ছবি: সংগৃহীত।
সিভিক ভলান্টিয়ারের সেই দাপট নেই। আরজি কর হাসপাতাল এখন নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। ইতিউতি ঘোরাফেরা করছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর আধিকারিকেরা। চোখে পড়ছে পুলিশও।
বছরখানেক আগে আরজি করে এই ছবি দেখা যেত না। কিন্তু গত বছরের অগস্ট মাসের ঘটনার পর ছবি পাল্টেছে। কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের নেপথ্যে নিরাপত্তার গাফিলতিকেই অনেকাংশে দায়ী করেছিলেন আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকেরা। নিরাপত্তা ও অন্যান্য সংস্কারের নানা দাবি তুলে পথে নেমেছিলেন তাঁরা।
এক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কলকাতা শহরের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালেই নিরাপত্তা আগের চেয়ে বেড়েছে। বাড়তি সিসিটিভি-ও বসানো হয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্ব সিভিক ভলান্টিয়ারদের হাত থেকে গিয়েছে পুলিশ বা বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। আরজি কর ব্যতিক্রম নয়। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী (সিআইএসএফ) রয়েছে। গত এক বছরে আরজি করে নিরাপত্তা এবং নজরদারি বেড়েছে। সারা দিন পুলিশ এবং নিরাপত্তারক্ষীরা থাকেন। ঘোরাঘুরি করেন। রাতে দফায় দফায় টহল দেন।
আরজি কর-সহ বিভিন্ন হাসপাতালে গত এক বছরে নিরাপত্তার প্রয়োজন কতটা মিটল? ডাক্তারদের কোন কোন দাবি এখনও পূরণ হল না? কী কী সমস্যা এখনও থেকে গিয়েছে? সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখল আনন্দবাজার ডট কম।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ
হয়েছে
হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে সিভিক ভলান্টিয়ারদের সরিয়ে পুলিশকর্মী মোতায়েন। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন। হাসপাতাল চত্বরে মোট ২৯৩ জন নিরাপত্তাপক্ষী মোতায়েন। বসেছে বাড়তি সিসি ক্যামেরা। মোট সংখ্যা ৫৩২। চিকিৎসকদের জন্য আলাদা বিশ্রামঘর হয়েছে। সেখানে জল পরিশোধনকারী যন্ত্র বসেছে। রাতবিরেতে হাতের কাছে ন্যূনতম পরিষেবা পাওয়ার মতো পরিকাঠামোগত পদক্ষেপ করা হয়েছে। রাতে হাসপাতালের সর্বত্র আলো থাকছে। একাধিক বাড়তি আলোর ব্যবস্থা হয়েছে।
হয়নি
‘প্যানিক বাটন’ বসানোর কাজ শেষ হয়নি। মোট ২৭০টি প্যানিক বাটন বসানোর পরিকল্পনা আছে। জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। কাজ এখনও বাকি। হাসপাতালে সিসি ক্যামেরা এখনও পর্যাপ্ত নয়। আরও সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা আছে।
আরজি করে কর্মরতরা নিরাপত্তা নিয়ে মুখ খুলতে একেবারেই রাজি নন। জরুরি বিভাগের বিল্ডিংয়ের নীচে এক মহিলা চিকিৎসককে প্রশ্ন করায় বিরক্তির সুরে বললেন, ‘‘এখন আবার এ সব প্রশ্ন কেন?’’ পরক্ষণেই নিচুস্বরে বললেন, ‘‘নিরাপত্তা যা আছে, তাতে রাতের ডিউটি করতে আর তেমন ভয় লাগে না।’’ আগের চেয়ে নিরাপত্তা বেড়েছে বলে অনেকেই মানছেন। আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ’ আরজি করের অনিকেত মাহাতোরও বক্তব্য, ‘‘হাসপাতালে কেন্দ্রীয় বাহিনী আছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই নিরাপত্তা আগের চেয়ে বেড়েছে। তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অনেক অন্ধকার জায়গায় আলো লাগানো হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকলে কী হবে, সে প্রশ্ন এখনও থেকে গিয়েছে। প্রথম ধাপে যত সিসিটিভি লাগানো হয়েছিল, পরের ধাপে তত হয়নি। এখনও কিছু কাজ ঝুলে রয়েছে। জরুরি বিভাগের বিল্ডিংয়ের চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম তলায় এখনও পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা নেই।’’ চিকিৎসকদের বিশ্রামঘর এবং শৌচালয় নিয়ে অনিকেতের মন্তব্য, ‘‘কিছু রেস্টরুম তৈরি করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মহিলা ও পুরুষের জন্য আলাদা রেস্টরুম করা হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট যে বায়োমেট্রিকের ব্যবস্থা করতে বলেছিল, তা-ও হয়নি। প্যানিক বাটন হয়নি। সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো তেমন কিছু হয়নি।’’ কেন? অনিকেতের ব্যাখ্যা, ‘‘হাসপাতালের অধ্যক্ষ, ডিন, এমএসভিপি-রা অপরাধে জড়িত থাকলে সিসিটিভি-র তথ্য নষ্ট করা কোনও ব্যাপার নয়। অপরাধের এই কারণগুলি নির্মূল করা গেলে প্রকৃত নিরাপত্তা পাওয়া যাবে।’’
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
হয়েছে
হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে সিভিক ভলান্টিয়ার নেই। আউটপোস্টে পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে। বাড়তি ১৪ জন পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১০ জন মহিলা। বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে ৭৫ জন। ৩০ জন পুরুষ। ৪৫ জন মহিলা। রাতের নিরাপত্তা খতিয়ে দেখতে ‘এসওপি’ তৈরি করে প্রতি দিন চার বার করে পুলিশি টহল হচ্ছে। যে সমস্ত এলাকায় মহিলাকর্মী বা মহিলা চিকিৎসকেরা থাকেন, সেখানে বাড়তি নজর দেওয়া হচ্ছে। টহল শেষে নির্দিষ্ট খাতায় স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সব শেষে তা খতিয়ে দেখছেন হাসপাতালের সুপার। হাসপাতালের সর্বত্র আলোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। বেশ কিছু নতুন শৌচাগার তৈরি হয়েছে। পুরনো শৌচাগারগুলি পরিষ্কার করা হয়েছে। রাতে রেসিডেন্ট ডাক্তারদের থাকার জন্য ঘর তৈরি হয়েছে। পর্যাপ্ত পানীয়জল, বাতানুকূল যন্ত্রের বন্দোবস্ত হয়েছে।
হয়নি
প্যানিক বাটনের বন্দোবস্ত হয়নি। সব ঘরে আলাদা আলাদা করে বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা করা যায়নি। সব ঘরে আলাদা করে ওই ব্যবস্থা (আঙুলের ছাপ নেওয়া) চালু করার কথা ভাবা হয়েছিল। ঠিক ছিল, কোন ঘরে কে ঢুকবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে এবং সেই অনুযায়ী বায়োমেট্রিকের ব্যবস্থা রাখা হবে। সেই ঘরে বাইরের কেউ ঢুকতে পারবেন না। কিন্তু ডাক্তারি পড়ুয়ারা সে ব্যবস্থা মানতে চাননি। তাঁদের দাবি, এমস হাসপাতালের মতো ‘কেন্দ্রীয় মনিটরিং ব্যবস্থা’ প্রয়োজন। অর্থাৎ, সব ঘরে সকলের প্রবেশের অনুমতি থাকবে। যে যেখানে যাবেন, সেখানে তাঁর আঙুলের ছাপ নথিভুক্ত হয়ে থাকবে। কর্তৃপক্ষ এবং পড়ুয়াদের মধ্যে দ্বিমতের কারণে এখনও ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়নি। পরিকল্পনা ছিল, কোন গাড়ি হাসপাতালে ঢুকছে, কী দরকার, তা সহজে বোঝার জন্য হাসপাতালের আটটি প্রধান ফটকে নজরদারির ক্যামেরা বসাবে পুলিশ। সিসিটিভি-র নজরদারি বৃদ্ধি করারও কথা ছিল। গত এক বছরে ৩৫০টি বাড়তি সিসি ক্যামেরা বসেছে। কিন্তু ২৬ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হাসপাতালে তা যথেষ্ট নয়। সিসিটিভি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় সার্ভার রুম এখনও হয়নি।
কলকাতা মে়ডিক্যালের চিকিৎসক তথা আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম আমরণ অনশনকারী স্নিগ্ধা হাজরা মানছেন, নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু সার্বিক নিরাপত্তায় খুব উন্নতি হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘আগে সিভিকেরা থাকতেন। এখন তাঁদের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা সামান্য বেড়েছে। তাঁরা সময়মতো ঠিকঠাক জায়গায় থাকেন। যেটা আগে ছিল না। কিন্তু সার্বিক ভাবে হাসপাতালের নিরাপত্তা খুব বেড়েছে বলা উচিত নয়। সিসিটিভি লাগানো হয়েছিল। আবার খুলে নেওয়া হয়েছে বা ভেঙে গিয়েছে। রাতের পরিস্থিতি আগের চেয়ে খুব একটা বদলায়নি।’’ রাতের ডিউটি করতে গিয়ে আগের চেয়ে নিরাপদ লাগে? স্নিগ্ধার জবাব, ‘‘নিরাপত্তার অনুভব যার যার নিজের। তবে প্রচুর লোকজন বা সিসিটিভি থাকলে যতটা নিরাপদ লাগার কথা, ততটা লাগে না। নতুন করে এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না, যাতে সুরক্ষিত বোধ করব।’’
এমআর বাঙুর
হয়েছে
চিকিৎসক এবং পড়ুয়াদের দাবি মেনে ডিউটি রুম লাগোয়া শৌচালয় হয়েছে। বাতানুকূল যন্ত্র, পানীয়জলের ব্যবস্থার অধিকাংশই হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। বেড়েছে নজরদারি। পুলিশের পাশাপাশি বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মহিলা নিরাপত্তারক্ষীরাও রয়েছেন। কেন্দ্রীয় ‘রেফারেল সিস্টেম’ ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
হয়নি
প্যানিক বাটন বসানো হয়নি। রোগীদের সুবিধার্থে কতগুলি বেড খালি, তা প্রদর্শনের দাবিও পূরণ হয়নি।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ
হয়েছে
২২টি প্যানিক বাটন লাগানো হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ২৯৩টি অতিরিক্ত সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। হাসপাতাল চত্বরে পুলিশকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী বাড়ানো হয়েছে ৬৬ জন। রাতের নজরদারিতে আগের চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।
হয়নি
নিরাপত্তারক্ষী এখনও পর্যাপ্ত নয়। সিসিটিভি-র সংখ্যা আরও বাড়াতে প্রয়োজন।
আরজি কর আন্দোলনের সময়ে অনশন করেছিলেন আলোলিকা ঘোড়ুই। তাঁর কথায়, ‘‘আগের চেয়ে নিরাপত্তা বেড়েছে। কিন্তু এখনও অনেক কিছু হয়নি। কুলার লাগানোর কথা ছিল। সেটা এখনও হয়নি। বেশ কিছু সংস্কারের কাজ শুরু হয়েও শেষ হয়নি। সিসি ক্যামেরা লাগানোর জন্য অনেক জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছিল। বসানো হয়নি।’’ তবে পাশাপাশিই আলোলিকা বলছেন, ‘‘প্যানিক বাটনের ব্যবস্থা হয়েছে। রাতে আগের চেয়ে কিছুটা নিরাপদ বোধ করি। ডাকলে পুলিশ তাড়াতাড়ি আসে। রাতে টহলদারিও চলে।’’
এনআরএস
হয়েছে
সিসিটিভি-র নজরদারি বৃদ্ধি হয়েছে। এখন মোট ৬২৪টি সিসি ক্যামেরা সক্রিয়। অতিরিক্ত ৭৫ জন বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৪০ জন পুরুষ, ৩৫ জন মহিলা। কেন্দ্রীয় ‘রেফারেল সিস্টেম’ চালু হয়েছে। কত বেড খালি, তা প্রদর্শনের জন্য ডিসপ্লে বোর্ড করা হয়েছে। চিকিৎসকদের জন্য ঘর এবং শৌচালয় হয়েছে।
হয়নি
সিসিটিভি বসানো হলেও তা নিয়ন্ত্রণের (মনিটরিং) ঠিকঠাক ব্যবস্থা হয়নি।
হাসপাতালের চিকিৎসক এবং আরজি করের ঘটনায় আন্দোলনকারী পুলস্ত্য আচার্য মনে করেন, নিরাপত্তায় এখনও ফাঁক রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘শূন্য পরিবর্তন! যা আশা করা হয়েছিল, তার কিছুই হয়নি। থ্রেট কালচারও আগের মতো রয়েছে। সিসিটিভি বসানো হয়েছে। কিন্তু তা দিয়ে তো থ্রেট কালচার আটকানো যায় না! সিসিটিভি নিয়ন্ত্রণের (মনিটরিং) লোক কোথায়? পুলিশ দিলেও এই সমস্যাগুলো রয়েই গিয়েছে।’’
এসএসকেএম
হয়েছে
আগের চেয়ে সিসি ক্যামেরার সংখ্যা বেড়েছে। কিছু কিছু জায়গায় প্যানিক বাটন বসেছে। হাসপাতালের খালি বেডের পরিসংখ্যান দিয়ে ডিসপ্লে বোর্ড লাগানো হয়েছে। রাতের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ এবং বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের যৌথ দল তৈরি হয়েছে। চিকিৎসকদের জন্য বিশ্রামঘর এবং শৌচাগারের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।
হয়নি
সর্বত্র প্যানিক বাটন বসানো হয়নি। আরও কিছু ‘স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে’ প্যানিক বাটন প্রয়োজন।
এসএসকেএমের চিকিৎসক বিপ্রেশ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘সিসি ক্যামেরা অনেক লাগানো হয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যে বায়োমেট্রিক ব্যবস্থার কথা বলেছিল, তা হয়নি। প্রথম প্রথম কিছু লোকদেখানো যন্ত্র লাগানো হয়েছিল। নেহাতই হাস্যকর। ডিসেম্বরের মধ্যে সে সবের পাট চুকে যায়। প্যানিক বাটন এখনও নেই। নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা বা়ড়লেও অবস্থা আগের মতোই। যখন তখন যে কেউ ঢুকে পড়েন হাসপাতালে। আমরা বললে তার পরে নিরাপত্তারক্ষীরা সজাগ হন। নিরাপত্তায় এখনও অনেক খামতি রয়ে গিয়েছে।’’
(লেখা: অঙ্গীরা চন্দ। তথ্য: সারমিন বেগম)