পরিদর্শন: হাবড়ার মছলন্দপুরে পুরকর্মীরা। ছবি: সুজিত দুয়ারি
জ্বর-ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে একের পর এক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বহু মানুষ এখনও ডেঙ্গিতে আক্রান্ত। রোজই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গি আক্রান্ত ১০২ জন মানুষ চিকিৎসাধীন ছিলেন। সোমবার রাতেও সংখ্যাটা ছিল ৭০। শহরবাসীর অনেকেই জানান, এত বড় বিপর্যয় তাঁরা অতীতে দেখেননি হাবড়ায়।
দেরিতে হলেও পুরসভা ও প্রশাসনের তরফে মশা মারতে তৎপরতা শুরু করা হয়েছে। তেল স্প্রে করা হচ্ছে। বন-জঙ্গল সাফ হচ্ছে। ও নিকাশি নালাও পরিষ্কার করা হচ্ছে। ডেঙ্গি নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে লাগাতার প্রচার অভিযানও চলছে।
তবে এত কিছুর পরেও শহরের একটা বড় অংশের মানুষ সচেতন হচ্ছেন না। বিশেষ করে প্লাস্টিক ও থার্মোকলের ব্যবহার নিয়ে এখনও হুঁশ ফেরেনি হাবড়াবাসীর। মানুষ সচেতন না হওয়ায় হতাশ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। শুক্রবার হাবড়া পুরসভায় ব্যবসায়ীদের বৈঠক করেন পুর প্রশাসক তথা বারাসতের মহকুমাশাসক তাপস বিশ্বাস। প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগে মালপত্র বিক্রি বন্ধ করতে তিনি ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেন। তারপরেও অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। মহকুমাশাসক বলেন, ‘‘বুধবার থেকে পুরসভা ও পুলিশ যৌথ ভাবে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে ধরপাকড় শুরু করছে।’’
হাবড়া শহর এলাকায় এখনও চলছে প্লাস্টিকের ক্যারিবাগের যথেচ্ছ ব্যবহার। বাজার, মুদি দোকান, মিষ্টির দোকান, বিরিয়ানির দোকান সর্বত্র চলছে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের ব্যবহার। পুর কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের কর্তারা মনে করেন, হাবড়ায় জ্বর-ডেঙ্গি ছড়ানোর পিছনে প্লাস্টিক-থার্মোকলের যথেচ্ছ ব্যবহার একটা বড় কারণ।
দেখা গেল, এলাকায় বেশ কিছু বাড়ির পিছনে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ, থার্মোকল ফেলে রাখা হয়েছে। তাতে জল জমেছে। ডাবের খোল, টায়ার, উঠোনে থাকা তুলসি মঞ্চেও জল জমেছে। বেশ কিছু বাড়ির টিউবওয়েল চত্বরে গর্ত। তাতে জল জমে। ছাদে রাখা টবে জল জমে রয়েছে। ছাদে জল জমে। সাধারণ মানুষ প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ নিকাশি নলার মধ্যে ফেলছেন। বাড়ির আশেপাশে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকে জল জমে ডেঙ্গির মশা বংশবিস্তার করছে বলে প্রশাসনের কর্তাদের মত। শহরের ছোট বড় নিকাশি নালার মধ্যে প্লাস্টিকের ক্যারিবাগের স্তূপ জমে থাকছে। চায়ের ও মিষ্টির মাটির ভাড় বাড়ির আশেপাশে ফেলা রাখা হচ্ছে।
হাবড়া চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের অধীনে ছোট-বড় ৭৮টি ব্যবসায়ী সংগঠন রয়েছে। ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। সংগঠনের সম্পাদক নিরঞ্জন সাহা বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীদের বলা হয়েছে, তাঁরা যেন প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহার না করেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে প্লাস্টিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমরা শুক্রবার থেকে লাগাতার প্রচার অভিযান শুরু করছি।’’
প্লাস্টিকের ব্যবহারের পাশাপাশি বাড়িতে জমা জল সরানো ও ঝোপ জঙ্গল সাফাই নিয়েও একাংশের মানুষ সচেতন নন। জ্বর হলেও অনেকে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করাচ্ছেন না। পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান নীলিমেশ দাস বলেন, ‘‘মঙ্গলবার জয়গাছি এলাকায় যে যুবক মারা গিয়েছেন, তিনি জ্বরে আক্রান্ত হলেও চার দিন পরে তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল।’’
ডেঙ্গি নিয়ে প্রচারে বলা হচ্ছে, জ্বর হলেই সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে রক্ত পরীক্ষা করাতে। তারপরেও মানুষ সচেতন হচ্ছেন না বলে অভিযোগ। মানুষ সচেতন না হলে পুরসভা বা প্রশাসনের পক্ষে ডেঙ্গি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় বলে মত নীলিমেশের।
হাবড়া হাসপাতালের সুপার শঙ্করলাল ঘোষ বলেন, ‘‘জ্বর হওয়ার পরে ওষুধ খেয়ে জ্বর কমে গেলে বহু মানুষ মনে করছেন, সমস্যা মিটে গেল। তাঁরা পর্যাপ্ত জল খাচ্ছেন না। হঠাৎ করে বমি শুরু হচ্ছে, পেট ফুলে যাচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছেন।’’
পুরসভা সূত্রে জানানো হয়েছে, অনেকেই নিজের বাড়ি ও বাড়ির বাইরে আবর্জনা জমিয়ে রাখছেন। বাড়ির মধ্যে কাঁচা নর্দমা ও গর্ত তৈরি করে জল জমিয়ে রাখছেন। তার থেকে ডেঙ্গি মশা জন্মাচ্ছে। পুর কর্তৃপক্ষের দাবি, পুর কর্মীরা বাড়িতে মশা মারার তেল স্প্রে করতে গেলে বা জমা জল পরিষ্কার করতে গেলে একাংশ বাসিন্দারা বাধা দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ।
প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘এখন থেকে ওই সব পরিবারকে পুরসভার তরফে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। চিঠিতে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া চিঠি পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে জমা জল, আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে পুর আইন অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে।’’
বাসিন্দারা জানালেন, ১ নম্বর ওয়ার্ডে একটি গরুর খাটাল আছে। যা ডেঙ্গি মশার আতুঁরঘরে পরিণত হয়েছে। নীলিমেশ বলেন, ‘‘পুর প্রশাসককে বলা হয়েছে ওই খাটালটি দ্রুত বন্ধ করে দিতে।’’ মঙ্গলবার হাবড়ায় বৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে জল জমেছে। আর তাতে আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন শহরবাসী।