Darjeeling Disaster

পাহাড় থেকে ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিপর্যয়ের ক্ষত, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর, নতুন করে বৃষ্টি না নামায় স্বস্তি

প্রাকৃতিক দুর্যোগের আতঙ্ক কাটিয়ে ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে পাহাড়। ডুয়ার্স-সহ সমতলেও কমে গিয়েছে বৃষ্টি। তবে এলাকা জুড়ে এখনও ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে বিপর্যয়ের ক্ষত। তবে আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসে স্বস্তির শ্বাস ফেলছেন উত্তরবঙ্গবাসী।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৫ ২২:৫৫
Share:

দুর্যোগের চিহ্ন উত্তরবঙ্গের কোথাও কোথাও এখনও স্পষ্ট। ছবি: পিটিআই।

শনিবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার ভোর পর্যন্ত টানা বৃষ্টির জেরে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দার্জিলিং, কালিম্পং-সহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা। তবে রবিবার বেলা গড়াতে আর নতুন করে তেমন বৃষ্টি হয়নি উত্তরবঙ্গে। সোমবারও দিনভর আবহাওয়ার তেমন পরিবর্তন হয়নি। ফলে নতুন করে উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি আর খারাপ হয়নি। দুর্যোগের ঝঞ্ঝা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক হওয়ার পথে উত্তরবঙ্গের বিপর্যস্ত এলাকাগুলি। তবে নতুন করে বৃষ্টি না-হলেও উৎকণ্ঠা কাটছে না। এখনও দুর্যোগকবলিত এলাকায় আটকে অনেকে। তাঁদের উদ্ধার কাজ চলছে। একই সঙ্গে চলছে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের কাজও।

Advertisement

উত্তরবঙ্গের নদীগুলির জলস্তর অনেকটাই নেমে গিয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসে স্বস্তির শ্বাস ফেলছেন উত্তরবঙ্গবাসী। যদিও দুর্যোগের চিহ্ন এখনও কোথাও কোথাও স্পষ্ট। উদ্ধারকাজে কোনও খামতি রাখছে না প্রশাসন। সোমবারও আরও দেহ উদ্ধার হয়েছে। কোনও কোনও নদীতে দেহ ভাসতে দেখা গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের দুর্যোগের মৃত্যু অন্তত ২৫ জনের। আশঙ্কা, সেই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

উত্তরবঙ্গের দুর্যোগে মৃতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তা-ই নয়, তিনি আরও জানান, পরিবারের এক জন করে সদস্যকে দেওয়া হবে হোমগার্ডের চাকরি। উত্তরবঙ্গে যাওয়ার আগে কলকাতা বিমানবন্দর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, মৃতদের পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সাহায্য করা হবে।

Advertisement

দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিরিক। দুধিয়া থেকে মিরিকের পথে লোহার সেতু ভেঙে পড়েছে। মঙ্গলবার সেই বিধ্বস্ত মিরিকে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। খতিয়ে দেখবেন পরিস্থিতি। দুর্যোগের কারণে উত্তরবঙ্গে যে সেতুগুলি ভেঙেছে, তা আবার নতুন করে তৈরি করা হবে জানান তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘যে সেতুগুলি ভেঙেছে, সেগুলি ছোট। আমাদের মিরিক সেতু নির্মাণ করতে হবে।’’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, মিরিকে ওই সেতু আবার করে তৈরি করতে এক বছর লাগবে। তবে যাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত না-হয়, সেই কারণে একটি অস্থায়ী সেতু তৈরি করে দেওয়া হবে।

দার্জিলিং জেলার অনেক জায়গায় ধস নেমে রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। রোহিণী রোডের একাংশ ধসে নেমে গিয়েছে নদীর দিকে। তিস্তার জল রবিবার উঠে এসেছিল ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর। ওই রাস্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দার্জিলিং শহরের সঙ্গেও সাময়িক ভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ধসবিধ্বস্ত পাহাড়ে সব রাস্তা এখনও চালু করা যায়নি। ঘুরপথে পর্যটকদের নামতে হচ্ছে পাহাড় থেকে।

দার্জিলিং থেকে সমতলে নামার জন্য আপাতত দু’টি রাস্তা খোলা রয়েছে। হিল কার্ট রোড খোলা রয়েছে যা তিনধারিয়া হয়ে নেমে যাচ্ছে সুকনার দিকে। তার পরে সেখান থেকে রাস্তা চলে যাচ্ছে শিলিগুড়িতে। এ ছাড়া পাঙ্খাবাড়ি রোডও খোলা রয়েছে। তবে এই রাস্তাটি তুলনামূলক কঠিন। কার্শিয়াং শহরের কিছুটা আগে থেকে রাস্তাটি নেমে যায় নীচের দিকে। তার পরে দুধিয়ার কিছু দূরে গাড়িধুরায় গিয়ে মেশে রাস্তাটি। সেখান থেকে চলে যায় শিলিগুড়িতে। দার্জিলিঙের বিজনবাড়িতে যে পর্যটকেরা আটকে ছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলকেই পাঙ্খাবাড়ি এবং তিনধারিয়া হয়ে সমতলে নামিয়ে আনা হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে।

উত্তরবঙ্গে মমতা

রবিবারই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সোমবারই উত্তরবঙ্গে যাবেন। সেই মতো সোমবার কলকাতা থেকে বিমানে বাগডোগরা, তার পরে সড়কপথে দুর্যোগকবলিত কিছু জায়গা পরিদর্শন করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। কথা বলেন স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে। শুধু তা-ই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের সঙ্গেও দেখা করেন মমতা।

‘ম্যান মেড বন্যা’

উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতিকে ‘ম্যান মেড’ বলে মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার উত্তরবঙ্গ যাওয়ার আগে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে তিনি বলেন, ‘‘ভুটান এবং সিকিমের জলে উত্তরবঙ্গে বন্যা হয়েছে। সেই সঙ্গে ১২ ঘণ্টায় টানা ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অতি দুর্যোগের সঙ্গে ম্যান মেড বন্যা। এত জল যাবে কোথায়? আমরা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডের জল সহ্য করি। আর কত করব?’’ উত্তরবঙ্গে পৌঁছে পশ্চিমবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা বলেন মমতা। তাঁর অভিযোগ, ‘‘কেন্দ্র আমাদের বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য কোনও অর্থ দেয় না।’’

রাজ্যপালও উত্তরবঙ্গে

সোমবার উত্তরবঙ্গে যান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও। দুধিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন তিনি। সেখান মানুষের দুর্ভোগের কথা শোনেন। শুধু তা-ই নয়, বেশ কয়েকটি পরিবারের হাতে ত্রাণও তুলে দেন রাজ্যপাল। পরে তিনি বলেন, ‘‘গোটা ঘটনা চাক্ষুষ করতেই ঘটনাস্থলে আসা। গ্রাউন্ড জিরোতে দাঁড়িয়ে দেখলাম গোটা পরিস্থিতি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। সাধারণ মানুষ ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শান্তি বজায় রেখে সকলকে একসঙ্গে কাজ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’’ তিনি এ-ও জানান, এটা দোষারোপ করার সময় নয়। রাজ্য, কেন্দ্র সকলকে এগিয়ে এসে এই দুর্যোগের মোকাবিলা করতে হবে।

বিপর্যস্ত এলাকায় বিজেপি নেতারা

রবিবার দুপুর থেকেই বিজেপির তৎপরতা শুরু হয়েছিল উত্তরবঙ্গ নিয়ে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা দার্জিলিঙে স্থানীয় সাংসদ রাজু বিস্তা তার কিছু আগে থেকেই সক্রিয় হয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে পরিস্থিতি বিশদে জেনে দুপুর নাগাদ আসরে নামেন বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বও। দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু ছাড়াও আলিপুরদুয়ারের সাংসদ মনোজ টিগ্গা এবং জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্ত রায় বিভিন্ন দুর্গত এলাকায় পৌঁছে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছিলেন। একই ভূমিকায় ময়দানে নামেন মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি, শিলিগুড়ি ও কালচিনির তিন বিধায়ক আনন্দময় বর্মণ, শঙ্কর ঘোষ এবং বিশাল লামা। সোমবার সকালে উত্তরবঙ্গে পৌঁছোন বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। তাঁকে নিয়ে দলীয় বিধায়ক-সাংসদেরা বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন উত্তর মালদহের সাংসদ খগেন মুর্মু এবং ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মণ।

নেই ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস

সোমবার উত্তরবঙ্গের সব জেলাতেই ধরেছে বৃষ্টি। সাগরের উপরে যে নিম্নচাপ ছিল, তা শক্তিক্ষয় করে বিহারের উপরে ঘূর্ণাবর্তে পরিণত হয়েছে। তাই উত্তরবঙ্গে ভারী বৃষ্টির আর সম্ভাবনা নেই, বলেই জানিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। মঙ্গলবার থেকে উত্তরবঙ্গের আট জেলায় ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা আর নেই। কিছু জেলায় হালকা থেকে মাঝারি বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হতে পারে। তবে কোথাও সতর্কতা জারি করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

আক্রান্ত বিজেপি নেতারা

সোমবার সকালে দুর্যোগকবলিত নাগরাকাটায় একাধিক এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে আক্রান্ত হন বিজেপির দুই নেতা— খগেন এবং শঙ্কর। জলপাইগুড়ির বামনডাঙায় ঢোকার আগে বিক্ষোভের মুখে পড়েন দু’জনে। লাঠি, জুতো নিয়ে তাঁদের উপর চড়াও হন কয়েকশো মানুষ। নদী থেকে পাথর তুলে তাঁদের গাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। তাতেই মাথা ফেটে যায় খগেনের। গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে। ধাক্কা দেওয়া হয় শঙ্করকেও।

‘কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা কাম্য নয়’

কঠিন পরিস্থিতিতে সকলকে শান্ত থাকার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। খগেন, শঙ্কররা আক্রান্ত হওয়ার পর পরই উত্তরবঙ্গে পৌঁছোন তিনি। সেখান থেকেই সমাজমাধ্যমে একটি পোস্টে সকলকে সংযত থাকার বার্তা দেন। তাঁর কথায়, ‘‘এই সময় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা কাম্য নয়।’’ যদিও তিনি তাঁর পোস্টে কারও নাম উল্লেখ করেননি।

রাজ্যে আসছেন কিরেন রিজেজু, উত্তরবঙ্গে যাবেন শুভেন্দুও

মঙ্গলবার রাজ্যে আসছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজেজু। উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে যাবেন তিনি। শুধু তিনি একা নন, মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গে যাবেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার পাশাপাশি খগেনকেও দেখতে যাবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। শুভেন্দুর কথায়, ‘‘প্রয়োজনে ওঁকে নিয়ে দিল্লির এমসে নিয়ে যেতে হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement