উন্মাদনা, উত্তাপে মনে হচ্ছে আজ বুঝি ফাইনালেই খেলছে ব্রাজিল

রডরিগো ভিস্তা এমন এক পুরুষ যাঁকে স্বচ্ছন্দে যে কোনও ব্রাজিলীয় তরুণী বাড়ি নিয়ে বলতে পারে— মা ওকে বাছলাম! হলিউড তারকাদের মতো ঝকঝকে। লম্বা-চওড়া চেহারা। সব সময় মুখে হাসি লেগে রয়েছে। ব্রাজিল আসার পর থেকে স্কোলারির সব ক’টা সাংবাদিক সম্মেলনে দেখছি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন রডরিগো। এমনকী ভারতীয় সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়েও হাসেন-টাসেন, যা ফুটবলের প্রথম বিশ্বে খুব রোজকার ঘটনা নয়।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

বেলো হরাইজন্তে শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৪ ০৩:১৯
Share:

সাঞ্চেজ, ভিদালদের পোস্টার নিয়ে শুক্রবারই বেলো হরাইজন্তের রাস্তায় হাজির চিলির সমর্থকেরা। ছবি: এএফপি।

রডরিগো ভিস্তা এমন এক পুরুষ যাঁকে স্বচ্ছন্দে যে কোনও ব্রাজিলীয় তরুণী বাড়ি নিয়ে বলতে পারে— মা ওকে বাছলাম!

Advertisement

হলিউড তারকাদের মতো ঝকঝকে। লম্বা-চওড়া চেহারা। সব সময় মুখে হাসি লেগে রয়েছে। ব্রাজিল আসার পর থেকে স্কোলারির সব ক’টা সাংবাদিক সম্মেলনে দেখছি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন রডরিগো। এমনকী ভারতীয় সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়েও হাসেন-টাসেন, যা ফুটবলের প্রথম বিশ্বে খুব রোজকার ঘটনা নয়।

পরিচয় দেওয়া যাক— রডরিগো অনেক বছর ধরে ব্রাজিল ফুটবল টিমের মিডিয়া ম্যানেজার। হাসি ছাড়া সাংবাদিক সম্মেলনে যাঁর কোনও ভূমিকাই থাকে না, তাঁকে শুক্রবার যেমন তেলেবেগুনে গর্জে উঠতে দেখলাম, গ্রুপ লিগ থেকে সিআর সেভেনের বিদায়ের মতোই সেটা চমকপ্রদ! প্রশ্নটা করা হয়েছিল লুই ফিলিপ স্কোলারিকে, যিনি সাংবাদিক সম্মেলনেও একটা অলিখিত গুরুকুল চালান। এই কী বললে, তুমি বোসো... তোমার উত্তরটা আগে দিই, এ রকম। স্কোলারির পাশে আজ ক্যাপ্টেন থিয়াগো সিলভা।

Advertisement

কিন্তু টেবল থেকে মাইক তুলে নিয়ে রডরিগোর গর্জনের সময় দেখলাম তাঁরাও নির্বাক হয়ে গেলেন।

“হেই, চিলির সাংবাদিক, কী ভেবেছেনটা কী! যা খুশি তাই বলবেন! ফিফার অমর্যাদা করবেন! ব্রাজিলীয় ফুটবলের অমর্যাদা করবেন? এত বড় কথা মুখে আনছেন যে, কালকের ম্যাচে ইংরেজ রেফারি আমাদের টেনে খেলাবেন কি না?”

এর আগে মোটামুটি স্কোলারিকে যা জিজ্ঞেস করার, অধিনায়কের যা উত্তর দেওয়ার, সব ঘটেই গিয়েছে। সাংবাদিকদের এক রকম নোটবুক গোছানোর পালা। সেই সময় ইঞ্জুরি টাইমে যে এমন গোলমুখী আক্রমণ হবে, কে জানত! কে-ই বা জানত, তার এত রুষ্ট প্রত্যুত্তর আসবে ব্রাজিল শিবির থেকে!

হোটেল ব্যাঙ্কোয়েটের মতো একটা অত বড় ঘরে হঠাৎ করে এতটাই নীরবতা, যেন পিন পড়লে শোনা যায়। আর রডরিগোকে থামানোই যাচ্ছে না। “ব্রাজিলের ফুটবল ঐতিহ্যের কোনও খবর রাখেন যে এত বড় কথা বললেন! আমাদের একশো বছরের ফুটবল ইতিহাসটা কোনও দিন নেড়েচেড়ে দেখেছেন? দেখলে বুঝতেন কাপ জিততে রেফারি লাগে না ব্রাজিলের।”

উত্তেজনা সিরিজ রডরিগো থেকে শুরু হল, মনে করার কোনও কারণ নেই। ওটা হয়ে গিয়েছে সকাল-সকাল চিলি অনুশীলনে এক হেলিকপ্টারের আচমকা উপস্থিতিতে। চিলি এমনিতে নিজেদের প্র্যাক্টিসে আর সব দলের মতোই বিশ্ব মিডিয়াকে সকালে পনেরো মিনিট সময় দিয়েছিল। তাতে কিছু দেখানোর কথা নয়। ওটা বাচ্চাদের লেবেঞ্চুস খাওয়ানো। গোপন ট্যাকটিক্সের ট্রেনিং তো গোপন ভাবেই হওয়ার কথা। মিডিয়াও তাই আরও একটা কনডাক্টেড ট্যুরের পর বেরিয়ে আসে। এর পর সাম্পাওলি যখন তাঁর ছেলেদের নিয়ে আসল স্ট্র্যাটেজি ফর্মেশন করে দেখাচ্ছেন, হঠাৎই উদয় হয় সেই হেলিকপ্টার।

প্রচণ্ড চটে গিয়ে চিলি ফুটবলাররা শূন্যে ধাঁই-ধাঁই শট মেরে হেলিকপ্টারে লাগানোর চেষ্টা করেন। টিমের এক ডিফেন্ডার বিকেলেও গজগজ করেছেন, এত চেষ্টা করেও হেলিকপ্টারে মারতে পারলাম না। বার্সায় নেইমারের সহ-খেলোয়াড় তারকা ফরোয়ার্ড সাঞ্চেজ উত্তেজিত ভাবে বলেছেন, “এ সবে লাভ নেই। সংগঠকদের নিজের মাঠে হারিয়ে ইতিহাস গড়ব কাল।”

চিলি টিমকে লা রোখা নামেও ডাকা হয় আন্তর্জাতিক ফুটবল সার্কিটে।

তারা পরিষ্কার বলছে, এই হেলিকপ্টার গুপ্তচরবৃত্তির জন্য পাঠিয়েছিল ব্রাজিল টিম। ধরা পড়ে যাওয়ায় সুড়সুড় করে পালিয়েছে। পরে জানা গেল হেলিকপ্টারটি ব্রাজিলের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ও গ্লোবোর। তারা দাবি করেছে, রুদ্ধ অনুশীলনের ছবি তুলতে গিয়েছিল। কিন্তু উত্তাপের এমনই আঁচ যে, শেষমেশ ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছে।

ক্রিকেটে সেই আজহারের আমল থেকে সুন্দরী মহিলাদের টোপ হিসেবে ব্যবহারের চল আছে। আইসিসির মতে, আজও সেটা হয়ে থাকে। কিন্তু সেখানে খবর পাচার করা হয় বুকিদের, বিপক্ষ দলকে নয়। অতীতের এক বিশ্বকাপে জার্মানদের বিরুদ্ধেও হেলিকপ্টার পাঠানোর অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু সে অনেক পরের দিকের ম্যাচে। দ্বিতীয় রাউন্ডে গুপ্তচরগিরি, রেফারিং নিয়ে প্রকাশ্য এমন অনাস্থা, ব্রাজিলের মতো সুপারপাওয়ার দলের উদ্দেশে এমন গর্জন— কখনও হয়নি।

বেম ভিন্দো আও মুন্দো দে নাকআওতেস।— নকআউটের দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগত!

কিন্তু বেলোয় বসে এ সব দেখে-টেখে মাঝেমধ্যে গুলিয়ে যাচ্ছে, সবে দ্বিতীয় রাউন্ড? নাকি কাপ ফাইনাল? ব্রাজিলে ধর্মান্ধতা এমন চরমে পৌঁছেছে যে, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররাই বুঝে পাচ্ছেন না এমন মহাজাগতিক প্রত্যাশার সঙ্গে কী করে তাল রাখবেন! বেলো ম্যাচের টিকিট পাওয়া আর মন্টেভিডিওয় সুয়ারেজের ইন্টারভিউ জোগাড় করা মোটামুটি সমপর্যায়ে চলে গিয়েছে। এই শহরের বাসিন্দা এক ব্রাজিলীয় তো ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট দিয়েছেন, ‘টিকিট দাও। আমার অ্যাপার্টমেন্ট নাও!’

এমনিতে বেলোয় ড্রাইভাররা যে ভাবে গাড়ি চালায়, তাতে কসবা-রথতলা মিনি, বেহালা চৌরাস্তা-সখেরবাজার অটো, দমদম-নাগেরবাজার অটোর অভিজ্ঞতা না থাকলে যে কোনও সময় অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি সার্জনের কাছে যেতে হতে পারে। লেন আছে, কিন্তু সেটা মানার জন্য নয়। এক ড্রাইভার বলল, প্রবলেমটা কী জানেন? সবাই মদ খেয়ে গাড়ি চালায়, আর পুলিশ দেখেও না।

বেলো হাইওয়েতে ড্রাইভারদের বন্য গতি কিন্তু কাল স্কোলারির ব্রাজিল তাঁর ফরোয়ার্ডদের মধ্যে দেখতে চাইবেন। স্কোলারি যাকে বলেন, ঘণ্টায় একশো মাইল গতিতে শুরু করা। ধরে নেওয়া যায় পওলিনহো কাল বসছেন এবং ফার্নান্দিনহো অন্তত শুরু করবেন। নেইমারকে উগ্র আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত করার চেষ্টা হবে এবং তাতে তাঁর মাথা গরম করলে চলবে না, কারণ একটা হলুদ কার্ড খাওয়া আছে!

