কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক বার্তা পেয়ে কিছুটা ঘাবড়েই গিয়েছিলেন লালবাজারের গোয়েন্দা অফিসারটি।
সেই বার্তায় নিরাপত্তার জন্য নতুন কিছু অদ্ভুত অনুসন্ধানী যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। যেমন রেডিয়েশন ডিটেক্টর, রেডিয়েশন ডোসিমিটার, রেডিয়েশন পোর্টাল মনিটর। ভিআইপি অর্থাৎ তাবড় নেতা-মন্ত্রীর সভা বা অনুষ্ঠানস্থলে নিরাপত্তার জন্য এখন এই সব অনুসন্ধানী যন্ত্র রাখতে বলছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাদের বক্তব্য, যন্ত্রগুলি এমন সব বিপজ্জনক বস্তু খুঁজতে পারবে, যার কথা আগে তেমন জানা যায়নি বলে গোয়েন্দাদের দাবি।
এত দিন বন্দুক বা আইইডি-র মতো মারণাস্ত্র খুঁজতে মেটাল ডিটেক্টর, এক্স রে ব্যাগেজ স্ক্যানার বা আন্ডার ভেহিকেল ইনস্পেকশন মিরর জাতীয় সরঞ্জাম রাখতে বলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তারাই এখন নতুন এই সব সরঞ্জামগুলি রাখতে বলছে। কারণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য—জঙ্গি হামলা এখন খালি আইইডি বা রাসায়নিক অস্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তেজস্ক্রিয় অস্ত্র নিয়েও নাশকতার ছক কষা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা তথ্যে জানা যাচ্ছে!
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইবি-র বক্তব্য, চিকিৎসার বহু সরঞ্জাম তেজস্ক্রিয় শক্তি সম্পন্ন। যেমন আইসোটোপ— যা বিভিন্ন হাসপাতাল, গবেষণাগারে পাওয়া যায়। জঙ্গিরা এমনই সরঞ্জাম হাতিয়ে হামলা চালাতে পারে। আইবি-র এক কর্তার কথায়, ‘‘হামলার জন্য তেজস্ক্রিয় শক্তি সম্পন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম জোগাড় করা
সহজ।’’ বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহরণহীন কিছু তেজস্ক্রিয় বস্তুর সংস্পর্শে এলে মানুষের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা। এর ‘গামা’ রশ্মির তেজস্ক্রিয়তা দেহকোষ নষ্ট করে দেয়।
কী ভাবে শরীরের ক্ষতি করে এই তেজস্ক্রিয় বস্তু? বিশেষজ্ঞরা তিন রকম পদ্ধতির কথা বলছেন। এক, ত্বক ভেদ করে শরীরে ঢুকে ক্ষতি করতে পারে তেজস্ক্রিয় বস্তু। দুই, এটা গ্যাস বা তরল হলে তা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে অথবা খাবার ও পানীয়ের সঙ্গে মিশে শরীরে ঢুকবে। তিন, কোনও ক্ষতের সংস্পর্শে এলে দ্রুত শরীরে ঢুকবে। এই কারণে তেজস্ক্রিয় বস্তুর সংস্পর্শে এলে কেউ অসুস্থতা, এমনকী মৃত্যুও হতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ন’বছর আগে কথা। ২০০৬-এর নভেম্বর। রুশ গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি-র এক প্রাক্তন অফিসার হঠাৎই রহস্যজনক ভাবে ব্রিটেনে মারা যান। তদন্তে ধরা পড়ে, রেস্তোরাঁয় তাঁর চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল তেজস্ক্রিয় একটি উপাদান!
২৯ মে দিল্লির ইন্দিরা গাঁধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেরর টার্মিনাল ২-এ কিছু বস্তু তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে বলে যন্ত্রে ধরা পড়ায় হইচই বেধে গিয়েছিল। পরে তল্লাশিতে বোঝা যায়, সন্দেহজনক বস্তু আসলে এমন এক আইসোটোপ, যা সাধারণত থাইরয়েড ক্যান্সারের চিকিৎসার লাগে। এমন আইসোটোপকেই জঙ্গিরা তেজস্ক্রিয় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আশঙ্কা।
সে যাত্রা দিল্লি বিমানবন্দরে মিলেছিল সোডিয়াম আয়োডাইডের আইসোটোপ। বছর বিশেক আগে চেচেন জঙ্গিরা মস্কোর একটি পার্কে বিস্ফোরকের সঙ্গে মুড়ে রাখে সিজিয়াম ১৩৭-এর আইসোটোপ। যা নেওয়া হয়েছিল ক্যান্সার চিকিৎসার সরঞ্জাম থেকে। বিস্ফোরণে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ গোটা তল্লাটে ছড়িয়ে পড়বে বলে মনে করেছিল জঙ্গিরা। তার আগেই অবশ্য নিরাপত্তারক্ষীরা সে সব উদ্ধার করেন।
সম্ভবত একই আইসোটোপ বা কোবাল্ট-৬০ আইসোটোপকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেই ১৯৯৩ সালে খুন করা হয় রুশ ভারোত্তোলক ভ্লাদিমির কাপলুনকে। তেজস্ক্রিয় বস্তু রাখা হয়েছিল তাঁর চেয়ারে।
আইবি-র বক্তব্য, কিছু দিন ধরে ইরাকের জঙ্গিরাও তেজস্ক্রিয় হাতিয়ার ব্যবহার করছে। এদের একা়ংশ যোগ দিয়েছে আইএসে। আইএস ভারতে হামলা চালাতে পারে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে এক মার্কিন দৈনিক।
এক আইবি অফিসারের কথায়, ‘‘জঙ্গিরা হামলার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টায় থাকে। তাই তেজস্ক্রিয় অস্ত্রের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে সতর্ক থাকতে হবে।’’ ওই গোয়েন্দা-কর্তা জানান, এত দিন আইইডি বা বিস্ফোরক চিহ্নিত করা, নিষ্ক্রিয় করা ও নিরাপদ স্থানে সরানোর পদ্ধতি নিরাপত্তারক্ষীদের অনুশীলন করতে হয়েছে। তেজস্ক্রিয় অস্ত্রের জন্য অন্য রকম সতর্কতারও প্রস্তুতি নিতে হবে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শ থেকে কী ভাবে যতটা সম্ভব রক্ষা পাওয়া যাবে, কী ধরনের সুরক্ষা পোশাক ও মুখোশ পরতে হবে, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শুরু হয়েছে, এমন জায়গা কী ভাবে দ্রুত খালি করতে হবে এবং হাসপাতালই বা কী করে তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত বহু রোগীকে চিকিৎসা দেবে, বলছেন ওই অফিসার।