান্ডায় প্রায় তিন ঘণ্টা সাঁতার কাটার পর মনে হয়েছিল, এ বার বোধহয় জমেই যেতে হবে! চোখ বুজে আসছিল ক্লান্তিতে। হাত-পা অসাড়। সীমানাহীন সমুদ্রে তখন শুধুই মৃত্যুর কথা মনে পড়ছিল ইউসরা মারদিনির।
সিরিয়ার কিশোরী ইউসরার ঠিকানা এখন জার্মানি। অলিম্পিক্স রিফিউজি দলের সদস্য তিনি। ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে ‘অলিম্পিক্স রিফিউজি’ দলের হয়ে প্রথম যখন প্রতিযোগিতায় নামবেন, তখন ভূমধ্যসাগরের সেই দিনের কথা নিশ্চিত মনে পড়বে তাঁর! জীবনের ওই লড়াই-ই তো আজ তাঁকে গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের মঞ্চে দাঁড় করিয়েছে। আবার তিনি সাঁতার কাটবেন। তবে ফারাক একটাই, সেখানে মৃত্যু ভয় থাকবে না। থাকবে জয়ের অদম্য সাহস। ‘‘যখন আমি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তখন খুব ভয় করেছিল। জানতাম না, আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে!’’ স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে কেঁপে ওঠে ইউসরার গলা। বলছিলেন, ‘‘নৌকায় ওঠার আগে থেকেই শুনছিলাম, মৃত্যুই ভবিতব্য। মরার ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত ছিলাম আমরা!’’ পরে সেই মৃত্যুর সঙ্গেই পাঞ্জা লড়তে হয়। তাঁর কথায়, ‘‘যখন সাঁতার কাটছিলাম, তখনও জানতাম না কী হবে। সামনে কী আছে! এখনকার জীবনের কথা তো স্বপ্নেও ভাবিনি।’’
সিরিয়া থেকে শরণার্থীর দল তখন আশ্রয়ের খোঁজে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। সেই তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলতে হয়েছিল সিরিয়ার দামাস্কাসে বসবাস করা ইউসরার পরিবারকেও। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ছেড়ে অন্য দেশে মাথা গোঁজার মতো একটা ঠাঁই পেতে সমুদ্রে ভেসে পড়া। কিন্তু, নৌকার ইঞ্জিন যে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবে কেউ ভাবেনি। নৌকার ভার কমাতে সকলে তখন ব্যাগ, জিনিসপত্র, জামাকাপড় সমুদ্রে ছুড়ে ফেলতে শুরু করেছেন। কিন্তু, তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। অবশেষে জলে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না ওঁদের হাতে। সেই দলে ছিলেন ইউসরা এবং তাঁর বোনও। নিজেকে বিপন্ন করে সে দিন ওই কিশোরী শুধু নিজের জীবন বাঁচাননি, রক্ষা করেছিলেন আরও ১৯ জন শরণার্থীর জীবনও।
সে দিনের সেই ঘটনার পর কী ভাবে গ্রিসের সেই দ্বীপটায় পৌঁছেছিলেন আর মনে নেই। তবে, মধ্যরাতে মাটি খুঁজে পেয়েছিলেন। চোখে নোনা জল ঢুকে দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারানোর দশা হয়েছিল। তার পর হঠাৎ করেই বদলে গেল দিন। এখন সামনে শুধুই অলিম্পিক্স। ইউসরা বলছিলেন, ‘‘আমরা এখন নিজেদের তৈরি করছি। অনুশীলন করছি নিয়মিত। বাবা-মা যে ভাবে আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে আমি চাই জিতে তাঁদের গর্বিত করতে।’’ তিনটে স্বপ্ন বুকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন ইউসরা। প্রথমত, ভুলতে চান সেই সব দিন। দ্বিতীয়ত, দেখতে চান দেশে সিরিয়ার বুকে ফিরেছে শান্তি। আর? তৃতীয় ইচ্ছেটা একান্তই ব্যক্তিগত। অলিম্পিক্স থেকে পদক জিততে চান তিনি। তবে, সেই দিনটা এখনও ফিরে ফিরে আসে ইউসরার কথায়। ‘‘প্রথম যখন জলে ঝাঁপ দেই তখন সারা শরীর কাঁপছিল। ঠিক যে ভাবে প্রতিযোগিতায় নামার সময় হয়। সে দিন অনুভব করেছিলাম আমার একার জীবন তুচ্ছ! ওই বোটে যাঁরা ছিলেন, সকলেই আমার অংশ। তখন মনে হয়েছিল জলে ঝাঁপিয়ে পড়াটা আমার কর্তব্য না হলে যে সবাই ডুবে যাবে। যাঁরা সাঁতার জানত জলে নেমে পড়ে। সে দিন এটা না করলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না সারা জীবন।’’
ইউসরার কাহিনি এক আলোর কথা বলে। কিন্তু, অন্ধকারের কথাও মনে পড়িয়ে দেয়। বছরখানেক আগে যেমন ইউসরার পরিবার অনির্দিষ্ট এক জীবনের খোঁজে ভেসে পড়েছিল, তেমনই এক টুকরো আশ্রয়ের খোঁজে দেশান্তরে পাড়ি দিয়েছিল আয়লান কুর্দির পরিবার। ইউসরাদের মতো একই ভাবে ডুবে গিয়েছিল তাদের নৌকাও। তিন বছরের ছোট্ট আয়লান বাবা-মার হাত ছুটে ভাসতে ভাসতে চলে গিয়েছিল তুরস্কের এক সমুদ্র সৈকতে। সেখানেই বালির চরে পড়েছিল ছোট্ট শিশুটির দেহ। গোটা বিশ্ব শিউরে উঠেছিল সেই ছবি দেখে। এ রকম কত আইলানই তো হারিয়ে গিয়েছে ভূমধ্যসাগরের জলে। কিছু জানা গিয়েছে কিছু থেকে গিয়েছে অন্ধকারে। সে রকমই এক অন্ধকার অতীতকে পিছনে ফেলে আলোর সামনে দাঁড়িয়ে ইউসরা। অলিম্পিক্সে যাই হোক না কেন, জীবন যুদ্ধে জয়ীর পদক তো তিনি সে দিনই জয় করে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: হাত ফস্কে সমুদ্রে পড়ে গেল বাচ্চা দু’টো! হাহাকার বাবার