বিশ্বকাপে টিম হিসেবে ব্রাজিলের পাশে চিলি হল মোহনবাগান বনাম পুরনো সময়ের ভ্রাতৃ সঙ্ঘ। ভ্রাতৃ দারুণ খেলবে। আনন্দবাজারের খেলার পাতায় মুখরিত হবে সেই লড়াই। কিন্তু ম্যাচটা জিতবে মোহনবাগান।

কাগজেকলমে এমনই হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না। ব্রাজিল কোথাও মনে করছে আলজিরিয়া, সুইৎজারল্যান্ড, আমেরিকা যে কেউ হলে চলত। এই শক্ত গাঁটটা এখন না পড়লেই চলছিল না! আর যদি বেলো ড্রাইভারদের মতো গতি চিলি তোলে, তা হলে তো ব্রাজিল জুড়ে মনে হয় শুধুই অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি অপারেশন হবে।

কোথাও একটা মনে হচ্ছে স্কোলারির চাপের আরও বেশি কারণ ব্রাজিলীয় দর্শনবিরোধী খেলায় টিমকে তৈরি করা। পুরনো ব্রাজিল যে ভাবে খেলত, চিলি অনেকটা সে ভাবে খেলে। আর ব্রাজিল কিনা সেই চ্যালেঞ্জ আটকাতে বাহার বিসর্জন দিচ্ছে। ফুটবল খেলে ফুল ফোটাতে পারলে ভাল। রংমশাল জ্বালিয়ে দিলে আরওই ভাল। কিন্তু সেটা স্কোলারির অগ্রাধিকার নয়। তিনি চান প্রথমে জিততে। তার পর সম্ভব হলে সৌন্দর্য দেখাতে।

কুলীন ব্রাজিল ফুটবল-সমাজ এটা মেনে নিতে পারছে না। তাদের ঐতিহাসিক সীমান্ত লঙ্ঘন করে, ফ্ল্যামবয়েন্স ছেড়ে একান্তই ফলের দুনিয়ায় চলে আসাটা ঘটে বিরাশির বিশ্বকাপে। বিরাশির সেই দলকে বলা হয় ব্রাজিলের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক সোনার টিম, যারা দর্শককে আনন্দে বিহ্বল করে দিয়েও কাপ থেকে বঞ্চিত থেকেছে। ব্রাজিল ফুটবলে এটাই হল ক্রসওভার যুগ।

স্কোলারিরা মনে করেন, আধুনিক পৃথিবীতে সাবেকি স্টাইলে খেলাটা ছিল ঐতিহাসিক ভুল। ইতালির কাছে সেই ২-৩ হেরে যাওয়ার কাঁটা সমূলে দেশের মাঠে উপড়ে ফেলতে চান স্কোলারি। এ ভাবেই কনফেডারেশনস কাপ জিতেছেন, ২০০২ বিশ্বকাপও তো এ ভাবেই জেতা। তাই তাঁর এই অব্রাজিলীয় ছক বহাল থেকে যাচ্ছে এই টুর্নামেন্টেও।

আর এই জন্য সিস্টেমের সঙ্গে ব্রাজিল ফুটবল টিমের একটা সংঘর্ষ প্রতিনিয়ত চলছে। যত টুর্নামেন্ট এগোবে, তত বাড়বে। পুরনো দর্শনের চলমান প্রবক্তা বিরাশির কাপজয়ী দলের অধিনায়ককে বিশ্বকাপে দেখার উপায় নেই। ধোনিদের বিশ্বকাপ জেতার মাসখানেকের মধ্যে তাঁর শোকসভায় মুমূর্ষু ছিল গোটা ব্রাজিল।

সক্রেটিস, অসম্ভব বরেণ্য চরিত্র অথচ বিশ্বকাপ মঞ্চে তাঁর নামই উচ্চারিত হতে দেখছি না। সক্রেটিস শুয়ে আছেন সাও পাওলো থেকে প্রায় চার ঘণ্টা মোটর-দূরত্বের রিবেরিও প্রেতো বলে একটা সম্পন্ন শহরে। তাঁর গ্যারিঞ্চার মতো অর্থাভাব ছিল না। মাত্র সাতান্ন বছরে চলে যাওয়ার আগে প্রচুর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েছেন। দু’হাত ভরে কলাম লিখেছেন। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেও লেখার শিরোনাম ছিল, ‘কিছু লোক স্বপ্ন দেখে, কিছু লোক দেখে না’।

নিশানা পেলে। বিজাতীয় স্টাইলের বিপর্যয় হলে স্কোলারি কি ছাড়া পাবেন? কে বলেছে যারা কবরে শুয়ে থাকে তারা কলাম লিখতে পারে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন