One Year of RG Kar Case

এক বছর আগে তিন দলের তিন প্রতিনিধি পৌঁছেছিলেন আরজি করে, বছর ঘোরার পর কী মনে হচ্ছে? লিখলেন তাঁরাই

গত বছর ৯ অগস্ট বিজেপির পক্ষে আরজি করে পৌঁছেছিলেন বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রার পরে বামেদের পক্ষে পৌঁছেছিলেন সিপিএমের মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। তৃণমূলের পক্ষে প্রথম কে পৌঁছেছিলেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে বিধায়ক নির্মল ঘোষ যে ছিলেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৪৪
Share:

আরজি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল গত বছর ৯ অগস্ট সকালে। বেলা গড়াতেই রাজনীতিক এবং জনপ্রতিনিধিরা পৌঁছোতে শুরু করেছিলেন হাসপাতালে। পৌঁছেছিলেন বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক তথা পানিহাটির বিধায়ক নির্মল ঘোষ। ঘটনাচক্রে, তাঁর বিধানসভা এলাকারই বাসিন্দা ছিলেন নিহত তরুণী। তবে শাসকদলের তরফে তিনিই প্রথম পৌঁছেছিলেন কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। আরজি করের জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি, তাঁরা তৃণমূলের এক চিকিৎসক-বিধায়ককে সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ হাসপাতালের চেস্ট মেডিসিন বিভাগে দেখেছিলেন। যিনি আরজি করের সঙ্গে জড়িত। যদিও তিনি নিজে তা স্বীকার করছেন না। উল্টে তাঁর দাবি, তিনি গিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ। অত সকালে নাকি তিনি ঘুম থেকেই ওঠেন না। তাঁর আরও দাবি, তিনি সেখানে গিয়ে দেখেছিলেন দলের এক প্রবীণ সাংসদকে।

Advertisement

দুপুরে পৌঁছেছিলেন আসানসোল দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। পরিপার্শ্ব দেখে এবং পুলিশের ‘অতিসক্রিয়তা’ প্রত্যক্ষ করে সে দিনই পদ্মশিবিরের তরফে নানাবিধ প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। বামেদের পক্ষে আরজি করে প্রথম পৌঁছেছিলেন সিপিএম নেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। সে দিন ছিল প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রা। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগে বুদ্ধদেবের দেহদান হয়ে যাওয়ার পরেই আরজি করে যান মিনাক্ষীরা। তখন ময়নাতদন্তের পরে নির্যাতিতার দেহ নিয়ে শববাহী শকট বার হচ্ছিল আরজি কর থেকে। সেই গাড়ি কিছুক্ষণের জন্য আটকেও দিয়েছিলেন মিনাক্ষীরা।

অগ্নিমিত্রা পাল

Advertisement

একটা গোটা বছর চলে গিয়েছে। কিন্তু এখনও সেই ভয়াবহ দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসে। একজন মা, একজন নারী এবং একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি সে দিন ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেল, দোষীদের শাস্তি হওয়া তো দূরের কথা, তাদের সকলকে চিহ্নিতও করা গেল না! তার মূল কারণ এই রাজ্যের শাসক তৃণমূল। সেই দলের প্রধান কর্মীরা, অর্থাৎ এ রাজ্যের প্রশাসন এবং সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ঘটনার প্রমাণ লোপাটে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে সিবিআই সঠিক ভাবে তদন্ত করতে পারছে না। তাদের তদন্তে ব্যাঘাত ঘটছে।

গত একটা বছরে বিভিন্ন বার আমি এই বিষয়ে বিধানসভায় সরব হয়েছি। মহিলা কমিশন এবং মানবাধিকার কমিশনে রিপোর্ট জমা দিয়েছি। বিপন্ন পরিবারটির পাশে থেকেছি। ঘটনার একটা বছর পরে এসে বলতে চাই, কেউ ভাববেন না, অভয়ার আন্দোলনে ইতি পড়েছে। বরং একটা বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। যতদিন না বাংলার মেয়েরা নিরাপদ বোধ করেন, ততদিন আমার এবং আমাদের সেই লড়াই থামবে না। মা-বোনেদের সম্মান আমরা উন্মত্ত, বিকৃত তৃণমূল কর্মীদের কাছে বিকিয়ে দিতে পারি না!

আমরা সে দিনও প্রতিবাদ করেছি, এখনও পথে আছি, আগামীতেও থাকব। শনিবার, ৯ অগস্ট আমাদের নির্যাতিতা বোনের মা-বাবা নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছেন। আপামর বাঙালিকে পথে নামার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। আমি পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে আবেদন করছি, আপনারা পথে নামুন। প্রশ্ন করুন। সংগ্রামের মাধ্যমে নারীর সম্মান এবং অধিকার ছিনিয়ে নিন। এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন নবান্ন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গণতান্ত্রিক ভাবে বিতাড়িত করা হবে। আপনারা সঙ্গে থাকলে সেটা সম্ভব হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

নির্মল ঘোষ

গত বছর আরজি কর হাসপাতালে যেদিন ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটেছিল, সেদিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহ বিধানসভায় শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আনা হয়েছিল। সেখানেই খবর পাই, আরজি কর হাসপাতালে এক মহিলা চিকিৎসক নৃশংস ভাবে খুন হয়েছেন। আরও জানতে পারি, তিনি আমারই বিধানসভা এলাকা পানিহাটির বাসিন্দা ছিলেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মরদেহ বিধানসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ছুটেছিলাম আরজি কর হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে প্রথমে দেখা করি ওই মেয়েটির মা-বাবার সঙ্গে। তাঁদের সমবেদনা জানানোর পরে সারা দিন সেখানেই ছিলাম। পূর্ণাঙ্গ ঘটনার কথা শোনার পরেই রাগে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি করেছিলাম।

আমার কন্যাসম চিকিৎসকের শেষকৃত্য হয়েছিল পানিহাটি শ্মশানে। সেখানেও সেদিন রাত পর্যন্ত ছিলাম। একজন মা-বাবার কাছে সন্তান হারানোর কষ্ট কী, তা শ্মশানে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করেছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী যখন বিধানসভায় ‘অপরাজিতা বিল’ এনে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আইন কার্যকর করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, তখন আমার ভূমিকা বিধায়ক বা মুখ্য সচেতকের বদলে ছিল একজন পিতার। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেই আইনে মান্যতা দিল না। কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের এই উদ্যোগকে আটকে দেওয়ায় যেমন কষ্ট পেয়েছি, তেমনই ওই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত খুনির মৃত্যুদণ্ড না হওয়ায় আমি দুঃখিত। একজন পিতা হিসাবে বলতে পারি, আদালতের রায় আমায় সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু আদালতের রায় তো সকলকেই মেনে নিতে হয়! তাই নিজের ক্ষোভ অন্তরেই চাপা দিয়ে রেখেছি।

মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়

আরজি করের ঘটনার এক বছর পরে দাঁড়িয়ে অনুভূতি একটাই— মানুষ মনে করছে, যা হওয়ার ছিল, তা হয়নি। কলকাতা পুলিশ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সিবিআই মিলে যা করেছে, তা হওয়ার কথা ছিল না। এই কলকাতা পুলিশ আমাকেও আড়াই ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। হয় আমায় অভিযুক্ত করত বা আমি যে অভিযোগ করেছিলাম তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত। কিন্তু কোনওটাই করেনি।

একটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে কলকাতা পুলিশের অধিকারিক ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়কে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিয়োয় কলকাতা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে বসে যিনি ‘লাইক’ দিয়েছিলেন, তাঁকে পুলিশ সমন পাঠিয়েছে। কিন্তু ইন্দিরা সাংবাদিক বৈঠক করে যা যা ছবি দেখিয়েছিলেন, তা কেন তদন্তের আওতায় এল না? কলকাতা পুলিশ যা করেছে, তা আসলে সার্বিক ভাবে রাজ্য প্রশাসনের মানসিকতার প্রতিফলন। রাজ্যের সব থানা এ ভাবেই কাজ করছে। কিন্তু আমি মনে করি না, পুলিশের সবাই অসৎ বা খারাপ। একটা অংশ রয়েছে, যারা কাজ করতে চায়। কিন্ত তাদের দাবিয়ে রাখা হচ্ছে।

অনেক দুঃখ, অনেক যন্ত্রণার মধ্যে সিবিআইয়ের প্রাথমিক কথায় আশ্বস্ত হয়েছিলাম। সিবিআইও আমায় ডেকেছিল। তারা বলেছিল, এমন তদন্ত হবে, যা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকবে না। কিন্তু এখন সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েও অজস্র প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন তুলছেন নির্যাতিতার বাবা-মা। সন্তান হারানোর যন্ত্রণার মধ্যেই তাঁদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, আইনের ধারা জেনে লড়াই করতে হচ্ছে।

যারা নৃশংসতা ঘটিয়েছিল, তারা এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজ্য আর কেন্দ্র মিলে অপরাধীদের সুরক্ষা দিয়েছে। দিয়েছে বলেই গত এক বছরে প্রায় রোজ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আরজি করের মতো ঘটনা ঘটেছে। তবে আমি আশাবাদী। কারণ, এই সরকারের বিরুদ্ধেই কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। মানুষ তার পরেও রাস্তায় থেকেছেন। তাঁরা এখনও আছেন এবং থাকবেন। এই সরকার আসলে বালির স্তূপের উপর বসে আছে।

(তথ্যসংগ্রহ: ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়, অমিত রায়, শোভন চক্রবর্তী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement