পায়ে স্নিকার, সূর্যের শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছিল দিনটা আজ অন্য রকম

গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছিল সকাল থেকেই। রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ছোট ম্যাটাডর মঞ্চের উপর যখন উঠলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, পায়ে স্নিকার, হাতের কব্জিতে ঘড়িটা নেই। সচরাচর ফর্ম্যাল পোশাকের সঙ্গে ছাড়া অন্য সময় চটিই পড়েন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৫ ১৭:৫২
Share:

ঘটনার প্রতিবাদে রেড রোডে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন বাম বিধায়করা।

গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছিল সকাল থেকেই। রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ছোট ম্যাটাডর মঞ্চের উপর যখন উঠলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, পায়ে স্নিকার, হাতের কব্জিতে ঘড়িটা নেই। সচরাচর ফর্ম্যাল পোশাকের সঙ্গে ছাড়া অন্য সময় চটিই পড়েন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক। বৃহস্পতিবার অন্য রকম ছবি দেখে মনে হচ্ছিল, এ বারের প্রস্তুতি তা হলে অন্য রকম!

Advertisement

ইঙ্গিতটা আরও একটু স্পষ্ট হল কিছু ক্ষণ পরে। বিরোধী দলনেতার মোবাইলে ফোন এল পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। বামেদের নবান্ন অভিযানের দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে নেই। উত্তরবঙ্গ থেকে ফেরার কথা বিকালে। তাই তখন পার্থবাবুর প্রস্তাব ছিল, বাম নেতাদের কোনও প্রতিনিধি দল যদি নবান্নে আসেন তা হলে পরিষদীয় মন্ত্রী তাঁদের কাছ থেকে দাবিপত্র নেওয়ার জন্য থাকবেন। কিন্তু, পত্রপাঠ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন বিরোধী দলনেতা। তাঁর বক্তব্য, দাবিপত্র তাঁরা একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীকেই দেবেন, নচেৎ কাউকে নয়। আর তাঁদের মিছিলের কর্মসূচিও বহাল থাকবে। তখনই আরও পরিষ্কার হয়ে গেল, এ বার আর নাম-কা-ওয়াস্তে বিক্ষোভ নয়, আটঘাট বেঁধেই পথে নেমেছে বামেরা।

রানি রাসমণির মোড়ে বামেদের নাকের ডগায় বিরাট পুলিশ বাহিনী তখন পথ আগলে দাঁড়িয়ে। বামেরা কিন্তু সে দিকে দৃকপাত না করে মিছিল ঘুরিয়ে দিল উল্টো দিকে। ধর্মতলা হয়ে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে গাঁধী মূর্তিকে বাঁ দিকে রেখে সূর্যবাবুদের মিছিল এগিয়ে চলল ডাফরিন রোড ধরে। ডাফরিন রোডে ওঠার মুখেই ছিল ট্রাফিক গার্ডরেল দিয়ে তৈরি পুলিশের প্রথম ব্যারিকেড। পায়ে পায়ে মুহূর্তের মধ্যেই সে সব ছত্রভঙ্গ। আরও কিছু দূর এগোনোর পর আরও বড় ব্যারিকেড। তার উপরে সম্পূর্ণ ব্যাটল গিয়ারে পুলিশ বাহিনী। মিছিলকারীদের স্রোত ব্যারিকেডের উপরে আছড়ে পড়ছে। আর পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে পথ ছেড়ে দেওয়ার জন্য। পরিস্থিতি উত্তপ্ত বুঝে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু-সহ কয়েক জন প্রবীণ বাম নেতাকে সরিয়ে আনা হয়েছে রাস্তার পাশে। ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কর্পোরেশনের (সিটিসি) তাঁবুর সামনে বিমানবাবুর পাশেই দাঁড়িয়ে আমরা গুটিকয়েক সাংবাদিক।

Advertisement

ব্যারিকেড ভেঙে ফেলার জন্য এক দিকে যখন প্রাণপণ চেষ্টা চলছে, একইসঙ্গে তখন ময়দান চত্বরে এসে ভিড়ছে একের পর এক মিছিল। এরই মধ্যে কয়েক দঙ্গল লোকের একটা মিছিল সূর্যবাবুকে নিয়ে চলে গেল ময়দানের অন্য দিকে রেড রোড ধরে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে। ডাফরিন রোডে তখন চরম উত্তেজনা। হঠাৎই প্রবল চিৎকারের মধ্যে ভেঙে পড়ল পুলিশি ব্যারিকেডের একটা অংশ। পর মুহূর্তেই আমরা দেখলাম, লাঠিধারী পুলিশ আগুয়ান জনতাকে ‘পুশব্যাক’ করছে মেয়ো রোডের দিকে। ডাফরিন রোডের এক দিকে ট্রামলাইন, অন্য দিকে বিরাট নয়ানজুলি। পুলিশের তাড়া খেয়ে হুড়োহুড়ির মধ্যে এক দিকে নয়ানজুলি এবং অন্য দিকের ট্রামলাইনে হোঁচট খেয়ে কাদামাঠের মধ্যে পড়ছে একের পর এক চেহারা।

‘ওদের মারছে কেন, ওদের মারছে কেন’, বলতে বলতে হঠাৎই ক্লাব তাঁবুর সামনে থেকে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলেন বিমানবাবু। ডাফরিন রোডের মাঝখানে তখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন তিন মহিলা। পুলিশের লাঠি তাঁ‌দের রেয়াত করছে না। সে দৃশ্য দেখেই পিছু হঠে গিয়েও পুলিশের দিকে ইট ছুড়ছে মিছিলের জনতা। বিমানবাবু যখন রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন তখন একেবারে সম্মুখসমর। যথারীতি পুলিশের লাঠি এসে পড়ল বিমানবাবুর পায়ে, মাথায় একটা ইটের টুকরো, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে যে ইট পুলিশ পাল্টা ছুড়ছিল বিক্ষোভকারীদের দিকে। বিমানবাবুর আঘাত লাগার খবর ছড়াতেই এ বার উল্টো দৃশ্য। একজোট হয়ে মিছিলকারীরা পাল্টা তাড়া শুরু করল পুলিশকে। রাস্তার পাশে ময়দানের বিভিন্ন ক্লাব তাঁবুর সামনে পড়েছিল বড় বড় পাথরের টুকরো। মিছিলে আসা গ্রামের লোকজনকে দেখলাম তড়িৎগতিতে সেই পাথর ভাঙায় হাত লাগিয়েছেন। একের পর এক ইটের টুকরো তৈরি হচ্ছে আর জনতার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘এই নে’। খণ্ডযুদ্ধ চলতে চলতেই বামেদের মিছিলে আনা ম্যাটাডরটা মেরে সরিয়ে দিতে বাধ্য করল পুলিশ। জনতারও পাল্টা আক্রোশ গিয়ে পড়ল পুলিশের একটা ভ্যানের উপর। ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল উইন্ডস্ক্রিন। খণ্ডযুদ্ধ শেষে ভ্যানে লাগানো পুলিশের মাইক দখল করেই অবস্থানে বসলেন বিমানবাবুরা!

ও দিকে তখন রেড রোডে পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে খালি গলায় ভাষণ দিচ্ছেন সূর্যবাবু। বলছেন, ‘‘শুনেছিলাম, মুখ্যমন্ত্রী বিকেল ৩টেয় দমদম বিমানবন্দরে নামবেন। তার পর এই রাস্তা দিয়েই সাড়ে ৩টের মধ্যে নবান্নে পৌঁছে যাবেন। আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, এখান দিয়ে গেলে আমাদের উপর দিয়ে যেতে হবে। কোথায় উনি? দিনের শেষে আমরা আছি, উনি নেই।’’

শুনশান রেড রোডে তখন যেন যুদ্ধজয়ী জনতার সহর্ষ হাততালি। যাদের কাছে দিনটা আজ সত্যিই ছিল অন্য রকম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন